তোমরা কথায়-কথায় মিছিল নামাও, সেই তোমরাই তোমাদের স্পেসে কী করছ, থিয়েটারের স্পেসে কী করছ? মহিলাদের ওপর নির্যাতন ফ্যাসিজম নয়? তোমরা সেটার বিরোধিতা তো করলেই না, উল্টে একটা প্রথম সারির খবরের পোর্টাল থেকে সেটার খবরও তুলে দিলে। এটা তো সোজা ভাষায় প্রতিবাদী স্বরের কণ্ঠরোধ। তুমি ক্ষমতা প্রদর্শন করছ নারী শরীরের ওপর, তুমি ক্ষমতা প্রদর্শন করছ সংবাদমাধ্যমের ওপর।
আমি সারাজীবনই চুপচাপ ছিলাম। অনেক হেনস্তার শিকার হয়েছি, যেমন সব মেয়েই হয়ে থাকে। অন্যায় হতে দেখেছি, দেখেছি একটি মেয়ের ওপর নির্যাতন কী অনায়াসে করা যায়! তবুও চুপই ছিলাম। ভেবেছিলাম নিজেকে গোছানোটাই আমার একমাত্র কাজ। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করে কিছু হবে না আদতে। অন্যায় করেছে, কিছু বলিনি। অন্যায় করে পার পেয়ে গেছে, কিছু বলিনি। অন্যায় করে লোককে ভুলিয়ে দিয়েছে, তবুও কিছু বলিনি। লোকে ভুলে যাওয়ার পর আবারও সেই অন্যায় করেছে, কিছু বলিনি। কিন্তু এখন যখন সেই অন্যায়টা নিয়ে হাসাহাসি করছে, সামাজিকভাবে মশকরা করছে, ভেংচাচ্ছে, যে মেয়েরা কষ্ট পাচ্ছে, যারা ভিক্টিম, যারা ট্রমাটাইজড, তাদের ব্যঙ্গ করছে, তখন আর চুপ করে থাকা যায় না।
সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে যৌন-হেনস্তাকারী সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের স্বমহিমায় ফিরে আসা এবং তাকে উদযাপন করা মেনে নেওয়া গেল না। মেনে নেওয়া গেল না নির্দেশক সুমন মুখোপাধ্যায়ের এই বিষয়ে চুপ করে থাকা। এটাও মেনে নেওয়া গেল না, যখন আমি সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ায় সুমন মুখোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করলাম, এবং সেটা নিয়ে একটি প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমের পোর্টালে খবর হল, এবং সেই খবরটাকে ক্ষমতা প্রদর্শন করে নামিয়ে নেওয়া।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ঋতুকালীন সবেতন ছুটি মহিলাদের উৎপাদনমূলক শ্রমেরই অংশ
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অনেক দিন ধরে এটা চলে আসছে। নারী শরীরের ওপর অত্যাচার, নারী শরীরকে যুদ্ধক্ষেত্র বানানোর প্রয়াস আজকের নয়। আমি আজকের মেয়ে হয়ে কী করতে পারি? কীভাবে পারি আজন্মলালিত এই হিংসার প্রতিবাদ করতে? অনেক দিন আমি চুপ ছিলাম। হয়তো সারাজীবনই আমি চুপ ছিলাম। নিজের সন্তানের কাস্টডি যখন পাই আমি, হাতে ৬৩৭ টাকা পড়ে। জানতাম না মেয়েকে খাওয়াব কীভাবে? ফলে নিজেকে গোছানো ছিল আমার প্রধান দায়িত্ব। নিজের অতীতের অত্যাচারগুলোকে, ট্রমাগুলোকে কীভাবে পেরিয়ে আমি জীবনে ফিরব, যে জীবনে আমার একটি সন্তান রয়েছে, সেটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। আমি সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ছুটছিলাম যতটা দ্রুত সম্ভব। অনেক দূরে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম এসবের থেকে। মেয়েকে কী বলতাম আমি? তোমার দিদার সঙ্গে এটা হয়েছে, তোমার মায়ের সঙ্গে এটা হয়েছে। এটা হয়েই থাকে? পারব না মেয়েকে এই শিক্ষা দিতে। আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ দুনিয়াটাকে সাজানো-গোছানো আমার দায়িত্ব। আমি মেয়েকে একটা সুস্থ জীবন, সুস্থ সমাজ উপহার দিতে চাই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সমকামিতার স্পন্দনকে ভূপেন খাকর অনুবাদ করেছিলেন ক্যানভাসে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তাই চিৎকার করতেই হল। চিৎকার করে বলতেই হল মেয়েদের সঙ্গে দিনের পর দিন কোন অন্যায় হয়ে চলেছে। বাংলা থিয়েটারের অন্দরমহলে কী ধরনের চর্চা চলে। থিয়েটার শরীর-সর্বস্ব একটা কাজ। সেখানে মেয়েদের শরীরগুলোই আর নিরাপদ নয়। এখানে মেয়েদের শরীর নির্যাতিত হয়। এটাই সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা বেসিক হিউম্যান কনসার্ন। উত্তর পাব না জেনেই সর্বসমক্ষে পোস্ট করা। কারণ লালদা শিল্প নিয়ে তার কমপ্যাশন ব্যক্ত করছে, কিন্তু শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর প্রতি তার কনসার্ন নেই। সুমন মুখোপাধ্যায় কিন্তু জানে আমি সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি, জানে আমি চুপ করছি না কোনওভাবেই, সেটা জেনেই ‘ছোটোলোক’-এ আমার কাজের প্রশংসা করেছে, যাতে আমি চুপ করে যাই, অন্তত আমার তাই ধারণা। লালদা কেন প্রশংসা করেছে, সেটার উদ্দেশ্য কারওরই জানার কথা নয়, তবে হয়তো সবাই বুঝতে পারছে।
আমার এই প্রতিবাদ লালদার জন্য নয়। এটা সবার জন্য, যাঁরা ওই পোস্ট পড়েছেন বা পড়ছেন। তাদের বুঝিয়ে দিতে চাই থিয়েটারের জগৎটাকে শুদ্ধ, বিচ্ছিন্ন এবং স্বর্গীয় পীঠস্থান ভাবা বন্ধ করতে হবে। এটা শুধুমাত্র লালদা বা সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাপার নয়। যাঁরা এই লেখা পড়ছেন তাঁরা জানুন যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, তার বিরুদ্ধে কথা বলা অসম্ভব নয়। সেটা করা যায়। কে এটা নিয়ে কথা বলছে বা বলছে না, তাদেরও দোষারোপ করা নয়, বরং তাদেরও পাশে চাওয়া। অন্যায়ের বিরুদ্ধ স্বর যেন সমবেত হয়, স্পর্ধার হয়।
চোখের সামনে অন্যায়টা দেখেও চুপ করে থাকা অন্যায়। অন্যায় সেটা, যখন অন্যায়কারীর প্রশংসা করা হয়। বলা হয় ‘লালদা ইজ আ জিনিয়াস’। নিশ্চয়ই আমি মানি লালদা জিনিয়াস, এ বিষয়ে সন্দেহই নেই। এরাই তো আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে, লাথ মেরে ভেঙে দিতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে প্রতিবাদ কীভাবে জোরালো হয়। আমি তার শেখানো পথেই তাকে প্রশ্ন করছি, প্রতিবাদ করছি। এটা গুরুমারা বিদ্যে। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত লালদা। কিন্তু তুমি আজ আমার শিড়দাঁড়া ভাঙতে চাইছ কেন? জ্বলেপুড়ে গেছে ভেতরটা আমাদের লালদা। তোমাকে সংগত একটা প্রশ্ন করেছি। তোমরা তো আমাদের চাকর করে রেখেছ, তোমরা তো তোমাদের অনুষ্ঠানে আমাদের চা দিতে ডাকো, আমাদের তো থালি গার্ল করে রেখেছ, তবুও কিছু বলিনি। তা বলে বুক বাজাবে? আমি শুধু চাই, আমরা শুধু চাই বাংলা থিয়েটারের দুনিয়া থেকে মহিলাদের ওপর শারীরিক মানসিক অত্যাচার বন্ধ হোক, হেনস্তা বন্ধ হোক, নির্যাতন বন্ধ হোক, শ্লীলতাহানি বন্ধ হোক, ধর্ষণ বন্ধ হোক, নিরাপত্তা দেওয়া হোক, সম্মান দেওয়া হোক, সমান ভাবা হোক।
তিতাস, তৃণা, শ্রুতি, মোম, অ্যাঞ্জেলা, রাজেশ্বরী, নবদ্বীপা, শতাক্ষী– এরা তো আজ থেকে বলছে না। কবে থেকে এরা বলে যাচ্ছে, প্রতিবাদ করে যাচ্ছে, নিরাপত্তা চেয়ে যাচ্ছে। আমি কোনও দিন এর মধ্যে পড়িনি। লজ্জায় রাতে ঘুমতে পারিনি। নিজেকে বলেছি– বেণী, এর মধ্যে ঢুকলে হবে না। নিজেকে সরাও। কিন্তু তার পরেও পারলাম না থেমে যেতে। আজ যেটা হচ্ছে, যে ক্যাওস তৈরি হয়েছে, এটা চেয়েছিলাম হোক। চেয়েছিলাম যাতে লোকের কান ফেটে যাক এই চিৎকার শুনে।
আমি নিজে খুব সুবিধার মানুষ নই। অনেক সময় নিজেকে বাঁচিয়ে সরে গেছি আমি। তার পরেও আজ বললাম আমি। তাহলে বুঝতে হবে, আমার মতো একটা লোক বলছে মানে, সত্যিই কোথাও বড়সড় গন্ডগোল হয়েছে। পিপল শুড বি রিয়ালি ওয়ারিড।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তিতাস, তৃণা, শ্রুতি, মোম, অ্যাঞ্জেলা, রাজেশ্বরী, নবদ্বীপা, শতাক্ষী– এরা তো আজ থেকে বলছে না। কবে থেকে এরা বলে যাচ্ছে, প্রতিবাদ করে যাচ্ছে, নিরাপত্তা চেয়ে যাচ্ছে। আমি কোনও দিন এর মধ্যে পড়িনি। লজ্জায় রাতে ঘুমতে পারিনি। নিজেকে বলেছি– বেণী, এর মধ্যে ঢুকলে হবে না। নিজেকে সরাও। কিন্তু তার পরেও পারলাম না থেমে যেতে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তোমরা সাম্রাজ্যবিরোধী, তোমরা ফ্যাসিবিরোধী, তোমরা কথায়-কথায় মিছিল নামাও, সেই তোমরাই তোমাদের স্পেসে কী করছ, থিয়েটারের স্পেসে কী করছ? মহিলাদের ওপর নির্যাতন ফ্যাসিজম নয়? তোমরা সেটার বিরোধিতা তো করলেই না, উল্টে একটা প্রথম সারির খবরের পোর্টাল থেকে সেটার খবরও তুলে দিলে। এটা তো সোজা ভাষায় প্রতিবাদী স্বরের কণ্ঠরোধ। তুমি ক্ষমতা প্রদর্শন করছ নারী শরীরের ওপর, তুমি ক্ষমতা প্রদর্শন করছ সংবাদমাধ্যমের ওপর। এটা হুলিগানিজম। তোমরা মমতাশঙ্করের মহিলাদের নিয়ে কুৎসিত মন্তব্যটা পোর্টাল থেকে নামানোর কথা বললে না কোনও দিন। ওটা রয়ে গেল। ওটা তোমাদের চিন্তায় ফেলল না। চিন্তায় ফেলল আমার একটা সাধারণ প্রশ্ন, যেটা আমি তোমাকে সরাসরি করেছিলাম সোশ্যাল মিডিয়াতে। পোর্টাল থেকে খবরটা সরিয়ে কোনও লাভ হল না। প্রশ্নটা সোশ্যাল মিডিয়াতে রয়েছে। যেটা চেয়েছিলে, তার ঠিক উল্টোটা হল। সবাই জানল, আমি যা বলেছি, তার প্রতিটি শব্দ সত্যি, তাই তোমরা ভয় পেয়ে গেলে।
নারী শরীরের ওপর কে কতটা শক্তি কায়েম করতে পারল, তার ওপর পৌরুষ নির্ধারিত হয়। সেটার ওপর বিচার করা হয় শক্তি কার হাতে, ক্ষমতা কার হাতে। ইতিহাস জুড়ে আমরা এটাই দেখে আসছি। তাই আমার আর ভয় নেই। এই যুদ্ধ করতে আমি রাজি। আমরা রাজি।
এটাকে ‘নারীবাদী ইস্যু’ বলে অনেকেই সরে থাকবে, জানি। কিন্তু সহজভাবে বললে, আমার এই বার্তা আগামী দিনের ছেলেদের জন্যও। যারা এখন সদ্য যুবক। তারাও কিন্তু এই স্পেসে সেফ নয়। এমনকী, শিশুরাও না। ফলে এটা আর শুধু নারীবাদী ইস্যু বলে সরিয়ে রাখবেন না আপনারা। মাথা ঘামান না।
আমার এই প্রতিবাদ, আমাদের এই প্রতিবাদ শুধু লালদার বিরুদ্ধে নয়, শুধু সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, শুধু রাজা ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে নয়। আমার আন্দোলন এই গোটা রেপ-কালচারটার বিরুদ্ধে। আমাকে সবাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, সেলাম জানাচ্ছে, ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এগুলো আমার একটুও দরকার নেই। আমার দরকার এই রেপ-কালচারকে সম্পূর্ণ বিনাশ। তার জন্য আমার দরকার আকাশ-ফাটানো চিৎকার। যাতে পরের বার এই ঘটনাটা ঘটানোর সাহস কেউ করতে না পারে। আসলে এটা তো একটা আনঅর্গানাইজড একটা সেক্টর। এখানে ফলস্বরূপ কিছু হয় না। এই পারপিট্রেটাররা কিন্তু চাকরিতে ফিরে যেতে পারেনি। কিন্তু থিয়েটারে ফিরে আসতে পেরেছে। এদের শুধু ভয় কেচ্ছায়।
আনঅর্গানাইজড সেক্টরে হেল্প ডেস্ক, বোর্ড, সেক্সুয়াল অফেন্সের বিরুদ্ধে যেন একটা কমপ্লেন ঠোকার জায়গা তৈরি হয়। আপাতত এটুকু চাহিদা আমাদের।
পাশাপাশি এ-ও বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমুখে যেমন অনেকে নতুন বউঠানের মিল খুঁজে পান, তেমনই কারও চোখে সেখানে উদ্ভাসিত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আদল। এই দ্বিতীয় মতে, চিত্রী রবি ঠাকুরের চোখে ওকাম্পোর ছায়া নিঃসন্দেহে আরও প্রবলতর, কারণ নতুন বউঠান সেখানে দূর গ্রহান্তরের বাসিন্দা।