এ বইয়ের নামের দ্বিতীয় ভাগে প্রায় চোখে আঙুল দিয়েই বোঝাচ্ছে তৎকালীন সমাজের ছবি বইতে থাকবে। তাই-ই স্বাভাবিক। কেননা কোনও আত্মচরিতই সময় ও সমাজকে বাদ দিয়ে নয়। সেই সূত্রেই ওড়িশার অধীন থেকে বেরিয়ে আসা মেদিনীপুরের উপর ওড়িশার ভাষা-সংস্কৃতির ছাপ যে কীরকমভাবে রয়ে গিয়েছে তা আমরা টের পাই পড়তে পড়তে। যাঁরা জানি না, তাঁরা জেনে নিতে পারি– হাটুয়া ভাষার বোলচাল, সুবর্ণরৈখিক ভাষায় কীভাবে বাংলা ও ওড়িয়া ভাষা এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছে। জানতে পারি, চৌপদী-চৌতিশা, ষষ্ঠীমঙ্গল পালা, চটি বইয়ের পুরাণকথা এবং সেই সমাজের জাত-পাতের কথা।
কাহিনি– যা মূলত মিথ্যে, সত্যের গা ঘেঁষে ঘেঁষে থাকে– বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবনকে ঘষে-ঘষে এবড়োখেবড়ো মার্জনা করে নেয়। নইলে তার শিল্পরূপ রক্ষা হয় না। কাহিনির ক্লিশে হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে, ইতিহাস রক্ষার ভার থাকে, থাকে আধুনিক হয়ে ওঠার দায়। এমন ঘটনা তাই সে অনুমোদন করে না, যা দেখেশুনে মনে হতে পারে– বানিয়ে তোলা। অথচ জীবন, নির্দায় বলেই বোধহয়, যেমন তেমন-ই। শিল্প যদি তা হয়ে থাকে, তবে একেবারেই আঁকাড়া। সেইসব আশ্চর্যের অনুমোদন জীবন দেয়, কাহিনি যাকে বানিয়ে-তোলা বলে সন্দেহ করে। জীবন আর জীবনের শিল্পরূপের দূরত্ব তাহলে ঠিক কতখানি? সব জীবন কাহিনি হয়ে উঠতে পারে না, কেননা সেরকম রসদ থাকে না বলে। তবু তা তো জীবন-ই। নাকি যে কোনও রসদের জীবনকে সাধারণ জ্ঞানে সরিয়ে রাখা, কাহিনির একরকম চোখ ঠার! তর্ক থাক। তবে সুবলচন্দ্র দে-র ‘আমার জীবন ও তৎকালীন সমাজ’ পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল কাহিনির অভিসন্ধিকে হেলায় হার মানাতে পারে জীবন। ক্লিশে, সাধারণ, শিল্প বা শিল্প নয়– এসব প্রসঙ্গ হালে পানি পায় না, কেননা এক আস্ত জীবন, ঘাম-রক্তের জীবন, বেদনা-আনন্দের জীবন, খিদে আর বাবুর হেনস্তা সহ্য করা জীবনকে এসব শব্দের দোহাই দিয়ে নস্যাৎ করা যায় না। বইটির ভূমিকা অংশে নলিনী বেরা জানিয়েছেন, “একজন আনপড় সাধারণ চাষিবাসী মানুষ যখন তাঁর স্বকীয় ভাষায় তাঁরই আদড়া জীবনকথা শোনান, আত্মচরিত রচনা করেন, তখন তা হয় যেন সবদিক থেকেই অনন্যসাধারণ, তথাকথিত ‘সাব অল্টার্ন’ জীবন ও সমাজের অনুপুঙ্খ।” সুতরাং তথাকথিত বিখ্যাত মানুষ না হলেও কেন যে আমরা এ আত্মচরিত পড়তে বসেছি, তা স্পষ্ট। খ্যাত, অখ্যাতের প্রশ্ন নয়। আমরা পড়তে চাইছি মানুষটিকে, তাঁর সময়কে।
এখন সময়কে পড়তে চাওয়ার অনেক রকম পরত থাকতে পারে। এ বইয়ের নামের দ্বিতীয় ভাগে প্রায় চোখে আঙুল দিয়েই বোঝাচ্ছে তৎকালীন সমাজের ছবি বইতে থাকবে। তাই-ই স্বাভাবিক। কেননা কোনও আত্মচরিতই সময় ও সমাজকে বাদ দিয়ে নয়। সেই সূত্রেই ওড়িশার অধীন থেকে বেরিয়ে আসা মেদিনীপুরের উপর ওড়িশার ভাষা-সংস্কৃতির ছাপ যে কীরকমভাবে রয়ে গিয়েছে তা আমরা টের পাই পড়তে পড়তে। যাঁরা জানি না, তাঁরা জেনে নিতে পারি– হাটুয়া ভাষার বোলচাল, সুবর্ণরৈখিক ভাষায় কীভাবে বাংলা ও ওড়িয়া ভাষা এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছে। জানতে পারি, চৌপদী-চৌতিশা, ষষ্ঠীমঙ্গল পালা, চটি বইয়ের পুরাণকথা এবং সেই সমাজের জাত-পাতের কথা। শরৎচন্দ্র আজ আর তেমন পঠিত হোন বা না হোন কিংবা নানা সমালোচনায় বিদ্ধ হতেই পারেন, তবে যে সমাজ তিনি চিনিয়ে গিয়েছিলেন তা আমাদের কাছে জরুরি হয়ে ওঠারই কথা ছিল। অন্য সমালোচনায় তাঁকে আক্রমণ করতে গিয়ে আঙুল গলে হারিয়েছে আমলকি। সুবলচন্দ্র দে তাঁর দেখা সমাজের বর্ণনা দিতে গিয়েও সেই জাতপাত জল-অচল সম্পর্কের কথাই এনেছেন। এক জাতের মড়া অন্য জাতের কেউ দাহ করবে না, মাটি দেবে না, জন খাটতে এলে বাসন আলাদা। এই থাকবন্দি সমাজ বেশি দূরের নয়। এখনও তা থেকে পুরোপরি নিস্তার পাওয়া গিয়েছে এমনটাও নয়। বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদের স্বরূপ অনেকখানি এই ব্যক্তিগত জীবনচরিতের মধ্য দিয়েও বেশ ধরা পড়ে। তবে আমরা চোখ পালটিয়ে দেখব কি-না তা বড় আত্মঘাতী প্রশ্ন।
যাক সে কথা, সমাজের এই সব টুকরো ছবির ভিতর থেকেই উঠে আসতে দেখি মাস্টারমশাইকে। সাধারণ কৃষক পরিবারের একটি ছেলে পড়বে কী করে? ছেলেটির বাবা সবিনয়ে জানিয়েছেন যে, বেতন দেওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই। বেতন মকুবের দায়িত্ব নেবেন প্রধান শিক্ষকই। সেই প্রধান শিক্ষক, যাঁকে একদিন স্কুলছাড়া হতে হবে। কেননা জনৈক বিদ্বান মানুষকে ম্যানেজমেন্ট দায়িত্ব দিতে চায়। অতএব ঝামেলা, স্কুলে তালা, মামলা আদালতে। শিক্ষক তবু ছাড়েন না তাঁর ছাত্রটিকে। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, স্যারের স্ত্রী ছাড়েন না তাঁর ছেলের সহপাঠীকে। তাঁর আশা, একটা ব্যবস্থা যেন এই সাধারণ ঘরের ছেলেটিরও হয়। এবং তা হল। একটি চিঠিতেই হল। আজ এই ২০২৫-এ, যখন শিক্ষকরা যোগ্য না অযোগ্য তা নিয়ে সংশয়, এবং একই সঙ্গে হাজার হাজার শিক্ষক চাকরিহারা, তখন এ-জীবন পড়তে পড়তে অবাকই হতে হয়। খুব তো অচেনা নয়। এমনটাই তো ছিল, এই কিছুদিন আগেও। অথচ ‘এখন সব অলীক’। এই সাধারণ ছেলেটার জার্নিতে এবার পাঠক নিজেও জড়িয়ে পড়েন। কোথায় যাবে সে! ঘর ছেড়ে, পরের মাঝে। যারা কখনও ঘর ছেড়েছে, তারাই জানে, জীবনের সব অভিজ্ঞতা কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যায়। এই ছেলেটিও এবার একা একা জীবনের লড়াই লড়তে নামবে, আর তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে এক অন্নদা দিদির। সংসারে মন যুগিয়ে চলাই তাঁর নিয়তি। হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের আদল যে ছেলেটির মুখে দেখতে পাবে, তাকে এক পিস মাছ দেওয়ার সামর্থ্যও তাঁর নেই। আর এইখানেই অন্নদাদিদিরা প্রতিবার ম্যাজিক দেখান। ছেলেটা একদিন ভাত ভাঙতে গিয়ে দেখবে, ভাতের মধ্যে লুকোনো আছে আস্ত একটা ইলিশ মাছের পিস। তার জন্য বরাদ্দ নয়। জানাজানি হলে চেঁচামেচি হবে, অতএব দিদি ঠোঁটে হাত দিয়ে চুপ করার ইশারা করছেন। তবু ভাইয়ের জন্য লুকিয়ে এক পিস ইলিশ নিয়ে এসেছেন ঠিকই। বাঙালি যদি কোথাও জিতে যেতে পারে, তাহলে রেঁনেসাস, মহাকাব্য ইত্যাদিতে নয়, এই স্নেহটুকুতেই। এই মায়াটুকু তাঁর আত্মায় মিশে থাকে বলেই, আত্মচরিতে তা ফিরে ফিরে আসে।
ছেলেটির লড়াই চলবে। কলকাতা তাকে ডেকে নেবে চাকর করে। প্রায় যেন গল্পের মতোই। এ কলকাতা বহু স্বাধীন মানুষকে চাকর করেই ডাক পাঠিয়েছে। এখানে তা আক্ষরিক। আর এখানেই বড়লোকের বদমাইশ ছেলের ব্লেড তার পিঠে রেখে যাবে সেই দাগ, যে দাগ মুছবে না এক জীবনে। জীবন তবু বেয়াড়ারকমের একরোখা বলেই এসব রক্তক্ষরণে ক্ষয়ে যায় না। আবার উঠে দাঁড়ায়, ঘুরে দাঁড়ায়। আবার কোনও মহিয়সীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, যে তাঁকে আদর করে দু’মুঠো ভাত বেশি খাওয়ায়। ছেলেটি একদিন তার মোকামে ফেরে। আবার নতুন লড়াই। নতুন করে সাজানো কৃষিকাজ। আনাজ বিক্রি, স্ত্রীর গয়না দিয়ে দেওয়া, নিজের দোকান। অল্প হলেও সচ্ছলতার মুখ দেখা। ফিরে আসে পিয়ারলেসের ইতিহাস। এবং নয়ছয় জানতে পেরে, একজন সাধারণ মানুষের সরে যাওয়া। নিজের মতো করে সেই দুর্নীতি রোখার চেষ্টা। ব্যক্তিগত জীবন যে যে কারণে রাজনৈতিক হয়ে উঠতে পারে, এ-ও তার নমুনা। অথচ বাগাড়ম্বরের সময় যত তত্ত্ব বলে আর শিল্প করে, মুখে-মনে তত এক হয় না। হয় না বলেই দুর্নীতির সামান্যীকরণ হয়। সমাজ বিষিয়ে ওঠে। আর তার বিপ্রতীপে যেন দাঁড়িয়ে থাকে এই ‘তৎকালীন সমাজ’। সে-সমাজ জাত-পাতের বেড়াবন্দি, অথচ সে-সমাজে চট করে কাউকে অপর করে দেওয়ার রেওয়াজ নেই। বরং পাশের মানুষকে আপনার করে ভাবতে চাওয়াই এই সমাজের শিক্ষা। যতটা পাশে দাঁড়াতে পারলে মানুষ, মানুষ হয়ে থাকতে পারে।
এ-শিক্ষা দিয়ে আমাদের হবেটা কী! আর এ-সমাজের গল্প জেনে করবই বা কী? এক জীবনের গল্প যত শেষের দিকে এগোয় তত বিচ্ছিরি প্রশ্ন জাগে। মনে পড়ে, দিনকয় আগে পামুকের ডায়রিতে পড়েছিলাম, লিখে রেখেছেন– “The secret heroes of ‘Nights of Plague’ are the children hunting green mullet to save the island from starvation.” নীতি-টিতি চুলোয় গেলে সমাজের বুকে এক রকমের মন্বন্তর। সমাজবদলের ডাক কে কবে দেবেন জানা নেই, তবে এই স্মৃতি-মীন ঘুরে বেড়াক নতুন সময়ের জলে। হয়তো সেই বাঁচাবে আগামীকে, বীজধান যেমন জোগায় পরের বছরের খোরাকি। এটুকুই সামান্য এক জীবনের সম্বল, সুবলচন্দ্র দে তাঁর আত্মচরিতে সেটুকুই বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে।
আমার জীবন ও তৎকালীন সমাজ
সুবলচন্দ্র দে
কমলিনী
৩৯৯ টাকা