৩০ বছর পরে ‘বইপড়া বইপাড়া’ যে কেন পুনর্মুদ্রিত হল, সেইটে বুঝতে পারি ভীষণ। অতীতচারণ কি নেই? আলবাত আছে। এই সময়ের সঙ্গে একটা কথোপকথনও আছে। বাঙালির শিকড় ধরে ঝাঁকুনিও আছে প্রচ্ছন্ন। বাঙালির বই নিয়ে মেতে থাকা এবং বইয়ের হুজুগ— তাকে যেমন আশ্রয় দিয়েছেন অরুণ সেন, বকা দিতেও কিন্তু দু’বার ভাবেননি।
একটি গদ্যের বই খুঁজছি। গত দেড় বছর ধরে! প্রত্যেক বইপাড়া চষে ফেলেছি। তবুও খুঁজছি। এই কলকাতা শহরে। বইটির নাম? নবারুণ ভট্টাচার্যের– ‘অ্যাকোয়ারিয়াম’! তারপর একদিন, বইটি খুঁজে পেলাম অথবা বইটিই আমাকে খুঁজে নিল। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে। বইপাড়ায়। অগুনতি পুরনো বইয়ের পশরায়। বিশ্বাস করুন, মনে হয়েছিল এ যেন ম্যাজিক! মনে হয়েছিল, পৃথিবীর আরও কোনও দেশে এমন ম্যাজিক হয় নিশ্চয়ই। আমার সে ভুলটি এক্কেরে দুর্মুশ করে ভেঙে দিলেন গদ্যকার অরুণ সেন। তিনি লিখলেন: ‘পরিচিতদের মধ্যে যাঁরা বিদেশ গেছেন– …তাঁরা ফ্রান্সের লাতিন কোয়ার্টারের কথা বলেছেন, সিন নদীর ধারে বইয়ের ছাড়া-ছাড়া বইয়ের স্টলের কথা বলেছেন, নিউ ইয়র্কের দোকানের বিশালত্বের কথা বলেছেন, কিন্তু বইপাড়া বলতে আমরা যা বুঝি, তাঁদের চোখে পড়েনি…’ ঠিক এরপরই, প্রকট গৌরবে বললেন: ‘আমাদের বইপাড়ার ধারেকাছে লাগে না আর কারোর।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অরুণ সেন লিখছেন: ‘‘অবকাশ তো উপার্জন করতে হয়। সংস্কৃতিরই অঙ্গ তা। তাই ‘ফাঁকা সময়’ কীভাবে অবকাশ হয়ে উঠবে, তা নির্ভর করে মানুষের সামগ্রিকতার ওপর।’’ কী আশ্চর্য কথা! যে-সময় নিয়ন্ত্রণ করছে চ্যাটজিপিটি, যে-সময়ে মানুষের শ্রমের নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, সেই সময় ছুটি বলতে কী বুঝেছি আমরা? তা কি মনে, মগজে এবং বোধে সমৃদ্ধির আভাস দেয়? আজ্ঞে না।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘আমাদের’ অর্থ কি সমগ্র বাঙালির? নিঃসন্দেহে। অরুণ সেন অন্তত তেমনটাই ভাবতে শেখাচ্ছেন। তাঁর ‘বইপড়া বইপাড়া’ বইটিতে। এখন, এই একুশ শতকে তো ভাবনার আকাল। অথবা, অতিভাবনাময়। যে চক্করে আমাদের চিন্তার প্রকোষ্ঠগুলো সরু থেকে সরুতর হয়ে মিশেছে ইন্সটাগ্রাম রিলে। সোশাল আবর্জনায়। ফলে, ‘বাঙালি আর বই পড়ে কি না?’– তার চেয়েও মহার্ঘ হয়ে উঠেছে এই প্রশ্ন, ‘বই কি আর সহমর্মী করে বাঙালি পাঠককূলকে?’
সহমর্মী। এম্প্যাথি। যার অবকাশ বোধকরি আমাদের নেই। অথচ অরুণ সেন লিখছেন: ‘‘অবকাশ তো উপার্জন করতে হয়। সংস্কৃতিরই অঙ্গ তা। তাই ‘ফাঁকা সময়’ কীভাবে অবকাশ হয়ে উঠবে, তা নির্ভর করে মানুষের সামগ্রিকতার ওপর।’’ কী আশ্চর্য কথা! যে-সময় নিয়ন্ত্রণ করছে চ্যাটজিপিটি, যে-সময়ে মানুষের শ্রমের নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, সেই সময় ছুটি বলতে কী বুঝেছি আমরা? তা কি মনে, মগজে এবং বোধে সমৃদ্ধির আভাস দেয়? আজ্ঞে না।
বইপড়া থামিয়ে সটান পৌঁছে যাই একদম প্রথম পাতায়। লক্ষ্য করি, আজ থেকে ৩০ বছর আগে প্রকাশিত— ‘বইপড়া বইপাড়া’। জানুয়ারি, ১৯৯৩। সে-বই আজকের মতো করে কথা বলতে পারে কোন প্রতাপে! বিস্মিত হই। বিস্মিত হই অরুণ সেন-এর গদ্যভাষায়। রসবোধে। একটি পুরনো বইয়ের কথা বলছেন। ‘সোনারঙ্গ’। যা মূলত ঢাকা জেলার একটি গ্রামের ইতিহাস। সেই বইটিতে গ্রামের ভূত প্রসঙ্গে প্রফুল্লনাথ সেন লিখেছিলেন: ‘…বৃদ্ধেরা শেষরাত্রে বাহিরে আসিলেই ভূত দেখিতে পাইতেন। আমরা কিন্তু কখনও কোনো ভূত গ্রামে ছিল বলিয়া শুনি নাই।’ উদ্ধৃতি শেষ করে অরুণ সেন লিখলেন: ‘সত্যবাদিতা বিস্ময়কর।’ হে পাঠক, এইবেলা আন্দাজ করুন কী বিপুল পরিমাণ উইট মিশে আছে এ-বইয়ের প্রতিটি গদ্যশরীরে!
যেমন বইয়ের অনাদিকালের ইতিহাসের দিকে ফিরে যায় এ-বই, যেমন বলে বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগের শুরুয়াতের দিনগুলো, রবি ঠাকুরও যখন নিজের পয়সায় বই ছাপাচ্ছেন; তেমনই অরুণ সেন প্রশ্ন করেন সমালোচককে। বলেন: ‘জনপ্রিয়তার পেছনে, বিজ্ঞান ছাত্রদের পরিভাষায় বলা যায়, স্থিতি জাড্য ও গতি জাড্য করে বলে মনে হয়। যে বই বা যার বই বিক্রি হয় না, ‘পাঠক নেয় না’, তার ভাগ্যে সেই ঘটনা ঘটতেই থাকে। যার বই বা যে বই একবার বিক্রি হতে শুরু করল, তার বিক্রি যেন থামতেই চায় না… সমালোচক পারেন সেই জাড্যকে– স্থিতির ও গতির জাড্যকে ভেঙে ফেলতে…’ এভাবেই পাঠকরুচি নির্মাণ করা যেত। তা সজ্ঞানে এড়িয়ে, স্তুতিজাড্যে ভরে উঠেছে বাংলা সাহিত্য। আর যা আছে, নান্দনিক কাঁদুনি। আমাদের সব গেল গো। অরুণ সেন চাইলেই কাঁদুনি গাইতে পারতেন, মলিনমেদুর নস্টালজিয়ার গদ্য লিখতে পারতেন। তিনি কিন্তু হাঁটলেন সম্পূর্ণ অন্যপথে। বললেন মনের অবকাশের কথা। বললেন, আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা বুঝিয়ে দিয়েছে– বেঁচে আছি, এই-ই অনেক! এবং বললেন, যে অপসংস্কৃতির চাষ, তার ‘বিকল্প সংস্কৃতি নির্মাণের মহৎ দম্ভ কোথায়?’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ‘বহুরূপী যাপন’ স্মৃতি নামক এক বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর থেকে ধার করে আনা গল্প
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
৩০ বছর পরে ‘বইপড়া বইপাড়া’ যে কেন পুনর্মুদ্রিত হল, সেইটে বুঝতে পারি ভীষণ। অতীতচারণ কি নেই? আলবাত আছে। এই সময়ের সঙ্গে একটা কথোপকথনও আছে। বাঙালির শিকড় ধরে ঝাঁকুনিও আছে প্রচ্ছন্ন। বাঙালির বই নিয়ে মেতে থাকা এবং বইয়ের হুজুগ– তাকে যেমন আশ্রয় দিয়েছেন অরুণ সেন, বকা দিতেও কিন্তু দু’বার ভাবেননি। যেমন সাহিত্যের পুরস্কার প্রসঙ্গে লিখছেন: ‘কোনো বছরের কোনো পুরস্কার একজন ব্যক্তি তাঁর রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আপত্তি করতেই পারেন… অস্বাভাবিক যা তা হল, কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের আপত্তি বা সম্মতি জানানোর অধিকারকেই বিদ্রুপ করা। যতদিন নান্দনিক প্রশ্নে রুচির বহুচারিতা থাকবে, ততদিন মাপকাঠির এই ভিন্নতাকে মেনে নিতেই হবে…’
একটা বই কেমন বইপাড়া থেকে শুরু করে নিবিড় বইপড়ায় ঢুকে গেল! বিজেপি-শাসিত ভারতে যে বই বলছে, ‘প্রত্যেক ধার্মিকের তীর্থস্থান থাকে। বই-পড়ুয়ার তীর্থস্থান তবে বইপাড়া’। বলছে, বহুরুচির কথা। এবং তাকে সম্মান জানানোর কথা। ৩০ বছরে দেশের ভিত কী এমন নড়ে গেল মশাই, যে ভিন্নতার কথা বলতে একটি বইকে পুনর্মুদ্রিত হয়ে আসতে হল? এসেছে একেবারে মোক্ষম সময়ে। বই আসলে ফ্যাশনের অঙ্গ— আগেও ছিল। ‘বিবলিওফিল’ মানে শুধুই বইয়ের বহিরঙ্গের প্রতি প্রেম, ‘গ্রন্থকীট’-এর সঙ্গে কী বিপুল ফারাক—অরুণ সেন তাও লিখেছেন। বাঙালি গর্বেই। কিন্তু একটি বই মানেই কি শুধু লেখক এবং পাঠক? না। একটি ছাপাখানা। একজন প্রুফ রিডার। একজন সম্পাদক। একজন প্রকাশক। একাধিক অলংকরণ। বইটির প্রচ্ছদ। বইটির বিপণন। সবশেষে বইটির দেহের ধুলো। সমস্তটা নিয়েই একটি বই।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: সাদা-কালো নির্মল বাঙালিয়ানা
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমিও, এ-লেখা শুরু করেছিলাম বইপাড়া থেকেই। আর কোথাও যাওয়ার নেই কি না। বইপড়ায় শেষ করছি। মধ্যে মধ্যে চমকে দিয়েছে পূর্ণেন্দু পত্রী, যুধাজিৎ সেনগুপ্ত ও সুব্রত চৌধুরীর অলংকরণ। অরুণ সেনের কথা অনুসারে, ‘যা কল্পনার সহায়ক’। প্রশ্ন একটিই, এ-বইয়ের আকারে বদল ঘটল কেন? পুরনো আদল কিংবা দর্শন বাঁচিয়ে রাখা যেত না?
যখন ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে গদ্যগুলি লিখছেন তিনি, তখন ১৯৮৩। টেলিভিশন যে বইকে ‘রিপ্লেস’ করবেই, এমন আশঙ্কা তাঁর ছিলই। সাম্প্রতিক সময়ে ই-বুক প্রতিস্থাপিত করেছে। সুস্নাত চৌধুরীর একটি চমৎকার গদ্যের কথা মনে পড়ছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘বৈদ্যুতিন মাধ্যমে নিয়মিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানোর অভ্যাস যে অতিপাঠের মধ্যে দিয়ে নিরন্তর আমাদের চালনা করছে, তাতে নিমগ্ন পাঠ ব্যাহত হচ্ছেই… গত দুই দশকে তরুণ প্রজন্মের এমপ্যাথি বা সহমর্মিতা বোধে প্রায় চল্লিশ শতাংশ অবনতি দেখা দিয়েছে…’
অগত্যা জ্ঞান বা বইপড়ার অনুভূতি– সহমর্মিতা-বর্জিত। তবু, এই লেখায় রেখে দিলাম একটি সাইকেল। ইচ্ছে হলে চড়ে বসুন। সঙ্গে রাখুন এই বই। কারণ প্রযুক্তির সঙ্গে অসম যুদ্ধে, বই-ই আমাদের অস্ত্র। আর উৎসর্গপত্রের নামটি খেয়াল করুন– পূর্ণেন্দু পত্রী! এরপরও সাইকেল চালানোর সাধ জাগবে না আমাদের আস্ত বইপাড়ায়? এরপরও মনে হবে দম ফুরিয়ে আসছে? লড়াই করতে করতে!