সবাই উদ্ভ্রান্তের মতো মাঠে দৌড়লাম। এতদিন টিভিতে দেখেছি টুর্নামেন্ট জেতার পর কীভাবে ডাগ আউট থেকে মাঠে দৌড়য়– আজ নিজেরা দৌড়লাম। সবাই পাগলের মতো কাঁদলাম, যে-যাকে পারছে চুমু খাচ্ছি, কাঁদছি, নিজেরাই আনন্দে নিজেদের খিস্তি দিতে দিতে জড়িয়ে ধরছি। কিন্তু সবটা করছি একজনকে ঘিরে। আমাদের ক্যাপ্টেন– যিশুদা।
তখন ২ বলে আর ১৪ রান বাকি। কর্নাটক বুল্ডোজারসের কাঁধ ঝুঁকে গিয়েছে। আর দুটো বল– তারপর আমরা ভারতসেরা! আমার চোখাচোখি হল নীলাঞ্জনাদি, আর ইন্দ্রাশিসের দিকে, সবাইকে ঝাপসা দেখা শুরু হয়ে গিয়েছে। ডাগ আউটে সগি,অনিলাভদা, কাজি, পিন্টুদা কাঁদছে। সারা, জারা কাঁদছে।শুধু বাপ্পাদা এখনও বলছে– এখন চুপ কর। আমরা এখনও জিতিনি। আর দুটো বল, আরও দুটো বৈধ বল। জ্যামি পারবে না? পুরো টুর্নামেন্ট পারল, এই দুটো বল পারবে না? দশ বছর, কিছু দৃশ্য মনে পড়তে লাগল…
দৃশ্য ১
শিলিগুড়িতে খেলা, তেলুগু দলের সঙ্গে, আমাদের বোলার লেগের দিকে বল করল, কিপার ঝাঁপাল বল ওয়াইড হয়ে চার হয়ে গেল। তার থেকেও ভয়ের দৃশ্য, আমাদের কিপার আর উঠল না। উঠল না তো উঠলই না! ভদ্রলোকের এক কথার মতো নিজের পোজে স্থির। এমনকী, স্ট্রেচারে নিজের ঝাঁপানোর পোজের স্টিল শুট করছেন, এমনভাবেই বেরিয়ে এলেন, জড়বৎ মূর্তির মতোই।
দৃশ্য ২
ভোজপুরি দলের সঙ্গে জেতা ম্যাচ ড্র হয়েছে। আমরা মানসিক, শারীরিক– সবরকম জায়গা থেকে ভেঙে পড়েছি। আমাদেরই দলের একজনের গলা পেলাম। সে নিজে যত না বিখ্যাত, তার দিদি অনেক বেশি বিখ্যাত। সে তার এক বন্ধুনীকে ফোন করে নিজের বোলিং ফিগার জানাচ্ছে। টিমের মুড নিয়ে ওর কিছু এসেই জানে না। সেদিন সে ভাল করেছে। সেটাই যথেষ্ট তার কাছে। যিশুদা হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।
দৃশ্য ৩
জেতা ম্যাচ হেরে গিয়েছি। ঘরের মধ্যে যিশুদা পাগলের মতো কাঁদছে। নীলাঞ্জনাদি, আমি, ইন্দ্রাশিস, সগি– কেউ সামলাতে পারছি না।
দৃশ্য ৪
কেরালার সঙ্গে ম্যাচে ধ্বংস হয়ে বাসে করে ফিরছি। একজন ফোন করে অনিলাভদাকে ফোন করে বলেছিল। তোমাদের থিম সং-এর একটা স্যাড ভারসান বানানো উচিত। আমরা বাসে বসে গিলেছিলাম।
দৃশ্য ৫
টালিগঞ্জের মেক আপ রুমে আমরা আওয়াজ খেয়েছি নাম ডোবানোর জন্য…
জ্যামি এতক্ষণে শেষ বলটা করল… আমরা জিতে গেলাম…
সবাই উদ্ভ্রান্তের মতো মাঠে দৌড়লাম। এতদিন টিভিতে দেখেছি টুর্নামেন্ট জেতার পর কীভাবে ডাগ আউট থেকে মাঠে দৌড়য়– আজ নিজেরা দৌড়লাম। সবাই পাগলের মতো কাঁদলাম, যে-যাকে পারছে চুমু খাচ্ছি, কাঁদছি, নিজেরাই আনন্দে নিজেদের খিস্তি দিতে দিতে জড়িয়ে ধরছি। কিন্তু সবটা করছি একজনকে ঘিরে। আমাদের ক্যাপ্টেন– যিশুদা। এই লোকটার জন্যই তো সব! কী করেনি এই শুধু এই একটা দিনের অপেক্ষায়। কাজ ছেড়েছে মুড়ি-মুড়কির মতো। সারারাত কাজ করে ম্যাচ খেলে আবার ফ্লাই করেছে। দিনের পর দিন কেঁদেছে, ভেঙে পড়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। ‘একদিন, আমরা চ্যাম্পিয়ান হব, দেখিস।’ রাত গভীর হলে যিশুদার গলায় শোনেনি এমন বন্ধু খুব কম আছে যিশুদার। আর এই টিম শুধু প্রতিভা আর ডিসিপ্লিনের দিক থেকেই আলাদা নয়। এরা যিশুদাকে ঘিরে দাঁনা বেধেছে।
খুব বড় দুটো উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। আপনাদের মনে হতে পারে বড় বাতেলা দিচ্ছি। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর যদি নিজের টিমকে নিয়ে গর্ব না করতে পারি, তাহলে আর কবে করব বলতে পারেন? ২০১১-তে যেমন ধোনির দলের লক্ষ ছিল সচিনকে ওয়ার্ল্ড কাপ এনে দেওয়ার, বা এবার আর্জেন্টিনা যেভাবে লড়েছে শুধু মেসিকে কেন্দ্র করে, আমাদের দলের নিউক্লিয়াস ছিল যিশুদার মুখে হাসি ফোটানোর।
বাপ্পাদা
এক্স ইন্ডিয়া ক্রিকেটার– শরদিন্দু মুখার্জি, আমাদের কোচ– এই লোকটা দলের মধ্যে এক-সমুদ্র-পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। অ্যাসিস্ট্যান্ট কোচ অংশুমানকে সঙ্গে নিয়ে এমন ট্রেনিং মেথড উনি প্রবর্তন করেছেন এই দলে, যাতে কেউ যদি ৪ ঘণ্টার জন্য ট্রেনিংয়ে আসে, তাহলে তার চার ঘণ্টাই যেন কোনও না কোনও ভাবে ব্যবহৃত হয়। দিনের পর দিন টার্গেট ওরিয়েন্টেড প্র্যাকটিস করিয়েছেন। কোনও নেট সেশন ম্যাচ-সিচুয়েশন ছাড়া শেষ হয়নি।সবচেয়ে বড় কথা, এক দল এক পরিবার সংস্কৃতি তৈরি করেছেন। যদি ১৫ জনের স্কোয়াড হয়, ১৫ জন ১৫ জনের জন্য জান দিয়ে দেবে। আর নিজে সফল ক্রিকেটার বলে দলে আনতে পেরেছেন অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে এক সময় লিখে রাখা সেই কথাটা– ‘you can never win a silver, you can only loose a gold.’
সৌরভ দাস
আমাদের কিপার। এবং নিঃসন্দেহে টুর্নামেন্টের সেরা কিপার। দলের সম্পদ। যে এনার্জি ওকে অভিনেতা হিসেবে আলাদা করে, তার দশগুণ ও মাঠে এনার্জি নিয়ে থাকে। ব্রিলিয়ান্ট রানার। ২০ ওভার কিপিং করে দু’জন মুখ্য ব্যাটারের হয়ে দৌড়ন মানে বুঝতে পারছেন! কিছু ছেলের মধ্যে জন্মগত নেতৃত্বের ক্ষমতা থাকে, সৌরভ তাদের একজন, যা কিপার হিসেবে দলের খুব কাজে লেগেছে।
জ্যামি ব্যানার্জি
নিজেকে ‘বাঘের বাচ্চা’ বলে ডাকে, আর ওর সেই হক আছে। পুরো টুর্নামেন্ট এ সর্বোচ্চ রান স্কোরার, যথেষ্ট সফল বোলার,আউটফিল্ডে দারুণ। তবে ওর ব্যাটিং দেখার মতো, বল সুইং করছে, পিচ স্যাতসেতে– এসব ওকে বোঝাবেন না। ও টার্মিনেটর। বলের কাজ বাউন্ডারিতে যাওয়া আমার কাজ তাকে সেখানে পৌঁছে দেওয়া, শেহবাগ-নীতির ছাত্র আমাদের জ্যামি।
রাহুল মজুমদার
ম্যান অফ দা সিরিজ। বল হাতে, ব্যাট হাতে, আউটফিল্ডে। আজকাল যে থ্রি-ডায়মেনশনাল ক্রিকেটারের কথা হয়, তার আদর্শ উদাহরণ। সিংহের মতো বুকের খাঁচা। ফাইনালে যখন মোমেন্টাম পুরোপুরি কর্ণাটকের দিকে চলে যাচ্ছে, নিজে এগিয়ে গিয়ে যিশুদার কাছে বল চেয়েছে। এবং তারপর ওর ওই ওভারটাই ম্যাচের টার্নিংপয়েন্ট হয়ে যায়। এক মুখ হাসি নিয়ে সিরিজ সেরার প্রাইজ নিতে ও যখন উঠছিল, আমার নিজের ভাই উঠছে এমনই লাগছিল।
স্লো বোলিং কুয়ারটেট
শতদীপ, রত্নদীপ, আনন্দ, উদয়– এরা চারজন পুরো টুর্নামেন্ট দলের ভরসা হয়ে থেকেছে। ভালো দিন সবসময় সবার যায় না। কোনও কোনও দিন কেউ মার খেয়েছে। কিন্তু পরের দিন ঠিক এসে প্ল্যান অনুযায়ী জায়গায় বল করেছে। উদয় এবং রত্নদীপ ব্যাট হাতেও প্রচুর অবদান রেখেছে।
জয় মুখার্জি
আমার চিরকালের রুম পার্টনার। এই টিমের সবচেয়ে পুরনো সৈনিক। দলকে ও যা দিয়েছে, খুব কম মানুষ দিয়েছে। এইবারও ব্যাট হাতে অনবদ্য!
কাকে ছেড়ে দিই বলুন তো! বনি ব্যাট হাতে যখন সুযোগ পেয়েছে অবদান রেখেছে। মাঠে দারুণ ফিল্ডিং করেছে। ইউসুফ ব্যাট হাতে,আউটফিল্ডে দলের অপরিহার্য একজন প্লেয়ার।
সাপোর্ট স্টাফ
আমাদের ছেলেরা পরপর তিনদিন তিনটে টি-২০ খেলেছে। কোয়ালিফায়ার থেকে ফাইনাল অবধি। যেটা কিন্তু আন্তর্জাতিক খেলোয়ারের পক্ষেও যথেষ্ট চাপের! এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র সাপোর্ট স্টাফদের জন্য। কাজি আর পিন্টুদা কাউকে ছেড়ে রাখেনি। প্রত্যেককে নিজের ভাইয়ের মতো করে আগলে রেখেছে। আর ম্যানেজমেন্টে অনিলাভদা আর প্রমিস… কী বলি বলুন তো ওদের নিয়ে? আমাদের প্রত্যেকটা ব্যর্থতার রাত্রের সঙ্গী এরা। এত বড় একটা দল সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। এরা মুখ বুজে, ঘাড় গুঁজে কাজ করে গিয়েছে, শুধু এই দিনটা দেখবে বলে। তাই ওই দু’জনের কান্নার বাঁধ সেদিন ভেঙেছে।
ডাগ আউট
নীলাঞ্জনাদি, সারা, জারা, প্রীতি, দর্শনা, কৌশানী এক মুহূর্তের জন্য অন্য ডাগ আউটকে আমাদের মাথায় চড়তে দেয়নি। বিশেষ করে জারা। যিশুদার ছোটটা। চেঁচিয়ে, নেচে, রেগে গিয়ে। পুরো পকেট সাইজ পটকা! জারা সুনকে ক্লোদিং ব্র্যান্ড সামঝি কিয়া? ফায়ার হ্যাই আপুন! পুরো আল্লু অর্জুন।
শেষ দৃশ্য
যিশুদার ঘরে আমি, বাপ্পাদা, ইন্দ্রাশিস, সগি, নীলাঞ্জনাদি বসে আছি। নিচে পার্টি চলছে। আমরা একটু পরে যাব। সবাই আস্তে আস্তে নিজের হাতের পেগটা শেষ করে পার্টির দিকে রওনা দিল। কেউ তখনও হাসছে, কাঁদছে। ঘরে এখন শুধু আমি আর যিশুদা। যিশুদা আমাকে বলল, ‘আমি অস্কার পেলেও এত আনন্দ হত না রাহুল।’ আমি চুপ করে চুমুক দিলাম, আমি জানি এর চেয়ে বেশি সত্যি খুব কিছু নেই। যিশুদা ভেতরের ঘরের দিকে তাকাল। নীলাঞ্জনাদি ওই ঘরে। আমি নিজেকে চলনসই অভিনেতা মনে করি, তাই কিউ পেতে দেরি হল না। ‘যাই,পার্টিতে যাই’ বলে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। এই দু’জন বড্ড কেঁদেছে, আজ আমাদের ছেলেরা আবার ওদের কাঁদিয়েছে। কিন্তু এবার আনন্দে। থাকুক ওরা, একসঙ্গে আধঘণ্টা থাকুক। পার্টি তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।