আমাদের মতো বৃদ্ধ, যাদের বয়স অনেক, এবং অনেকে আমাদের ‘ইতিহাসের সাক্ষী’ বলে মনে করে, তারা সাধারণভাবে এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হই। আগে কি এরকম ছিল? এই অসৌজন্য, এই অপমানজনক, কখনও হিংস্র ভাষা। আমরা বলি যে, আগে কী ছিল, তা বলা খুব সহজ নয়। রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিলোপের উদ্যোগ নিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল রক্ষণশীল সমাজপতিরা, মৃত্যুকামনা তো তার আবশ্যিক উপাদান। প্যারীচরণ সরকার বারাসতে মেয়েদের স্কুল বসানোতে তাঁকেও হত্যা করতে লাঠিয়াল পাঠিয়েছিল জমিদাররা। গালাগাল তো সে তুলনায় নস্যি। আমরা বেশিরভাগ নির্বাচন দেখেছি বা সে সবের খবর পেয়েছি মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমে। সেখানে সব গালাগাল বা কটূক্তি হয়তো আমাদের কাছে পৌঁছয়নি।
‘Verbal violence’ বা ভাষা-সন্ত্রাস (বা ভাষা-হিংস্রতা) একটা গুরুগম্ভীর পরিভাষা– এ কথাটার সোজা মানে হল গালাগাল। ভাষা দিয়ে আমরা বহু কাজ করি, যেমন প্রেম নিবেদন, শিশুকে আদর, সন্তানদের শাসন, দোকানে-বাজারে দরাদরি, মাঠে নিজের দলের খেলোয়াড়দের উৎসাহদান, থিয়েটারে দুর্বল অভিনয়কে ‘আওয়াজ’ দেওয়া ইত্যাদি। গালাগাল সেইরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটা ভালো না মন্দ, সে বিচারে আসার আগে বলা ভালো– যেটা সকলের জানা কথা– যে আমরা সাধারণ মানুষেরা একা বা দলে পড়ে সকলেই কখনও-না-কখনও গালাগাল দিই। বিনিময়ে গালাগাল খাইও বটে। পৃথিবীর সব ভাষার মানুষ। এবং বেশিরভাগ ভাষা-কাজের মতোই গালাগাল দ্বিপাক্ষিক। অর্থাৎ, এক পক্ষ গালাগাল দেয় অন্য এক পক্ষকে। এমন সম্ভাবনা প্রায়ই থেকে যায় যে, যে পক্ষ সে গালাগাল ফিরিয়ে দেবে।
অবশ্যই গালাগালের ক্ষেত্রেও, সংঘটিত অপরাধের মতোই, একটা সালিশি বা arbitration-এর সুযোগও থাকে। যেমন, ইশকুলে একটি ছেলেকে কেউ গালাগাল দিল, সে স্যর বা ম্যাডামের কাছে গিয়ে নালিশ করল, স্যর বা ম্যাডাম গালাগালের গুরুত্ব বুঝে অপরাধীকে শাস্তি দিলেন বা বললেন, ‘খবরদার, আর যেন এই নালিশ না শুনি!’ সামাজিক প্রকাশ্য গালাগালেও সালিশি হতেই পারে, সেটা আমরা পরে– নির্বাচনিক গালাগালের বিচার উপলক্ষে খানিকটা বিস্তারিতভাবেই বুঝে নেব। এই লাইনটা লিখতে গিয়েই চোখে পড়ল যে ‘নির্বাচন’ কথাটার মধ্যে লুকিয়ে আছে ‘বাচন’ কথাটা। যার উৎপত্তি ‘বাক্’ থেকে, আর গালাগাল হল বাক্ বা বাচনেরই এক অঙ্গ। জানি না, বাগ্দেবী সরস্বতী গালাগালেরও দেবী কি না!
আমরা সেইসব উৎসবের কথা শুধু ছুঁয়ে যাব, যেগুলোতে গালাগাল একটা উৎসব বা অনুষ্ঠানের (ritual) অঙ্গ। সেখানে গালাগাল শুনে কেউ কিছু মনে করে না। আপনারা প্রায়ই দেখবেন, যখন কিছু শ্রমিক দল বেঁধে একটা ভারী কাজে হাত লাগায়, এবং কয়েকটা ধাক্কায় বা খেপে সে কাজটা সমাধা করতে হয়, তখন ‘মারো জোয়ান, হেঁইয়ো’, ‘আউর থোড়া হেঁইয়ো’, ‘বাঁয়া সামহালকে, হেঁইয়ো, ‘ডাহিন বাঁচাকে, হেঁইয়ো’ ইত্যাদি সমবেত শীৎকার উঠতে থাকে, তখন কন্ট্রাক্টর বা মালিকের নাম না করে তাঁদের বাড়ির মহিলাদের সম্বন্ধে অশ্রাব্য ও যৌন ইচ্ছাপূরক নানা শব্দ সেই স্লোগানগুলোর সঙ্গে মিশে যায়। ভদ্রলোকের তা শুনে কানে হাত দিয়ে পালানোর কথা, কিন্তু এই যৌথ শ্রমকৃত্যের প্রতিবেশে এ বিষয়ে কন্ট্রাক্টর বা মালিকেরা কেউ গা করে না। এগুলো খানিকটা পুজোর মন্ত্রের মহিমা পায়। এই রকম ঘটে উত্তর ভারতে দোলের সময়। শুনেছি, সেখানেও রংখেলা উপলক্ষে সমাজের নানা ওপরওয়ালাদের প্রচুর গালাগাল করা হয়, এবং তারাও সেটা অবিচলিতভাবে সহ্য করে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রাক্তন বিচারক অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ‘মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে’ বলে একটি অবাঞ্ছিত উক্তি করেছেন, তার ফলে তৃণমূল দলের মর্মাঘাত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে এবং তাঁরা নিজেদের বিতৃষ্ণা ও বেদনায় দিশাহারা হয়ে জনতার দরবার থেকে কমিশনের দরজা পর্যন্ত ছোটাছুটি করছেন। এটা ঠিকই, শ্রীগঙ্গোপাধ্যায় ব্যক্তিনাম উল্লেখ করে ‘মৃত্যু’প্রসঙ্গ এনে অনুচিত কাজ করেছেন, তার ব্যাখ্যা যাই দিন তিনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
না, সাধারণ সামাজিক গালাগাল, এবং নির্বাচন উপলক্ষে গোষ্ঠীর গালাগাল এই ধরনের ‘পবিত্র আনুষ্ঠানিকতা’ মাত্র নয়। তা রীতিমতো গায়ে জ্বালা ধরায়, এবং হয় প্রতি-গালাগাল না হয় সালিশ-নালিশ আমন্ত্রণ করে। নির্বাচন এলেই যা ঘটে। ফলে একটি ফরমুলার আকারে গালাগালের সামাজিক সংগঠনকে হয়তো এইভাবে দেখানো যেতে পারে–
পক্ষ ১-এর গালাগাল >>><<<পক্ষ ২-এর প্রতিগালাগাল এবং এই চক্রের পুনরাবৃত্তি, অথবা বিকল্পে পক্ষ ১-এর গালাগাল >>> পক্ষ ২-এর সালিশ-দরবার। সালিশ সার্থক ও বলশালী হলে গালাগাল বন্ধ, না হলে গালাগাল-চক্রের পুনরাবৃত্তি।
২.
এখন গালাগালের পিছনে যে মনস্তত্ত্ব আছে, তা এখন সকলেরই জানা। গালাগাল দিই আমরা অন্যের ওপরে, সত্য না হোক, একটা সাময়িক ও মানসিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। গালাগালের নানা ধরন আছে। আত্মবিজ্ঞাপন দিয়ে বলি যে, এ নিয়ে সম্ভবত বাংলাভাষায় প্রথম আমরাই আলোচনা করেছি। আমাদের তা নিয়ে বড় পরিসরে আলোচনাও আছে, আগ্রহী পাঠক আমাদের ‘লোক, ভাষা, সংস্কৃতি নন্দনতত্ত্ব’ বইটি দেখতে পারেন। সেখানে আমরা খিস্তি, গালাগাল ইত্যাদির তাত্ত্বিক পার্থক্য করে দেখিয়েছি যে, গালাগালের প্রধান দু’-তিনটি ধরন এইরকম–
১. আরোপমূলক: প্রতিপক্ষকে নানাবিধ পশুপাখির শ্রেণিতে ফেলা– গোরু, ছাগল, শূকর, শকুন ইত্যাদি। কখনও অবৈধ সম্পর্কজনিত জন্মের অধীন করা।
২. বক্তার ইচ্ছাপূরক: প্রতিপক্ষের সর্বনাশ, মৃত্যু ইত্যাদি (‘তেরাত্তির যেন না পোহায়’ গোছের)।
৩. প্রতিপক্ষের অগৌরবের ইতিহাসকে সামনে আনা– যেমন প্রতিপক্ষেরা মুখ্যমন্ত্রীর নন্দীগ্রামে পরাজয়ের কথা বা সিঙ্গুরে টাটাদের বিতাড়নের কথা যেমন বলছেন, তেমনই সৌগত রায়, সুজন চক্রবর্তীর ২৬ হাজার ভোটে হেরে যাওয়ার কথা বলছেন। এগুলো ঠিক গালাগাল নয়, কিন্তু প্রতিপক্ষের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এবং প্রতিপক্ষের তুলনায় নিজের গৌরব জাহিরের একটা উপায় তো বটেই। গালাগালের একটা উদ্দেশ্যও তাই।
আপাতত এই তিন ধরনের উক্তি-প্রত্যুক্তিই খুব চলছে। সভায় বলা হচ্ছে, ভিডিও বা টেলিফোন-সংলাপ ‘ভাইরাল’ হচ্ছে, এবং আমরা ভদ্রলোকেরা শুনে শিহরিত হচ্ছি! প্রাক্তন বিচারক অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ‘মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে’ বলে একটি অবাঞ্ছিত উক্তি করেছেন, তার ফলে তৃণমূল দলের মর্মাঘাত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে এবং তাঁরা নিজেদের বিতৃষ্ণা ও বেদনায় দিশাহারা হয়ে জনতার দরবার থেকে কমিশনের দরজা পর্যন্ত ছোটাছুটি করছেন। এটা ঠিকই, শ্রীগঙ্গোপাধ্যায় ব্যক্তিনাম উল্লেখ করে ‘মৃত্যু’প্রসঙ্গ এনে অনুচিত কাজ করেছেন, তার ব্যাখ্যা যাই দিন তিনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতেই কি রাজনীতিতে অপশব্দ ফিরে ফিরে আসে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
৩.
আমাদের মতো বৃদ্ধ, যাদের বয়স অনেক, এবং অনেকে আমাদের ‘ইতিহাসের সাক্ষী’ বলে মনে করে, তারা সাধারণভাবে এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হই। আগে কি এরকম ছিল? এই অসৌজন্য, এই অপমানজনক, কখনও হিংস্র ভাষা। আমরা বলি যে, আগে কী ছিল, তা বলা খুব সহজ নয়। রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিলোপের উদ্যোগ নিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল রক্ষণশীল সমাজপতিরা, মৃত্যুকামনা তো তার আবশ্যিক উপাদান। প্যারীচরণ সরকার বারাসতে মেয়েদের স্কুল বসানোতে তাঁকেও হত্যা করতে লাঠিয়াল পাঠিয়েছিল জমিদাররা। গালাগাল তো সে তুলনায় নস্যি। আমরা বেশিরভাগ নির্বাচন দেখেছি বা সে সবের খবর পেয়েছি মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমে। সেখানে সব গালাগাল বা কটূক্তি হয়তো আমাদের কাছে পৌঁছোয়নি। ‘দাদাঠাকুর’ ও অন্যান্য ছবির দু’-একটা দৃশ্য দেখে মনে হয়– সে সময়ে নির্বাচনও ভাষাব্যবহারের দিক থেকে খুব নিরিমিষ বা নিষ্কলুষ ছিল না। ‘চোর’, ‘ডাকাত’, ‘লুটেরা’– ইত্যাদি কথা এখন গালাগাল, না নিজেদের কৃতকর্মের দ্বারা অর্জিত নিছক বিশেষণ, তাই নিয়ে তর্কাতর্কি চলতেই পারে, তার মীমাংসা হওয়া খুব মুশকিল। আমাদের মনে আছে, উনিশশো আশির মাঝামাঝি বছরগুলোতে, সম্ভবত বিহার থেকে, এই সমিল ঘোষণাটি চালু হয়েছিল, ‘গলি গলিমে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’। তার জন্য কাউকে জেলে যেতে হয়েছিল বলে জানি না। তবে এখন টেলিভিশন, ভিডিও, সিসিটিভি কত কী হয়েছে, আর ক্যামেরা সামনে এলে হয়তো কারও কারও উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়, কাজেই অসতর্ক কথার পরিমাণ বাড়ছে। এক সময় ‘Politics is a game of scoundrels’ কথাটা শুনতাম, তার সঙ্গে এই সব অপভাষা প্রযোগের কোনও যোগ আছে কি না কে জানে?
অর্থাৎ শুধু নির্বাচন নয়, সমাজে প্রতিপক্ষতার নানা উপলক্ষ তৈরি হয়। তাতেও গালাগাল-মারপিটের অবাধ সুযোগ। কিন্তু নির্বাচনের ওই এক তীব্র লক্ষ্য, প্রতিপক্ষের তুলনায় আমি মহৎ, নিষ্কলঙ্ক, কর্মঠ, জনদরদি, এবং নানা বিচিত্র গুণের অধিকারী– রাস্তার ধারে চায়ের স্টলে চা বানাতে বা কচুরি ভাজতেও আমার দক্ষতা কম নয়, কাজেই আমাকে ভোট দেবে না এমন অবিবেচকের এই ধরাধামে থাকার কোনও অধিকার আছে?
নির্বাচন আসবে আর আকথা-কুকথার বন্যা বইবে না, এ কি হয় নাকি?
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।