১৯৮২-তে চেরবন্ডা রাজু যখন মারা যান, তখন তিনি জেলে ছিলেন না। তাঁর বুকে পুলিশের গুলিও বেঁধেনি। তবুও তিনি শহিদ! কারণ তাঁর এই অকালমৃত্যু দায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিত করেছিল রাষ্ট্র। পাঁচ হাজারেরও বেশি খেটে খাওয়া মানুষের মিছিল যখন চলেছে বিরসম-এর লাল পতাকায় ঢাকা কবির দেহটিকে নিয়ে, সে মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন কবির অভিন্নহৃদয় বন্ধু গণগায়ক গদর, চেরবন্ডার-ই ‘পাহাড় ভেঙে’ গানটি কণ্ঠে নিয়ে। গোটা মিছিল সে গানে গলা মিলিয়েছে তখন। বিজয়ওয়ারা শহরের সব দোকানপাট সেদিন বন্ধ ছিল।
৫.
পাথরে হোঁচট খেয়ে
থুবড়ে পড়েনি যার মুখ,
মাটির স্পর্শ নিতে
মন যার চির-উন্মুখ,
কে বলেছে মরেছে সে কবি…?
সে যদি মরেই যেত
মরে যেত রোদে ভেজা আকাশের নীল,
থমকে দাঁড়িয়ে যেত
মানুষের বাঁচারই স্বপ্নমিছিল…।
বাংলার এক কবি (জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়) লিখেছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের আর এক কবির মৃত্যুতে। চেরবন্ডা রাজু! যে নামটি সে সময়ে শুধু অন্ধ্রের সীমানায় আটকে ছিল না– ভারতের যে কোনও প্রান্তে প্রতিষ্ঠানের চোখে চোখ রাখতে পারা মানুষের মুখে মুখে ফিরত। চেরবন্ডা! এক ঝড়ের পাখির ডাকনাম! ‘জেলের গরাদে যার আশার কুসুম লাল হয়েছে দ্বিগুণ’…!
হায়দরাবাদ থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরের আকালপীড়িত অঙ্কুশপুরম গ্রামে এক গরিব কৃষক পরিবারে রুগ্না মায়ের মরণোত্তর সন্তানটির নাম রাখা হয়েছিল বাল নরসিম্মা। ইশকুলে নাম লেখানোর সময়ে শিক্ষক তাকে বদলে দেন ‘বদ্দম ভাস্কর রেড্ডি’ নামে। এই মাস্টারমশাইয়ের প্রভাবেই তার প্রথম চারপাশকে বুঝতে শেখা, কবিতা লেখার শুরু। এরপর হায়দরাবাদে এসে প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র থেকে ডিগ্রি অর্জন করা। মাস্টারির চাকরি পেয়ে মালকাপেটে যাওয়া। এবং এখানেই প্রথম কবি ও আধুনিক সাহিত্যবোদ্ধা কুম্ভম মাধব রেড্ডির সঙ্গে পরিচিতি (যাঁর নাম পরে হবে নিখিলেশ্বর)– যে পরিচিতি দ্রুত বন্ধুত্বে বদলে যাবে, এবং বদলে যাবেন বদ্দম।
১৯৬৫। ঘুণধরা সমাজের রীতিনীতিকে প্রত্যাখ্যানের প্রতীক হিসাবে ছ’জন আভাঁ গার্দ তেলুগু কবি তাঁদের কুলপরিচিতির নামকে চিরতরে ত্যাগ করলেন। পাঁচজন নাম নিলেন— জ্বালামুখী, নগ্নমুনি, ভৈরবৈয়া, মহাস্বপ্ন এবং নিখিলেশ্বর। ষষ্ঠজন, বদ্দম ভাস্কর রেড্ডি, নাম নিলেন চেরবন্ডা রাজু। তেলুগু ভাষায় ‘চেরবন্ডা’ মানে জেলে কয়েদিদের পায়ে শিকলের সঙ্গে বাঁধা ভারি পাথর। বন্ধনকে চিহ্ন মেনে পায়ের শিকল ভাঙার গান শুরু হল। এই ছ’জনের গোষ্ঠীটি পরিচিত হলেন ‘দিগম্বর কভুলু’ নামে– যার মানে ‘উলঙ্গ কবিরা’। দিগম্বর কভুলু-র প্রথম কবিতা-সংকলন ‘আত্মার যোনি’ প্রকাশিত হল ১৯৬৫-র এক মাঝরাত্তিরে– একজন বেশ্যা, এক রিকশাওয়ালা এবং এক ছিঁচকে লুম্পেনের হাত দিয়ে। অশ্লীল ভাষা ছিল, সাহসী চিৎকার ছিল, বিদ্রোহও ছিল তাঁদের কবিতায়, ছিল না সঠিক দিশা। বরং নৈরাজ্যের ঝোঁক ছিল প্রবল! সেই চিৎকৃত বিদ্রোহের পালে ’৬৭-’৬৮-তে এসে লাগল নকশালবাড়ির দমকা হাওয়া, এক ঝাপটায় বদলে দিল নৌকার অভিমুখ। পাড়ে নেমে এসে ছয় দিগম্বর কবির মধ্যে চারজন এইবার সত্যি সত্যি দাঁড়ালেন নগ্ন মানুষদের কাতারে।
শুধু তাঁরাই নন। ওয়রঙ্গলের ওয়রওয়রা রাও-দের ‘তিরুগুবাটু কভুলু’ (বিদ্রোহী কবিতা), গুন্টুরেরে ‘পয়গম্বর কভুলু’, ‘মার্চ’ গোষ্ঠীর কবিরা সক্কলেই যেন একসঙ্গে এক নতুন আলোয় চোখ মেললেন। ১৯৭০ সালে দিগম্বর কভুলু-র চারজন কবি হাত মেলালেন মহাকবি শ্রীশ্রী, কে কুটুম্ব রাও, কে ভি রমন্না রেড্ডি, মধুসূদন রাও, ওয়রওয়রা রাও-দের সঙ্গে। গড়ে উঠল বিরসম— বিপ্লবী রচয়িতল সঙ্গম। চেরবন্ডা-র বিদ্রোহ বিপ্লবের দিশা পেল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
জেলে বন্দি থাকাকালীন একদিন রক্তবমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়লে ধরা পড়ে যে ব্রেন ক্যান্সার মারাত্মকভাবে গ্রাস করেছে তাঁকে। রাষ্ট্র ধৈর্য ধরে থাকে, এবং যখন অতি-নিশ্চিত হয় যে চেরবন্ডারর আর বাঁচার আশা নেই, তখনই সেকেন্দ্রাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তাঁর নাম তুলে তাঁকে মুক্ত করে দেওয়া হয়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
চেরবন্ডা রাজু নিরপেক্ষ কবি থেকে যেতে চাননি। কমিউনিস্ট কবি হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। নিষিদ্ধ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র সদস্যপদ নিয়েছিলেন। এটা জেনেই যে তিনি রাষ্ট্রের শত্রু বলে চিহ্নিত হবেন। তাঁর কবিতা ‘কামারশালায় লেগেছে আগুন’ তখন অন্ধ্র জুড়ে ঢেউ তুলছে গান হয়ে। ১৯৭৩-এ তাঁর নামে ওয়ারেন্ট জারি হল, এবং চেরবন্ডা আত্মগোপনে গেলেন। এই সময়েই তাঁর জীবনসঙ্গিনী শ্যামলা প্রথম সন্তানের জন্ম দেন। লুকিয়ে হাসপাতালে সদ্যোজাতকে দেখতে গিয়েই পুলিশের চরের নজরে পড়েন এবং পরদিন গ্রেপ্তার হয়ে যান।
‘আমার চিন্তাধারার উত্তাপ ঝিমিয়ে দেওয়ার জন্য
আমার ছায়াকেও অনুসরণ করে পুলিশ…’
এ কবিতা তাঁর জেলে বসেই লেখা। জেলে বন্দি থাকাকালীন একদিন রক্তবমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়লে ধরা পড়ে যে ব্রেন ক্যান্সার মারাত্মকভাবে গ্রাস করেছে তাঁকে। রাষ্ট্র ধৈর্য ধরে থাকে, এবং যখন অতি-নিশ্চিত হয় যে চেরবন্ডারর আর বাঁচার আশা নেই, তখনই সেকেন্দ্রাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা থেকে তাঁর নাম তুলে তাঁকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। প্রবল দারিদ্র আর ব্রেনে বারবার কাটাছেঁড়া কবির শরীরকে পেরে ফেলেছিল বিছানায়। আর লড়াকু হৃদয় তাঁকে দাঁড় করিয়ে তখনও পৌঁছে দিচ্ছিল মানুষের কাছে কাছে (এমনকী, এই অবস্থাতেও তিনি কলকাতায় এসেছিলেন কালা কানুন বিরোধী কনভেনশনে যোগ দিতে, দেখা করে গিয়েছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে)।
১৯৮২-তে চেরবন্ডা রাজু যখন মারা যান, তখন তিনি জেলে ছিলেন না। তাঁর বুকে পুলিশের গুলিও বেঁধেনি। তবুও তিনি শহিদ! কারণ তাঁর এই অকালমৃত্যু দায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিত করেছিল রাষ্ট্র। পাঁচ হাজারেরও বেশি খেটে খাওয়া মানুষের মিছিল যখন চলেছে বিরসম-এর লাল পতাকায় ঢাকা কবির দেহটিকে নিয়ে, সে মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন কবির অভিন্নহৃদয় বন্ধু গণগায়ক গদর, চেরবন্ডার-ই ‘পাহাড় ভেঙে’ গানটি কণ্ঠে নিয়ে। গোটা মিছিল সে গানে গলা মিলিয়েছে তখন। বিজয়ওয়ারা শহরের সব দোকানপাট সেদিন বন্ধ ছিল।
ভণ্ডামি আর দ্বিচারিতার চূড়ান্ত করেছিল সরকার এরপর। অন্ধ্রপ্রদেশের সাহিত্য আকাদেমি ‘মারো প্রস্থানম’ উপন্যাসটির জন্য আর্থিক পুরস্কারের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল তাঁর জীবনসঙ্গিনী শ্যামলার কাছে। রোদে, ঝড়ে, খিদেয়, বিপদে ঋজু গাছটির মতো টানটান থেকে প্রিয় চেরবন্ডাকে আগলে রাখা, বিপ্লবের পথে সমর্থন জুগিয়ে যাওয়া শ্যামলা সেই একই ঋজুতা নিয়ে বলেছিলেন– ‘আকাদেমি পুরস্কার গ্রহণ করবার অর্থ আমার স্বামীকেই অস্বীকার করা, অপমান করা এবং যে সাধারণ মানুষদের জন্য তিনি লিখেছেন, গেয়েছেন, যাঁরা সব পরিস্থিতিতে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন– তাঁদেরকেও অস্বীকার করা।’
মাকড়শার জালের মতো বিভ্রান্তির স্লোগানের হাওয়ায় উড়ে
আদিম সংস্কৃতির অবাস্তবতার মাঝে
বাস্তব সম্পর্কে চিন্তাহীন উদাসীন দেশদ্রোহীর মতো
বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সে জনগণের সাথে
চরকায় সুতো কাটার সিদ্ধান্তের ঘূর্ণিতে
জনগণকে ঠেলে দিয়ে।
এ দেশ আরও একবার যেন প্রতারিত না হয় ৷
(কবিতাংশটির অনুবাদ কাঞ্চন কুমারের)
…আরও পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ