মেরি ক্রিসমাস আদতে দু’টি নিঃসঙ্গ মানুষের একে অপরের আলম্ব হয়ে ওঠারই গল্প— ঘটনাচক্রে যে সম্পর্ক দানা বাঁধতে সাহায্য করেছে একটা খুন।‘তানহা শহর মে ইয়ুঁ তানহা সে মিল গ্যয়া’— গানের এ পঙক্তিই আসলে মূল ছবির ক্যাচলাইন। এরিক রোহমার যদি ফ্রান্সের প্রেক্ষাপটে ছবি বানিয়ে থাকেন, রাঘবন বেছে নিয়েছেন আটের দশকের বম্বে— প্রাক-উদারীকরণ শহর, যে তখনও মুম্বই হয়নি। সেই মহানগরীতে দু’জন সঙ্গহীন, অন্তর্মুখী মানুষের হঠাৎই দেখা হয়ে যায়; ছবি তাদের দু’জনের সঙ্গে থাকে শেষতক, যত্ন করে দেখায় তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ধাপগুলো।
লেখাটির শুরুতে তিনটি বিষয় জানাই। প্রথমত, লেখাটি সম্পূর্ণ স্পয়লারমুক্ত। শুধু এই ছবিটিই নয়, বরং রাঘবনের অন্যান্য যে কাজের সমান্তরাল টেনেছি, সেই ছবিগুলোরও জোরালো প্লট-পয়েন্টগুলো বলিনি। কাজেই যাঁরা দেখেছেন এবং দেখেননি, দু’-পক্ষই নির্দ্বিধায় পড়তে পারেন। দ্বিতীয়ত, মূল উপন্যাস এবং তা থেকে আধারিত প্যারিস পিক–আপ (১৯৬২) ছবিটি নিয়ে আমার কোনও ধারণা নেই। ফলে, মেরি ক্রিসমাস আমার কাছে সম্পূর্ণ মৌলিক এবং তরতাজা ছবি; এবং লেখার গোড়াতেই স্বীকার করে রাখা ভালো, ছবিটি নিয়ে আমি উচ্ছ্বসিত। এই উচ্ছ্বাস, পক্ষপাত হয়তো লেখার কয়েকটা জায়গায় প্রকট হয়ে পড়বে। সে কারণে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তৃতীয়ত, যেহেতু শ্রীরাম রাঘবনের ছবি এবং ট্রেলারে খুনের উল্লেখ আছে, তাই ভেবেছিলাম জনি গদ্দার (২০০৭), অন্ধাধুন (২০১৮)-এর পর আরও একটা জবরদস্ত থ্রিলার আসছে। ছবিটি শুরু করার সময়েও একটা দুর্ধর্ষ থ্রিলার দেখব ভেবেই বসেছি। কিন্তু যখন ছবির শুরুতেই এরিক রোহমারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হল, তখন ভুল ভাঙল। যে ছবি এরিক রোহমারকে ধন্যবাদ জানিয়ে, শক্তি সামন্তকে উৎসর্গ করে যাত্রা শুরু করছে, তা তো কেবলই থ্রিলার হতে পারে না! অতএব, পূর্ব-আহরিত ধারণা ঝেড়ে ফেলে যখন ছবিটি দেখতে বসলাম, রসাস্বাদন মধুরতর হল। কেন বললাম এ-কথা? লেখায় বিস্তারে আলোচনা করব।
এরিক রোহমার ও মেরি ক্রিসমাস:
কে এরিক রোহমার? তাঁকে ধন্যবাদজ্ঞাপন শুরুতেই এত জরুরি হয়ে উঠছে কেন? ফরাসি নবতরঙ্গের বা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এরিক রোহমার— জঁ লুক গদার, ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফোদের মতোই। রজার ইবার্ট রোহমারের ছবি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একটা সাংঘাতিক তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন— ‘পাঠক, যদি আপনার ডায়েরি থেকে রোহমার ছবি বানাবেন মনস্থির করেন; তাহলে ঘটনাবহুল দিনগুলি নয়, ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে যে দিনগুলোয় আপাতভাবে কিছুই ঘটেনি, সেই দিনগুলোই বেছে নেবেন এরিক।’ রোহমারের ছবিতে ঘটনার ঘনঘটা ছিল না, বরং তাঁর মনোযোগ ছিল দু’টি বড় ঘটনার মাঝে চুপচাপ থেকে যাওয়া নিস্তরঙ্গ, ক্লান্তিকর দিনগুলোর দিকেই। আবেগের বা নাটকীয়তার তুঙ্গ মুহূর্ত নয়, তাঁর পছন্দ ছিল দৈনন্দিন, সাদামাঠা দিনযাপনকে ছবিতে ধরে রাখা। ধরা যাক, আ গ্রিন রে (১৯৮৬)– যার বিকল্প নাম সামার– ছবিটির কথা। মূল চরিত্র ডেলফিন প্যারিসবাসী যুবতী। গল্পটা কী? ফ্রান্সে প্রথাগতভাবে অগাস্ট মাসটা বেড়াতে যাওয়ার ছুটি দেওয়া হয়, সকলে পরিবার, বন্ধুবান্ধব অথবা প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে ছুটি কাটাতে যায়। একবার ডেলফিন যাওয়ার জন্য কাউকে পেল না। সে বছর যখনই সে একা বা অন্য দলের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে ঘুরতে গেল, তখনই বুঝতে পারল সে আসলে সর্বত্রই বেমানান। শেষতক, একজন মানুষকে ডেলফিন পেল, যার সঙ্গে সত্যিই দু’দণ্ড কথা বলা যায়; আরও জরুরি, যার সঙ্গে দু’দণ্ড চুপ করে থাকা যায়। তার সঙ্গে প্রেম হবে? নাকি ওটাই তাদের প্রথম ও শেষ দেখা? ছবিটা উত্তর দেয় না, কিন্তু একটা আশাবাদী জায়গায় শেষ করে। সেই আশা মহাবৈশ্বিক, জগতের পরিধি ছাড়িয়ে তার ব্যাপ্তি। বর্তমানের নিগড় ভেঙে সে মুহূর্ত হয়ে ওঠে অতীত-ভবিষ্যতের যোগসূত্র। রোহমারের ছবি এমন। তাঁর মূল চরিত্ররা প্রধানত বিষণ্ণ, নিঃসঙ্গ; এবং সর্বোপরি, আবেগী। তাদের জীবন খুঁড়ে দেখতে রোহমার ক্যামেরা নিয়ে বসেন— তাদের প্রেম, দুঃখ, নীতিবোধ, বিচ্যুতিকে সযত্নে ধরে রাখেন ছবিতে। সময়ে-সময়ে তাদের উপনীত হতে হয় আশ্চর্য সমস্ত দার্শনিক দোলাচলে, সেই সময়ে তাদের দ্বিধা, তাদের কপটতাও সন্তর্পণে দেখান রোহমার। ঘটনা নয়, ঘটনার ফাঁকে-ফাঁকে থেকে যাওয়া সূক্ষ্ম অনুভূতি রোহমারের ছবির প্রধান উপজীব্য হয়ে থেকে যায়। ফ্রান্সের মানুষের প্রেম-বিষণ্ণতা-নিষিদ্ধতায় জড়িয়ে পড়া-কান্না-হর্ষ রোহমারের মতো মরমী হয়ে আর ক’জন দেখাতে পেরেছেন? লং টেকে, সুদীর্ঘ সংলাপপুষ্ট দৃশ্যে রোহমার বার করে আনতেন একেকটি চরিত্রের অন্তর্বতী টানাপোড়েন; দীর্ঘ টেকে ক্যামেরা হয়ে উঠত নীরব পর্যবেক্ষক। যেন, দর্শকও অবলোকনের এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ছে। রোহমারের ছবি শেষতক অসম্ভব স্থিতধী, নিঃসঙ্গ মানুষের বিষণ্ণ দিনযাপনের কথা বলেও শেষমেষ দিয়ে যায় একটুকরো আশার আলো। এমন একজন মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে যখন মেরি ক্রিসমাস শুরু হয়, তখন নড়েচড়ে বসতে হয় বইকী।
দেখুন, মেরি ক্রিসমাস আদতে দু’টি নিঃসঙ্গ মানুষের একে অপরের আলম্ব হয়ে ওঠারই গল্প— ঘটনাচক্রে যে সম্পর্ক দানা বাঁধতে সাহায্য করেছে একটা খুন।‘তানহা শহর মে ইয়ুঁ তানহা সে মিল গ্যয়া’— গানের এ পঙক্তিই আসলে মূল ছবির ক্যাচলাইন। রোহমার যদি ফ্রান্সের প্রেক্ষাপটে ছবি বানিয়ে থাকেন, রাঘবন বেছে নিয়েছেন আটের দশকের বম্বে— প্রাক-উদারীকরণ শহর, যে তখনও মুম্বই হয়নি। সেই মহানগরীতে দু’জন সঙ্গহীন, অন্তর্মুখী মানুষের হঠাৎই দেখা হয়ে যায়; ছবি তাদের দু’জনের সঙ্গে থাকে শেষতক, যত্ন করে দেখায় তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ধাপগুলো। প্রথমার্ধে রোহমারের মতোই লং টেকে ক্যামেরা এই দু’জনকে ধরে রাখে। যখন দর্শক রোজির কথা জানতে পারছে, তখনকার শটটি মনে করুন। দীর্ঘস্থায়ী একটা শটে অ্যালবার্টের স্মৃতিচারণ দেখানো হয়— যেন ক্যামেরা কাট করে বিন্দুমাত্র ছিন্ন করতে চায় না স্মৃতিচারণের, বিষাদের এই নিবিড় মুহূর্তটি। যখন মারিয়া গান চালিয়ে অ্যালবার্টের সঙ্গে নাচে, তখন প্রায় আড়াই মিনিটের একটা টেক আছে। দৃশ্যটি অভিনয়গুণেও আইকনিক। মারিয়া যখন জেরোমের অত্যাচারের কথা বলছে, তখন ক্যামেরা চলে যায় এক্সট্রিম ক্লোজআপে। মারিয়া-রূপী ক্যাটরিনা কাইফের মুখের প্রতিটি পেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে দর্শকের চোখে। লং টেক নেওয়ার ফলে, এক্সট্রিম ক্লোজ আপ নেওয়ার ফলে কী হয়? কাট তো আসলে গল্প বলার দুর্দান্ত হাতিয়ার, তা গল্পকেই নির্মেদ করে, বাড়তি অংশ ছেঁটে বলতে সাহায্য করে। কিন্তু এক্ষেত্রে কাট সংখ্যা কমিয়ে এনে, ক্যামেরাকে দৃশ্যের সঙ্গে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিয়ে আসলে এই দু’জনের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ করে দেন রাঘবন। দু’জনের সূক্ষ্মতম অনুভূতিটিও যেন দর্শকের চোখ এড়িয়ে না যায়— সুনিশ্চিত করেন সেটুকু। ঘটনার ঘনঘটা আসার আগে, রাঘবন দু’জনের দৈনন্দিন বিষাদ-উল্লাস-মশকরা ধরে রাখেন সময় নিয়ে। তাহলে কি ছবিটি সময়বিশেষে বোরিং হয়ে ওঠে? একটুও না। বরং, চরিত্রদুটোর দিনযাপনই এত বৈচিত্রপূর্ণ, তা দেখতে দেখতে এতটুকু একঘেয়েমি আসে না।
ছবির প্রথমার্ধ অতএব হয়ে থাকে দু’জন নিঃসঙ্গ মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠার, একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ডকুমেন্টেশন। পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা মহানগরীর বুকে দুই নিঃসঙ্গ চরিত্র— তাদের জীবনের ঘটনাপ্রবাহে শরিক হয়ে পড়ে খোদ ছবিটিই। এর পরেও বলতে হবে কেন ছবিটি রোহমারকে ধন্যবাদ জানিয়ে যাত্রা শুরু করে? এর পরেও শক্তি সামন্তকে উৎসর্গ করা নেহাতই সমাপতন, যে ভদ্রলোক হিন্দি ছবির জগতে শ্রেষ্ঠ সমস্ত প্রেমের ছবির নির্মাতা?
কিন্তু মেরি ক্রিসমাস রোহমারের ছবি নয়। শক্তি সামন্তেরও নয়। শ্রীরাম রাঘবনের ছবি। এক হাসিনা থি (২০০৪), জনি গদ্দার, অন্ধাধুন, বদলাপুর (২০১৫)-এর নির্মাতার ছবি। বই, পাশ্চাত্য সংগীত, মদ, বিভিন্ন ক্যুইজিনের মতোই যাঁর ছবির অবিচ্ছেদ্য উপাদান হল রক্ত; ভায়োলেন্স। সেই রাঘবনের ছবিতে একটু ছানবিন করা যাক।
কাট টু: মেরি ক্রিসমাস বাই শ্রীরাম রাঘবন
লক্ষ করলে দেখবেন, ছবি শুরু হওয়া থেকেই একটা অন্তর্লীন রোমাঞ্চের চোরাস্রোত বইতে থাকে। আপাতভাবে কিছুই ঘটছে না, কিন্তু কোথাও যেন একটা খটকা থেকেই যায়। তার কারণ, রাঘবন ছবিজুড়ে অনেকগুলো ভিজুয়াল প্যাটার্ন তৈরি করে রাখেন। সময়ে-সময়ে সেই প্যাটার্নগুলো ভেসে ওঠে; সুন্দর-সুঠাম দৃশ্যে কিছু বেয়াড়া আঁকিবুঁকি তৈরি হয়— দর্শকের মনে সন্দেহটা থেকেই যায়। রাঘবন কয়েকটি শটে কিছু ভিজুয়াল কেঅস তৈরি করেন বলা চলে। ফলে, দীর্ঘক্ষণ ধরে শান্ত, স্থিতিশীল দৃশ্যের আচমকা কয়েকটি শটে কিছু কেঅটিক উপাদানের আগমন ঘটতেই দর্শক নড়েচড়ে বসে। মুহূর্তেই সেই সন্দেহ তাৎক্ষণিকভাবে প্রশমিত হয়ে আসে বটে; কিন্তু, কখনওই মন থেকে নির্মূল হয় না। বস্তুত, শিল্পের মাহাত্ম্য ‘কী বলা হচ্ছে’ তার ভিত্তিতে তৈরি হয় না, ‘কীভাবে বলা হচ্ছে’ তার ভিত্তিতে তৈরি হয়। কোন দৃশ্য কীভাবে দেখানো হচ্ছে, ক্যামেরা কী ভূমিকা নিচ্ছে, শব্দ কী ভূমিকা নিচ্ছে— এই সমস্ত বিষয় দর্শককে প্রভাবিত করে; দৃশ্যের অভিঘাতের মাত্রা নির্ধারণ করে।
যখন প্রথম রাজেশ খান্নার টিকিটটি অ্যালবার্ট পেল, যখন প্রথম দর্শক দেখতে পেল ‘The night is darkest just before dawn’; তার ঠিক পরের দৃশ্যে ওজন মাপার যন্ত্রের আলো পড়ে অ্যালবার্টের মুখে। তৈরি হয় আশ্চর্য এক নকশা। যে নকশা হয়ে ওঠে জটিলতার প্রতীক। সিমেট্রি ভাঙা, ঈষৎ জটিল এই শটটায় দর্শকের একটা চোরা-অস্বস্তি তৈরি হয়। তারপরে মারিয়া যখন অ্যালবার্টকে থামিয়ে একই কথা উচ্চারণ করে, তা-ও ঠিক মারিয়ার ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে; অস্বস্তি, সন্দেহ, সাসপেন্সটি আরও জাঁকিয়ে বসে দর্শকের মনে।
আবার লক্ষ করুন, একদম প্রথমে কাম টু হোম প্যারাডাইজের কার্ড ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছে অ্যালবার্ট, তখন ক্যামেরা তাকে সন্তর্পণে লক্ষ করে জানালার ফাঁক থেকে। জানালার গ্রিল, পর্দা অসংলগ্নভাবে ডিফোকাসে থেকে আবারও একটা কেঅস তৈরি করে। মনে হয়, অ্যালবার্টের বহির্বিশ্বের কাছে যে পরিচয় আছে, তাতে কি খানিক জল মেশানো? আবার সেই সন্দেহ প্রশমিত হয়ে আসে, কারণ ক্যামেরা তখন অ্যালবার্টের সাত বছর পরে বাড়ি ফেরায় মনোনিবেশ করেছে। অ্যালবার্টের স্মৃতিচারণে মনোনিবেশ করেছে।
যখন অ্যালবার্ট প্রথম মারিয়ার ফ্ল্যাটে যাচ্ছে, তখন লিফটের শটটি লক্ষ করুন। ক্রমাগত হলদেটে আলো লিফটের গরাদের ফাঁক দিয়ে দু’জনের মুখে আঁচড় কেটে যায়। এই শট ফিরে আসবে দ্বিতীয়ার্ধেও, যখন এই দু’জনের সঙ্গে রনিও চলেছে মারিয়ার ফ্ল্যাটে। আবারও, তৈরি হয় একটা ভিজুয়াল কেঅস— যা এই ছবির গোড়া থেকে থ্রিলার-দর্শকের সন্দেহপ্রবণতাকে উসকে দেওয়ার কাজ করেছে।
মারিয়ার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে অ্যালবার্ট যখন পুলিশের সঙ্গে কফি খাচ্ছে, তখন দর্শক খুনটি দেখে ফেলেছেন। এর পর থেকেই আসল রহস্য-রোমাঞ্চ শুরু হবে। সেই মুহূর্তে অ্যালবার্টের মাথার পিছনে আলোর বোকে আবারও একটা ভিজুয়াল কেঅসের সৃষ্টি করে। এতক্ষণ শ্যালো ফোকাসে আমরা মোটামুটি একরঙা বা ফ্ল্যাট ব্যাকগ্রাউন্ড দেখতে পাচ্ছিলাম, আচমকা অনেকগুলি আলোর বোকে আমাদের সেই মসৃণ ব্যাকগ্রাউন্ড দেখার অভ্যেসটা ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়। আমরা আবারও একটা গন্ডগোলের আঁচ পাই। এমনকী, শুধু যে খুনের আগেই এই ভিজুয়াল কেঅসগুলো তৈরি হয়েছে তা নয়, খুনের পরেও সন্দেহজনক জায়গায় রাঘবন একেকটি প্যাটার্ন এনে হাজির করেছেন। যেমন, তদন্তরত ইনস্পেক্টর পরেশ কামদারকে দাঁড় করানো বারান্দার মাঝামাঝি একটা জায়গায়, নিচ থেকে নেওয়া শটে একটা অ্যাসিমেট্রিক ফ্রেম তৈরি হয়। একেকটি প্যাটার্ন হয়ে ওঠে মানব-মস্তিষ্কের জটিলতর প্রকোষ্ঠগুলির দ্যোতক, রহস্যের জটের ভিজুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন।
এর পাশাপাশি আয়নার মোটিফ তো আছেই। আয়না রাঘবনের ছবিতে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা অন্ধাধুন-এ দেখেছিলাম— মনোহরের স্ত্রী মনোহরের উদ্দেশ্যে গুলি চালানোর সময়ে ভাঙা আয়নায় দেখা যাচ্ছে মনোহরের প্রতিফলন। সমস্ত গোপনীয়তা, মনোহরের সংসারের প্রতীক হয়ে থাকে ওই আয়না— যাতে চিড় ধরেছে। এ ছবিতেও মারিয়ার রহস্যময়তা বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে আয়না বা প্রতিফলনের ব্যবহার। মারিয়া আয়না দেখে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক লাগায়, প্রথম অন্তরঙ্গতার মুহূর্তে আয়নায় নিজেকে দেখে সংযত হয়— রাঘবনের ধারাবাহিক দর্শক এটুকু দেখেই আঁচ করে নিতে পারবেন: সামথিং ইজ নট রাইট। এ ছবিতেও ফিরে আসে বেড়াল। অন্ধাধুন-এ আকাশের পোষা বেড়াল রানি ছিল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, জনি গদ্দার-এ জনির পোষা বেড়াল ছিল গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র; এ ছবিতেও একদম শুরুর দিকে মেরি ক্রিসমাস লেখাটি পর্দায় আসার সময়েই ডাকবাক্সের ওপরে একটা বেড়ালকে বসে থাকতে দেখা যায়। আবারও, যাঁরা রাঘবনের কাজের সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচিত, তাঁরা একটা রহস্যের আভাস পান। অন্ধাধুন-এর খরগোশের মতো এ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় দু’টি মাছ। ক্রমাগত কাগজের হাঁসের মোটিফ আসতে থাকে, গোটা ছবিতে তাদের ভূমিকা বদলে বদলে যায়— কখনও বাচ্চা ভোলাতে, কখনও ইচ্ছাপূরণের মাধ্যম হিসেবে, কখনও অ্যালবার্টের উপস্থিতির প্রমাণ হিসেবে। এ ছবিতেও ফিরে ফিরে আসে অজস্র পাল্পি উপাদান— সব নেহাতই নেমড্রপিং নয়, গল্পের অগ্রগমনে তাদের সদর্থক ভূমিকা আছে।
যদি খেয়াল করে দেখা যায়, রাঘবনের ছবিতে ওয়ালপেপার, বা দেওয়ালে লাগানো স্টিকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। অন্ধাধুন-এ প্রমোদ সিনহা-সিমি সিনহার বাড়ি মনে আছে? ঝকঝকে-তকতকে ওয়ালপেপারে মোড়া ঝাঁ-চকচকে ঘর। সুখী দাম্পত্যের নিদর্শন। কিন্তু গল্প এগোতেই আমরা বুঝতে পারি, সেই সুখী-সুখী ভাব আসলে কতখানি ফাঁপা, লোকদেখানো। গল্পের ক্লাইম্যাক্স আসে চটা-ওঠা স্টোররুমে, ধুলোমাখা গুদামঘরে, আন্ডারগ্রাউন্ড হাসপাতালে। রাঘবন এমনটা করেন। তাঁর ছবিতে সুসজ্জিত ঘর আসলে অন্তঃসারশূন্যতার প্রতীক। সেই ঘরকে ত্যাগ করে তিনি ছবিকে নিয়ে আসেন ছাপোষা অভ্যন্তরে; মলিন-ক্লিন্ন অঞ্চলে। পরিপার্শ্বের নগ্নতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় মানবচরিত্রের নগ্নতা। মানুষের ফাঁপা সত্তাটি মুছে ফেলে তার আসল, মূলগত জায়গায় পৌঁছতে চান রাঘবন। এ ছবিতেও তাই-ই। মারিয়ার সুসজ্জিত ঘরে ছবিটি শুরু হয়ে দ্বিতীয়ার্ধে এসে পৌঁছয় ভাঙাচোরা, পরিত্যক্ত ঘরে; একের পর এক ওয়ালপেপার ছেঁড়া হয়ে ওঠে ভানের পরত ত্যাগ করে নিজের সত্তাটিকে দর্শকের সামনে এনে রাখার প্রক্রিয়া। চরিত্রগুলোও নিজের আসল রূপ ধরে হাজির হয় দর্শকের সামনে।
রাঘবন ছবির গোড়া থেকেই দর্শককে একটা ইঙ্গিত দিতে থাকেন, যে ছবিতে অস্বাভাবিক, কেঅটিক কিছু ঘটবে। এবং, সেই অস্বাভাবিক, কেঅটিক ঘটনা মোটেই খুনটি নয়; ট্রেলারেই সে দৃশ্য দেখানো যখন, মূল ট্যুইস্ট মোটেই সেই খুনের ঘটনায় নেই। সচেতন দর্শকের জন্য রাঘবন একের পর এক সুতো ছেড়ে গেছেন— ভিজুয়াল কেঅস তৈরি করা হোক, আগের ছবির মতো মোটিফ ব্যবহার করে রহস্য ঘনীভূত করা হোক; রাঘবন প্রেমের গল্প বললেও খুব সূক্ষ্মভাবে রহস্যের একটা চোরাস্রোত তৈরি করতে পেরেছেন। আরেকটা ছোট্ট উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। ধরুন, একদম গোড়ার দিকে, যখন অ্যালবার্ট আর মারিয়া হেঁটে যাচ্ছে, তখন ক্যামেরা তাদের পাশ বরাবর সাইড ট্র্যাকিং করে। আমরা সেই চরিত্রদুটো, তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটি খানিক অনুমান করার চেষ্টা করি। ধারণাও তৈরি করার চেষ্টা করি। এর আরও পরে ওই একই দৃশ্য সামনে থেকে ট্র্যাকিং শটে নেওয়া হয়, তখন আমরা ওই দুটো চরিত্র সম্পর্কে অনেকটা জেনে ফেলেছি। এবং বুঝে ফেলেছি আমাদের পূর্ব-আহরিত ধারণার সঙ্গে এই চরিত্রদুটোর বাস্তবে মিল খুব কম।
প্রথম ছবিতে যেহেতু আমরা দু’জনকে একপাশ থেকে দেখতে পাচ্ছি, সেই একমাত্রিক দৃষ্টি হয়ে ওঠে আধা-সত্য জানার নামান্তর। আমরা তো তাদের পুরোটা দেখতে পাইনি, যেমনটা তাদের জীবন সম্পর্কে পুরোটা জানি না। আবার পরে যখন সামনে থেকে দেখছি, তখন দু’জনকে বেশি করে দেখতে পাচ্ছি; ঠিক যেমন তাদের জীবন সম্পর্কে অনেকটা জানি। এই পার্শিয়াল এবং ফ্রন্টাল ভিউ হয়ে ওঠে চরিত্রদু’টি সম্পর্কে ছবিটি কতটা ইনফর্মেশন দিচ্ছে, তার প্রতীক। এভাবেই রাঘবন ভিজুয়ালি গল্প বলেছেন গোটা ছবি জুড়ে, যেমনটা তিনি করতে সিদ্ধহস্ত। গোটা ছবিটিতে প্রাণ দিয়েছে মধু নীলাকন্দনের ক্যামেরা।
উৎসবমুখর মহানগরীতে, দু’জন আগন্তুকের আচমকা সাক্ষাতে প্রেমের সম্ভাবনা আছে। আর কী কী হতে পারে সেই মোলাকাত থেকে? রাঘবন শুধু বিল্ড-আপ করেছেন গোটা প্রথমার্ধ্ব জুড়ে। তারপর দ্বিতীয়ার্ধ্ব ? ক্লাসিক শ্রীরাম রাঘবন ফিল্ম।
মেরি ক্রিসমাস: কয়েকটি রেফারেন্স
আদতে তো শ্রীরাম রাঘবনের ছবি। জনি গদ্দার-এ তিনি জনির হাতে ধরিয়ে দেন জেমস হার্ডলি চেজের দ্য হুইফ অফ মানি-র পেপারব্যাক। অন্ধাধুন-এ প্রমোদ সিনহাকে দেখান অনিল ধাওয়ানের পুরনো ছবির গান। সে ছবিতেই মোক্ষম মুহূর্তে প্রোটাগোনিস্ট গায় হাওয়াস (১৯৭৪) ছবির প্রেমের গান। বদলাপুর (২০১৫)-এ অ্যান্টিহিরোর বর্ণনায় অপরাধীর চেহারা হয়ে ওঠে অভিনেতা রঞ্জিতের মতো। তাই রাঘবনের ছবির রেফারেন্সগুলি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরা যাক, গোড়ার দিকে রিগ্যাল সিনেমায় চলা হিচককের ছবি রেবেকা (১৯৪০)। গোড়াতেই এই থ্রিলার ছবিটির পোস্টার দেখে দর্শক অনুমান করেন, বোধহয় কিছু একটা ঝামেলা হবে। উল্লিখিত ছবিটিতে দুই আগন্তুকের প্রেম এবং বিবাহ থেকে নানাবিধ সমস্যার সূত্রপাত হয়, মেরি ক্রিসমাস-এও রেবেকা-র পোস্টারের সামনেই আলাপ নিবিড় হয় অ্যালবার্ট এবং মারিয়ার। সিনেমা হলে যখন দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ পিনোকিও (১৯৭২) চলছে, তখন ছবিটা একবারের জন্য পর্দায় দেখে না; আবদ্ধ থাকে দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায়— যে ট্রিটমেন্ট অবধারিতভাবে মনে করায় আব্বাস কিয়ারোস্তামির শিরিন (২০০৮)-কে। আমি অবশ্যই এখানে দার্শনিক-রাজনৈতিক তুলনা টানছি না, কেবল দৃশ্যগত সামঞ্জস্যের কথা বলছি। আবার ধরা যাক, মারিয়ার ফ্ল্যাটে বাজে ইন দ্য হল অফ দ্য মাউন্টেন কিং, এডভার্ড গ্রিগের সুর। এই রেফারেন্সটা জরুরি কেন? তার জন্য একটু পিছনে তাকাতে হবে। এই সুরটি এমনিতে বাজে হেনরিক ইবসেনের নাটক পিয়ার জিন্ট-এর দ্বিতীয় অ্যাক্টে। সেই দ্বিতীয় অ্যাক্টের গল্পটা আমরা ছোট করে একটু দেখি। পিয়ার জিন্ট, নরওয়ের এক কৃষকপুত্র, বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তার সঙ্গে দেখা হয় এক নারীর, যে ট্রোলদের (সোশ্যাল মিডিয়ার কেউ না, নরওয়ের রূপকথার এক জীবগোষ্ঠী) রাজকন্যা। তার সঙ্গে জিন্ট গিয়ে পৌঁছয় পাহাড়ের মাথায়, ট্রোলরাজার দরবারে। ট্রোলরাজা সেখানে জিন্টকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার মেয়েকে বিয়ে করবে? পিয়ার জিন্ট অসম্মত হলে ট্রোলরাজা তাকে একটা দার্শনিক প্রশ্ন করেন: মানুষের সঙ্গে আমাদের তফাত কি বলো তো? জিন্ট নিরুত্তর। রাজাই বললেন, মানুষ বলে, নিজের কাছে সৎ থাকো (to thyself be true); আর আমরা, ট্রোলরা বলি নিজের স্বার্থটা আগে দেখো (to thyself be— enough)। গোটা বিষয়টা ঘটে পিয়ার জিন্টের স্বপ্নে।
রাজার মন্তব্যটা বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে গেলে মেরি ক্রিসমাস-এর গল্পের সঙ্গে একটা যোগসূত্র হয়। ট্রোলরাজা বলতে চাইছেন, মানুষ তার নীতি-নৈতিকতা, বোধবুদ্ধি, সততাকে গুরুত্ব দেয়— সে কারণেই সে মানুষ। কিন্তু ট্রোলরা নিজের স্বার্থটুকুই আগে দেখে। পিয়ার জিন্ট ট্রোলদের বাকি কথায় গুরুত্ব না দিলেও এই বাক্যটা নাটকের বাকি অংশে মেনে চলবে। এই বক্তব্যেরই কি অনুরণন ঘটে না, যখন অ্যালবার্ট মারিয়াকে বলছে, সামটাইমস ভায়োলেন্স ইজ বেটার দ্যান স্যাক্রিফাইস? আদপে অ্যালবার্ট এবং মারিয়া কি মুহূর্তকালের জন্যও নিজেদের নৈতিকতা-দর্শন-সামাজিকীকরণ ভুলে নিজেদের দিকেই তাকায়নি? এমন দু’টি মানুষের মিলনমুহূর্তে যদি ইন দ্য হল অফ দ্য মাউন্টেন কিং বাজে, যে সুর আসলে নীতিবোধ বনাম আদিম হিংস্র মানবিকতার দ্বন্দ্বের সুর— তাকে কি নেহাতই র্যান্ডম সুর বলতে ইচ্ছে হয়? পিয়ার জিন্টের স্বপ্নদৃশ্যের সম্প্রসারণই কি হয়ে ওঠে না অ্যালবার্টের সংলাপ: মেরে লিয়ে ইন তিন ঘণ্টা সপনোঁ কি তারাহ থা? আসলে তো মারিয়া আর অ্যালবার্টের মানসিক যোগসূত্রও সাংঘাতিক। পিয়ার জিন্ট যেমন স্বপ্নে দেখা পেয়েছিল ট্রোল রাজকন্যার, অ্যালবার্টও তেমন টাইম ট্র্যাভেলের নাম করে এক পুরনো কবরখানায় নিয়ে যায় মারিয়াকে। যে জায়গা এতক্ষণ দেখা উষ্ণ নগরীর ঠিক বিপরীত মেরুতে— শীতল, স্যাঁতসেঁতে, নির্জন। তাহলে কি আদতে ইন দ্য হল অফ দ্য মাউন্টেন কিং আসলে নাটকে যে উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল, ছবিতেও সেই উদ্দেশ্যেই বাজে? রাঘবন, বরাবরের মতোই, কংক্রিট উত্তর দেন না; বদলে অজস্র সূত্র ছেড়ে যান।
শুধু এখানেই শেষ নয়। তদন্তকারী অফিসারের হাতে রাঘবন ধরিয়ে দেন রেমন্ড শ্যান্ডলারের প্লেব্যাক উপন্যাস। শ্যান্ডলারের একমাত্র উপন্যাস, যার অদ্যাবধি কোনও দৃশ্য-শ্রাব্য অ্যাডাপ্টেশন হয়নি। অনায়াসে চরিত্রের মুখে বসিয়ে দেন অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিঁউ আতা হ্যায় (১৯৮০)-এর রেফারেন্স। একদম প্রথম দিকে, বারের টয়লেটে যাওয়ার সময়ে দেওয়ালে ঝোলানো থাকে মাইক উইলকক্সের আঁকা আইবিস অ্যান্ড হারিকেন। এখানে একটা ছোট্ট বিষয় আছে। মাইক উইলকক্স সমসাময়িক শিল্পী, তাঁর ছবি আটের দশকের বম্বের বারে টাঙানো কালপ্রমাদের নিদর্শন বলেই ধরতে হবে। কিন্তু রাঘবনের ছবিতে শিল্প-নির্দেশনা বিশ্বমানের, তিনি এমন কাঁচা কাজ করবেন কি? বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসেই ছবিটা স্পষ্ট হল। উইলকক্স নিজেই বলেন, তিনি আসলে মানুষের সাবকনশাস বা অবচেতনকে কাগজে ধরতে চান। যে দিকটা অনালোচিত, অচেনা; সেই স্বপ্নের জগৎটাকে তিনি নিয়ে আসতে চান ছবিতে। রাঘবনও তো তাই! যে মানুষকে দেখে একটুও সন্দেহ হয় না, তারই মনন খুঁড়ে তিনি নিয়ে আসেন অদৃষ্টপূর্ব বিভিন্ন দিক। আর আঁকার নামটি লক্ষ করুন: আইবিস অ্যান্ড হারিকেন। এবং একদম শেষদিকে, মারিয়া এবং অ্যালবার্ট যখন একসঙ্গে ঘর পরিষ্কার করছে, তখন গানের একটি পঙক্তি মনে করুন: নজর তেরি তুফান হ্যায়/ বিগড় রাহা লিমান হ্যায়… অতিশয়োক্তি মনে হলেও, আঁকাটি আদপে আসন্ন ঝড়টির একটি প্রতীকী ছবি হয়ে ওঠে।
আবার দু’জনের ট্যাক্সিতে ফেরার দৃশ্যটি মনে করুন। বাজে রজনীগন্ধা (১৯৭৪) ছবির কয়ি বার ইয়ুঁ ভি দেখা হ্যায় ছবির সুর। ঠিক একইরকম ট্যাক্সিতে বসার দৃশ্য ছিল সে ছবিতে। আবার অ্যালবার্ট পালানোর সময়ে বাজে রাজা রানি (১৯৭৩) ছবির যব আন্ধেরা হোতা হ্যায় গানটি।
তবে, ছবির এবং রাঘবনের ফিল্মোগ্রাফির অন্যতম শ্রেষ্ঠ রেফারেন্স সম্ভবত অ-সা-মা-ন্য ক্লাইম্যাক্সটিতে আন্তোনিও ভিভাল্ডি-র দ্য ফোর সিজনস-এর উইন্টার অংশটি বাজা। যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা জানেনই অ্যালবার্টের আংটি খুলে দেওয়া কীভাবে ত্রিমুখী সম্ভাবনার জন্ম দেয়। এখানেই উইন্টার অংশটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভিভাল্ডির কনসার্টে বাজনার মুভমেন্টগুলিকে বোঝার জন্য কতকগুলো পরিস্থিতি অনুমান করলে বিষয়টা আরও জমে। কনসার্টের শেষ অংশ হচ্ছে উইন্টার, সেটার পরিস্থিতিটি খানিক এরকম— প্রথম মুভমেন্টের সময়ে কল্পনা করুন একজন লোককে, যে ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য নিরন্তর মেঝেতে পা ঠুকে গা গরম করার চেষ্টা করে চলেছে। দ্বিতীয় মুভমেন্টে ভাবুন, সেই লোকটি ফায়ারপ্লেস বা সমতুল জায়গায় কাঙ্ক্ষিত উষ্ণতা পেয়ে খানিক স্বস্তি পেয়েছে। তৃতীয় মুভমেন্টে সমস্তটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে— যারা বাড়ির ভেতরে ছিল, তারা দেখে কোথা থেকে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়ছে; আর যারা বাইরে, তারা এমনিই বরফের পাতলা আস্তরণের ওপর দিয়ে মন্দ্রগতিতে হাঁটছে। পড়ে যাচ্ছে, বরফে ধরছে ফাটল। এবার এই পরিস্থিতিটিকে ছবির সাপেক্ষে মিলিয়ে দেখুন। দু’টি মানুষ নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য মিশে যেতে চাইছে মহানগরীর যাপনে, হয়ে উঠতে চাইছে আর পাঁচটা লোকের মতোই আরেকজন; তারপর একে অপরের সান্নিধ্যে এসে পাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত সঙ্গ, উষ্ণতা, ঘনিষ্ঠতা; শেষে মারিয়া আর অ্যালবার্টের মিলনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে এক টালমাটাল পরিস্থিতির মাধ্যমে। শেষের দৃশ্যে ভিভাল্ডির এই সুর ব্যবহার করা মুহূর্তে ছবিটিকে অন্য উচ্চতায় উত্তীর্ণ করে; ছবিটি স্থান-কালের গন্ডি ছাড়িয়ে মহাকালের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করে দেয়। মহৎ শিল্পের তো এ-ই বৈশিষ্ট্য!
ছবির সামগ্রিক আলোচনা:
আমার মনে হয়, শ্রীরাম রাঘবনের ছবি ফিল্ম-রাইটিংয়ের টেক্সটবুক। কীভাবে চিত্রনাট্য সাজাতে হয়, সংলাপ লিখতে হয়, একেকটি ডিভাইসকে সন্তর্পণে ব্যবহার করতে হয়— তা রাঘবনের ছবি দেখে শেখা যায়। এ ছবিতেও লেখকদের একটা কুর্নিশ প্রাপ্য— রাঘবন নিজে, অরিজিৎ বিশ্বাস, পূজা লাধা সুর্তি, অনুকৃতি পাণ্ডের রাইটিং টিম যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন গল্পটিকে, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। ছোট ছোট প্রপস, ছোট ছোট মুহূর্ত পরের দিকে গল্পে যেরকম গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলের উপাদান হয়ে থাকে, সেই ডিটেলিংয়ের প্রশংসা করতেই হয়। মারিয়ার চরিত্রে ক্যাটরিনা কাইফ সম্ভবত জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়টি করলেন। তাঁর অ্যাকসেন্ট নিয়ে ভাবতে না হলে তিনি যে অভিনয়টুকু করতে পারেন, তা রাজনীতি (২০১০)-তে একবার প্রমাণিত হয়েছিল, জগ্গা জাসুস (২০১৭)-এ আরেকবার; এবং এই ছবিতেও আরেকবার প্রমাণিত হল। মারিয়ার বিপন্নতা, শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস, কান্না, বিস্ময় তাঁর সূক্ষ্ম অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিজয় সেতুপতি তো ভালো অভিনেতা আমরা জানিই। এই ছবিতে তিনি সহায়ক অভিনেতার ভূমিকায়, আসল চরিত্র মারিয়াই। অ্যালবার্টের মতো লাজুক, অন্তর্মুখী চরিত্র আচমকা রেগে গেলে কী হতে পারে; তা একটা ছোট্ট দু’-তিন সেকেন্ডের দৃশ্যেই প্রমাণ করেছেন সেতুপতি। নীরবতার মুহূর্তগুলিতে তাঁর অভিনয় বহুবার, বহুবার ফিরে দেখা যায়। ছোট-ছোট চরিত্রে বিনয় পাঠক, সঞ্জয় কাপুর, টিনু আনন্দ, রাধিকা আপ্তেরাও যথাযথ। আসলে রাইটিং ভালো হলে অভিনেতা এবং বাকি সকলের কাজ সহজ হয়ে যায়। রাঘবনের ছবিতে বারংবার সেটাই হয়ে থাকে, সে কারণেই রাঘবনের ছবিতে খারাপ অভিনয়ের নজির বড় একটা নেই।
সুরকার প্রীতম চক্রবর্তী বছরকয়েক ধরেই বাঁধা আবর্তে ঘোরাঘুরি করছিলেন বলে ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছিল। টিপিক্যাল বলিউড ট্র্যাক তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও তৈরি করতে পারেন, সেখান থেকে ছকভাঙা কিছু করা দরকার ছিল। এই ছবি তাঁকে সেই রানওয়েটা দিয়েছে, বরুণ গ্রোভারের লিরিক্স বরাবরের মতোই থেকে যায় নিজের সঙ্গে। গল্পের পরিস্থিতির নির্যাসকে গ্রোভার যেভাবে বুনে দেন গানের কথায়, তাতে বোঝা যায় কেন তিনি জাতীয় পুরস্কার জেতা লিরিসিস্ট।
আর বরাবরের মতোই, রাঘবনের ছবির আর্ট টিমকে টুপি খুলে কুর্নিশ। তাঁরা যেভাবে আটের দশকের বম্বেকে জীবন্ত করেছেন, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রপ ব্যবহার করে গল্পকে এগিয়ে দিয়েছেন— তা শিক্ষণীয়। এই ছবির আর্ট ডিরেকশন, রাঘবনের অন্যান্য ছবির মতোই, বারংবার ফিরে দেখার মতো।
উপসংহার
১. উপন্যাস কীভাবে গল্প বলে? শব্দ-নীরবতা-যতিচিহ্নের মাধ্যমে। ড্যাশের বদলে কমা এলে বাক্যের অভিঘাত বদলে যায়। এক শব্দের বদলে আরেক শব্দ এলে অর্থ বদলে যায়। চিত্রকলা কীভাবে গল্প বলে? ব্রাশের স্ট্রোক, রঙের ব্যবহার, কম্পোজিশনের মাধ্যমে। ঠিক একইভাবে, ফিল্ম কীভাবে গল্প বলে? সিনেমাটোগ্রাফি, রাইটিং, আর্ট ডিরেকশন, মিউজিক প্রভৃতির সামগ্রিক তালমিলের মাধ্যমে। ভালো সিনেমা সেটাই, যেখানে প্রতিটি শট কথা বলছে, বাঙ্ময় হয়ে উঠছে। প্রতিটি প্রপ আছে কোনও না কোনও কারণে, প্রতিটি সুরের আছে নিজস্ব রাজনীতি। এ ছবি সেই গোত্রের। রাঘবনের সব ছবি সেই গোত্রের। রাঘবনের ছবিকে আমি বলি ফিল্মমেকারদের ম্যানুয়াল, মেরি ক্রিসমাস দেখে সেই ধারণা বদ্ধমূল হল।
২. একদম শেষে আসি মাছেদের প্রসঙ্গে। মারিয়া অ্যালবার্টকে জিজ্ঞাসা করল, মাছেরা কি মনে রাখে? অ্যালবার্ট উত্তর দিল, অবশ্যই।
মারিয়ার বাথরুমে কোমোডের জলে বোধহয় মাছ দুটো আজও সাঁতার কাটছে। ছবিটি বারবার ফিরে যায় মাছেদের কাছে। তখনই আবার বুঝি, যতই বহিরঙ্গে ক্রাইম থ্রিলার হোক, ছবিটি আসলে দু’টি নিঃসঙ্গ মানুষের প্রেমের গল্প। মনে পড়ে যায়, পিঙ্ক ফ্লয়েডের গান, উই আর টু লস্ট সোলস/ সুইমিং ইন আ ফিশিং বোল/ ইয়ার আফটার ইয়ার…
বিপুল মহানগরীর বুকে শান্তির খোঁজে ঘুরে বেড়ায় কত নিঃসঙ্গ মারিয়া আর অ্যালবার্টের দল, বছরের পর বছর, মেরি ক্রিসমাস তাদের প্রেমের গল্প। এটুকুই।