কেরলের কোট্টায়াম জেলার গ্রাম ভাইকম। গ্রামের শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল অনাচার। নিচু জাতিকে সেই অনাচারে সামান্য কারণে পদে পদে অপদস্থ করা হত। এমনকী, ভারতের তৎকালীন বিখ্যাত ধর্মসাধক শ্রী নারায়ণগুরুও এই অনাচার থেকে মুক্তি পায়নি। ১৯০৫ সালে ত্রিবাঙ্কুরের রাজসভায় গ্রাম্যপথ ব্যবহারে সকল বর্ণের অধিকারের দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু সামাজিক বিশৃঙ্খলার ভয়ে তখনকার রাজা থিরুনাল ভার্মা নীরব থাকেন।
১৯২৪-এর ৩০ মার্চ। সকালবেলা। কেরালার ভাইকম গ্রামের শিব মন্দিরের সামনে পদযাত্রা করে জড়ো হয়েছে বেশ কিছু মানুষ। উদ্দেশ্য মন্দিরে অনুপ্রবেশ। কারা এরা? এদের মন্দিরে প্রবেশ কি নিষিদ্ধ ছিল? তাই এই সমাবেশ!
ভারতবর্ষের ইতিহাসে বর্ণাশ্রম-নির্ভর সমাজের ইতিহাস দীর্ঘকালীন। তবে বর্ণাশ্রমের আকার প্রদেশ ও অঞ্চলের ভিত্তিতে কিছু-কিছু পার্থক্য দেখা গেছে। সব অঞ্চলে তীব্রতা সমান নয়। আবার এমনও দেখা গেছে, কোনও মন্দির থাকা জনপদে জাতিভেদ অকাট্য নিয়ম হিসেবে বেশি মানা হয়। সেসব ক্ষেত্রে নিচু জাতির লোকেদের বিশেষ বিশেষ পথে চলাচলেও তীব্র বাধানিষেধ ছিল। এর ব্যতিক্রম হলে রক্তপাতও ঘটত। মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের কাছে এই প্রথা ঘৃণ্য মনে হলেও এই প্রথায় অভ্যস্ত লোকজন হয়তো একে মোটেই খারাপ হিসেবে ভাবেনি। তবে এর বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে জনরোষও দেখা গেছে। আর তার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় আর দেশীয় রাজনীতির ওপর।
কেরলের বিভিন্ন স্থানে জাতিভেদ প্রথা ছিল নির্দয়। উচ্চবর্ণের মানুষের ব্যবহৃত সড়ক ব্যবহারের অনুমতিও ছিল না নিচু জাতের মানুষের। এর সামান্য ব্যতিক্রম হলেই নির্মম শাস্তি। কেরলেরই ত্রিবাঙ্কুর ইংরেজ আমলে ‘প্রিন্সলি স্টেট’ বা ‘দেশীয় রাজ্য’ হিসেবে গণ্য হত। কেরলের অন্যান্য স্থানের মতো এখানেও হিন্দু সমাজে কঠোর জাতিভেদ মেনে চলা হত। গ্রাম্য-রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে ‘রাজবিধি’ এবং ‘গ্রামবিধি’ নীতি প্রয়োগ করা হত। আর ‘গ্রামবিধি’র মধ্যেই স্পষ্ট নির্দেশ ছিল– নিচু জাতির মানুষের পথ ব্যবহারে যাবতীয় নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। তাই মন্দিরে যাওয়ার পথ তো দূর, তার আশপাশের পথও ছিল এই ঘৃণ্য আইনের মধ্যে।
কেরলের কোট্টায়াম জেলার গ্রাম ভাইকম। গ্রামের শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল অনাচার। নিচু জাতিকে সেই অনাচারে সামান্য কারণে পদে পদে অপদস্থ করা হত। এমনকী ভারতের তৎকালীন বিখ্যাত ধর্মসাধক শ্রী নারায়ণগুরুও এই অনাচার থেকে মুক্তি পায়নি। ১৯০৫ সালে ত্রিবাঙ্কুরের রাজসভায় গ্রাম্যপথ ব্যবহারে সকল বর্ণের অধিকারের দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু সামাজিক বিশৃঙ্খলার ভয়ে তখনকার রাজা থিরুনাল ভার্মা নীরব থাকেন। কেরলের বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক টি.কে.মাধবন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার চাইলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছিল।
এরপর একই রকমভাবে বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হয়। ১৯২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাধবন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। গান্ধীজি শুনলেন সবই। তিনি তাদের আবেদনের মানবিক দিকটির সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। পরামর্শ দিয়েছিলেন, সময় ও পরিস্থিতি বুঝে কাজ করার। এরপর ১৯২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি কেরলের এর্নাকুলাম শহরে ‘আনটাচেবিলিটি অ্যাবোলিশন কমিটি’ গঠন করা হল। এর সদস্য হলেন টি.কে মাধবন, কে.কেলাপ্পান, কুরুর নম্বুদ্রি, কৃষ্ণস্বামী আইয়ার ও বেলুধ মেনন। সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজপথ ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা লেখা বিলবোর্ড অপসারণের দাবি তোলা হয়। দেখা গেল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কাছে তাদের কার্যক্রম স্থগিত করার আবেদন করলেন। এরপরেই ৩০ তারিখে নিম্নবর্ণেরা পদযাত্রা শুরু করলেন। সংগঠিত জনতা একজোট হয়ে মন্দিরের পথে বিলবোর্ডের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাদের কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল, কোনওরকম সহিংস কর্মকাণ্ডে না জড়াতে। পরনে খাদির কাপড় ও হাতে কংগ্রেসের পতাকা হাতে তারা অগ্রসর হয়েছিল প্রতিবাদ জানাতে। এক সময়ে তাদের থেকে তিনজন সামনে এগিয়ে গেলেন। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হল– উচ্চবর্ণ ছাড়া অন্যান্য বর্ণের লোকজন যেন স্থান ত্যাগ করে। কিন্তু সকলেই একত্রে থাকায় সবাই গ্রেপ্তার হলেন। বিচারে তাদের জরিমানা ও কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সংগঠিত জনতা একজোট হয়ে মন্দিরের পথে বিলবোর্ডের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাদের কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল, কোনওরকম সহিংস কর্মকাণ্ডে না জড়াতে। পরনে খাদির কাপড় ও হাতে কংগ্রেসের পতাকা হাতে তারা অগ্রসর হয়েছিল প্রতিবাদ জানাতে। একসময়ে তাদের থেকে তিনজন সামনে এগিয়ে গেলেন। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হল– উচ্চবর্ণ ছাড়া অন্যান্য বর্ণের লোকজন যেন স্থান ত্যাগ করে। কিন্তু সকলেই একত্রে থাকায় সবাই গ্রেপ্তার হলেন। বিচারে তাদের জরিমানা ও কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এই ঘটনা জনমনে ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। পরিস্থিতি এতটাই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে যে কারণে মহাত্মা গান্ধী আন্দোলন কয়েকদিনের জন্য স্থগিত রাখতে অনুরোধ করেন। এদিকে তাকে কেরলের রক্ষণশীল অভিজাত সমাজের সভ্যগণ আন্দোলন থেকে সমর্থন তুলে নিতে অনুরোধ করছিলেন। তাদের দাবি ছিল, মন্দিরে যাওয়ার পথটি ব্যক্তিগত সম্পত্তির আওতায় পড়ে বলে এই আন্দোলন অযৌক্তিক। ৭ এপ্রিল গ্রেপ্তার হলেন টি.কে.মাধবন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে এই আন্দোলন সারা ভারতে সাড়া ফেলেছিল। ভারতের অন্যান্য স্থানের রাজনীতিবিদরা এই আন্দোলন সমর্থন করলেন। পাঞ্জাবে শিখদের রাজনৈতিক সংগঠন ‘আকালি দল’-এর সদস্যরা সুদূর ভাইকমে এসে আন্দোলনকারীদের জন্য রান্নার ব্যবস্থা করলেন। তবে হিন্দু ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ পরোক্ষভাবে অন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ায় গান্ধীজি এ-পর্যায়ের বিরোধিতা করলেন।
১৪ এপ্রিল। মাদ্রাজ থেকে বিখ্যাত তামিল নেতা পেরিয়ার রামস্বামী এলেন এই আন্দোলনে যোগ দিতে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী নাগাম্মাই। জনসম্মুখে বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষেত্রে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। তা অমান্য করায় তিনি গ্রেপ্তার হলেন। নাগাম্মাই এই আন্দোলনে সাধারণ নারীদের যুক্ত করতে লাগলেন। এর ফলে গান্ধীজি ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবছিলেন, আন্দোলনের পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠতে পারে। তিনি চেয়েছিলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক সমস্যা নিরসনে অন্য সম্প্রদায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত না হোক। এরই মধ্যে ধর্মসাধক শ্রী নারায়ণগুরু ৫ মে আন্দোলনে অংশ নিলেন।
গান্ধীজি এই সময়ে ভেবেছিলেন, যদি উচ্চবর্ণের মহৎ মানুষরা নিম্নবর্ণের সমর্থনে এগিয়ে আসেন, তাহলে তা জনমনে আরও বেশি প্রভাব ফেলবে। তিনি ভাইকম আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করলেন। জানালেন, শুধু উচ্চবর্ণের মানুষের একটি মিছিল যদি নিম্নবর্ণের মানুষের অধিকারের পক্ষে দাবি তোলে, তাহলে তার গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। ১৯২৪ সালের ১ নভেম্বর মান্নাথু পদ্মনাভনের নেতৃত্বে উচ্চবর্ণের ৫০০ জন হিন্দু নেতা এক মিছিল নিয়ে ভাইকমের পথে এগিয়ে গেলেন। সে বছরের ১৩ নভেম্বর উচ্চবর্ণের ২৫ হাজার মানুষের স্বাক্ষর করা এক স্মারকলিপি ত্রিবাঙ্কুরের রানির কাছে পাঠানো হয়েছিল। রানি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ভার, নির্বাহী বিভাগের হাতে ছেড়ে দিলেন। সেখানে নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য ভাইকমের পথ উন্মুক্ত করে দেওয়ার ওপর ভোট অনুষ্ঠিত হল। আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাব ২২-২১ ব্যবধানে হেরে গেল।
এর পরেও গোঁড়াপন্থী উচ্চবর্ণের কিছু লোকের উসকানিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তাদের অহিংস নীতিতে অটল ছিলেন। সারা দেশ তখন অপেক্ষা করছিল ভাইকম আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া দেখতে। অবশেষে আন্দোলনের ফল ধীরে ধীরে কার্যকর হয়ে উঠল। স্থানীয় প্রশাসন নমনীয় হল। মহাত্মা গান্ধী ও আন্দোলনকারীরা সমঝোতার পথে আসতে সম্মত হলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: ‘পুণা চুক্তি’র প্রেত যেন আম্বেদকরের রাস্তা থেকে দলিতকে সরিয়ে দিয়েছে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
১৯২৫ সালের ২৩ নভেম্বর। উচ্চবর্ণ ও অভিজাত সমাজের করা অমানবিক বিধান কিছুটা শিথিল করা হল। ভাইকমের শিবমন্দিরের পূর্বদিকের প্রবেশপথ ছাড়া অন্য সব পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হল নিম্নবর্ণের হিন্দুদের জন্য। ১৯২৫-এর ২৯ নভেম্বর ভাইকম সত্যাগ্রহের বিজয় উদযাপনে বক্তৃতা করার সময়, পেরিয়ার বলেছিলেন: ‘সত্যাগ্রহের উদ্দেশ্য কুকুর এবং শূকরের মতো পশুদের জন্য উন্মুক্ত রাস্তায় প্রবেশাধিকার লাভ করা নয়। কিন্তু জনজীবনে সহ-মানুষের মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকা উচিত নয়। মন্দিরের অভ্যন্তরে সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব যা আমরা এখন রাস্তায় জিতেছি।’
১৯২৮ সালে ত্রিবাঙ্কুরের রানি সব রাস্তা বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে একটি রাজকীয় ঘোষণা জারি করেন। ভাইকম সত্যাগ্রহের পরে ১৯২৬-এ সুসেন্দ্রাম,১৯২৭-এ মায়িলদুথুরাই, ১৯২৯-এ ইরোডে, ১৯৩১-’৩২-এ গুরুভায়ুর এবং মাদুরাই মন্দিরে প্রবেশের আন্দোলন– সবই পরবর্তী প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করাই যায়।
বর্ণহিন্দু-প্রথা ভারতে আর আগের মতো নেই, কিন্তু মন্দিরে ঢোকার পোশাকবিধি এখনও বর্তমান। শতবর্ষ আগে ঘটে যাওয়া সত্যাগ্রহ আন্দোলন সেকালে সকাল আনতে পারলেও, একালে আনবে কে?