আমাদের শৈশবে অনেক বাবাই সদ্যোজাত বাচ্চার জন্য রাত জেগেছেন, কাঁথা পাল্টেছেন, ভীরু ও অপটু মায়েদের একটাও কথা না শুনিয়ে বাচ্চার ঢেঁকুর তুলিয়েছেন, তেল মালিশ করেছেন, বড় হলে জুতোর ফিতে বাঁধার মতো সমান দক্ষতায় বিনুনিও বেঁধে দিয়েছেন। লিঙ্গসাম্য বা ‘শেয়ার্ড রেস্পন্সিবিলিটি’র মতো গেরেম্ভারি শব্দ না জেনেও এসব তাঁরা করেছেন স্নেহ বুভুক্ষায়।
রবীন্দ্রনাথ কোনও পিতৃত্বকালীন ছুটি পাননি!
এরকম একটা জব্বর নামের ওয়েব সিরিজ বানানোই যেতে পারে। এবং তাতে খুব কষ্টকল্পনার আশ্রয় নিতেও হবে না। পিতা দেবেন্দ্রনাথ যেখানে সন্তানদের কাছে ছিলেন সুদূর গ্রহের জীব, বছরের বেশির ভাগ সময়েই কেটে যেত হিমালয়ে, ছেলেমেয়েদের ডেকে ক্বচিৎ কখনও খোঁজখবর করতে পারলেই পিতার কর্তব্য সারা হত, রবীন্দ্রনাথের সময়ে এসে দেখছি, ‘পিতা’ মঞ্চ থেকে অনেকটাই নেমে এসেছেন, সন্তানের যত্ন নেওয়া মোটেও আর নিছক মেয়েলি, মায়ের কাজ থাকছে না।
স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখছেন–
‘কাল সমস্তক্ষণ বেলার শৈশব স্মৃতি মনে পড়ছিল। তাকে কত যত্নে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছিলাম। যখন সে তাকিয়াগুলোর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে কী রকম দৌরাত্ম্য করত– সমবয়সী ছোট ছেলে পেলেই কী রকম হুংকার দিয়ে তার ওপর গিয়ে পড়ত– কী রকম লোভী অথচ ভালমানুষ ছিল। আমি ওকে নিজে পার্ক স্ট্রিটের স্নান করিয়ে দিতুম– দার্জিলিংয়ে রাত্রে উঠিয়ে উঠিয়ে দুধ গরম করে খাওয়াতুম– যে সময় ওর প্রতি সেই প্রথম স্নেহের সঞ্চার হয়েছিল, সেই সব কথা বারবার মনে উদয় হয়।’
জানি না, রণবীর সিং তাঁদের সন্তানের জন্য এসব করবেন কি না, তবে আপাতত দেশ তোলপাড় তাঁর পিতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়ার ইচ্ছেতে। আরেক রণবীর, রণবীর কাপুর বলেছেন, ‘আমার শুট করতে ইচ্ছে করে না, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না, সারাদিন মনে হয় ওকে দেখি, রাহার সঙ্গে খেলি। আগে কখনও এমন মনে হয়নি।’
ভারতে ২০১৭ সালের ‘প্যাটারনিটি বেনিফিট অ্যাক্ট’ অনুসারে, বাবারা ১৫ দিন পর্যন্ত পিতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকারী। সন্তানের জন্ম বা দত্তক নেওয়ার তারিখ থেকে তিন মাসের মধ্যে এই ছুটি নেওয়া যেতে পারে, নব্য বাবার পছন্দ এবং নিয়োগকর্তার নীতি অনুযায়ী। এবং তা সবেতন।
ভারতে পিতৃত্বকালীন ছুটি অবশ্য সরকারি কর্মীদের জন্য। বেসরকারি সেক্টরের কর্মীদের জন্য পিতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু যুগের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু বেসরকারি সংস্থা এই সুবিধে চালু করেছে। যেমন– ‘টাটা’, ‘স্টারবাকস’, ‘ডিয়াজিও ইন্ডিয়া’, ‘জোমাটো’। ‘জোমাটো’ নতুন বাবাদের ২৬ সপ্তাহের পিতৃত্বকালীন ছুটি দিচ্ছে। ‘নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া’ও দীর্ঘ পিতৃত্বকালীন ছুটি দেয়। ফেসবুক তার পুরুষকর্মীদের ৮ সপ্তাহ (২ মাস) পিতৃত্বকালীন ছুটি দেয়। ‘মাইক্রোসফ্ট ইন্ডিয়া’ দেয় ৬ সপ্তাহের ছুটি। ‘সেলসফোর্স ইন্ডিয়া’, নতুন বাবা, যারা সেকেন্ডারি কেয়ার গিভার তাদের জন্য তিন মাসের বরাদ্দ করেছে।
এই সংস্থাগুলির নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এগুলি সবই নিউ এজ কোম্পানি। কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতিতে ইতিবাচক প্রভাব আনার লক্ষে এদের ম্যানেজমেন্ট হায়ারার্কি অনেকটাই ভাঙতে চেয়েছে বা পেরেছে। যেটা পিতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার একটা উদ্দেশ্য। এই ছুটির মেসেজ হল– সন্তানপালন একটা যৌথ দায়িত্ব, পুরুষ টাকা আনবে এবং নারী সন্তান ধারণ ও পালন করবে– এই ক্লিশে চিন্তা থেকে বেরনোর সময় অনেক আগেই এসে গেছে। বাচ্চাকে খাওয়ানো, স্নান করানো, ডায়াপার বদলানো, অসুখে রাত-জাগা– এগুলো মা-বাবা দু’জনেরই কাজ। এই জন্য বাবারাও মায়ের মতো ছুটির হকদার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভারতে পিতৃত্বকালীন ছুটি অবশ্য সরকারি কর্মীদের জন্য। বেসরকারি সেক্টরের কর্মীদের জন্য পিতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু যুগের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু বেসরকারি সংস্থা এই সুবিধে চালু করেছে। যেমন– ‘টাটা’, ‘স্টারবাকস’, ‘ডিয়াজিও ইন্ডিয়া’, ‘জোমাটো’। ‘জোমাটো’ নতুন বাবাদের ২৬ সপ্তাহের পিতৃত্বকালীন ছুটি দিচ্ছে। ‘নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া’ও দীর্ঘ পিতৃত্বকালীন ছুটি দেয়। ফেসবুক তার পুরুষকর্মীদের ৮ সপ্তাহ (২ মাস) পিতৃত্বকালীন ছুটি দেয়। ‘মাইক্রোসফ্ট ইন্ডিয়া’ দেয় ৬ সপ্তাহের ছুটি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তাছাড়া সন্তান জন্মের পর মায়েদের অফিস যেতে না পারা, চেহারার পরিবর্তন– এইসব নানা কারণে অনেক সময়ই গভীর অবসাদের মধ্য দিয়ে যান। একে বলা হয় ‘পোস্টনাটাল ডিপ্রেশন’ বা ‘বেবি ব্লুজ’। সেই সময়ে তাদের পাশে স্বামী বা পার্টনারের থাকা খুব জরুরি। বাবারা ছুটি পেলে সেই কাজটা সহজ হয়, মায়েরাও অল্প অল্প করে কাজে ফিরতে পারেন, গড়ে ওঠে বাবা মা আর বাচ্চার বন্ধন, আর সবচেয়ে বড় কথা লিঙ্গসাম্যের দিকে একটা বড় পদক্ষেপ এই পিতৃত্ব ছুটি।
আমরা বুঝতে পারি না, বাবাদেরও বাচ্চাকে ফেলে কাজে যেতে খারাপ লাগতে পারে। তাদের মন কেমন করতে পারে, তাদের বুকের মধ্যে লুকনো কান্না থাকতে পারে, রহমতের সেই ময়লা কাগজে মেয়ের হাতের ছোপের মতো।
শরৎ কুমারী চৌধুরানীর ‘সোনার ঝিনুক’-এ নতুন পোয়াতি মায়ার দুর্ভাবনা হয়েছিল তার ছেলে হলে কি তার স্বামী বরদাবাবু বাইরের ঘরে শোবে? ছেলে কাঁদলে কি তাঁর ঘুমের অসুবিধে হবে? তার এই প্রশ্নেই বোঝা যাচ্ছে সন্তান পালনের দায়িত্ব মায়ের– এটাই ঠিক করে দিয়েছে সমাজ। এর উত্তরে বরদাবাবু যা বলেছিলেন তাতে কিন্তু সমাজ বদলের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
‘… আমি কি আমার সন্তানের কান্নার জন্যে বিরক্ত হয়ে তোমাকে একলা ফেলে পাশের ঘরে আরাম করে শুতে যাব? না না আমাকে তেমন স্বার্থপর ভেবো না। তুমি ছেলেমানুষ, তুমি যা না পারবে, তা আমি করব।’
কিন্তু ছুটি নিয়ে বাচ্চার দেখাশোনা করবে স্বামী– এটাও কখনও কখনও অসহ্য লাগতে পারে স্ত্রী’র।
‘এত ছুটি যে কেন থাকে অফিস আর স্কুলের– যূথিকা বুঝতে পারে না। না থাকত ছুটি আজ, মেয়ে নিয়ে অত ঘটাপটা করে আদিখ্যেতা করার অবসর জুটত না হিমাংশুর। …ওদিকে, ফাঁকা উঠোনে শীতের রোদ্দুরে, বালতিতে ঠাণ্ডা-গরম জল মিশিয়ে হিমাংশু তরল সাবানের ফেনা দিয়ে পুতুলের চুল ঘষে দেয়, পা-হাত রবারের স্পঞ্জ দিয়ে রগড়ে তেল উঠিয়ে ধবধবে করে, অলিভঅয়েল মাখায়।’ (আত্মজা, বিমল কর)
এ গল্প যদিও এক ভয়ানক পরিণতির দিকে নিয়ে যায় আমাদের।
সে কথা থাক। বরং মনে পড়লে ভালো লাগে, আমাদের শৈশবে অনেক বাবাই সদ্যোজাত বাচ্চার জন্য রাত জেগেছেন, কাঁথা পাল্টেছেন, ভীরু ও অপটু মায়েদের একটাও কথা না শুনিয়ে বাচ্চার ঢেঁকুর তুলিয়েছেন, তেল মালিশ করেছেন, বড় হলে জুতোর ফিতে বাঁধার মতো সমান দক্ষতায় বিনুনিও বেঁধে দিয়েছেন। লিঙ্গসাম্য বা ‘শেয়ার্ড রেস্পন্সিবিলিটি’র মতো গেরেম্ভারি শব্দ না জেনেও এসব তাঁরা করেছেন স্নেহ বুভুক্ষায়। আসলে পিতৃতন্ত্র মেয়েদের মতো ছেলেদেরও ছাঁচে ঢেলে ফেলেছে যে। ছেলেদের স্নেহ প্রকাশ করতে নেই, কাঁদতে নেই। বাচ্চার কাঁথা ছাদে মেলতে গিয়ে কত পুরুষ মানুষ সমাজের কাছে উপহাসের পাত্র হয়েছেন। তবু চুপচাপ নিজের কাজ করে গিয়েছেন হৃদয়ের তাগিদে।
রবীন্দ্রনাথের মতো, এইসব অনামী, সাধারণ বাবারাও কোনও পিতৃত্বকালীন ছুটি পাননি কোনও দিন।