এ শুধু পৌলমীর নয়, পৌলমীদের জীবনের চেনা-গল্প। যেখানে ছত্রে ছত্রে মিশে রয়েছে উপেক্ষা, বঞ্চনার জ্বালা। যুগে যুগে সেই বঞ্চনা, অবহেলার শিকার হতে হয়েছে মেয়েদের। ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ হয়েও তারা কিন্তু দমে যায়নি। বরং চোয়ালচাপা লড়াইয়ে নিজের পায়ের তলার জমি শক্ত করার শপথ নিয়েছে।
পৌলমী অধিকারীর কথা মনে আছে? ওই যে ‘জোম্যাটো গার্ল’। এককালে ফুটবল ছিল যার ধ্যানজ্ঞান, সবকিছু। কিন্তু অভাবের সংসারে স্বপ্ন মাথা চাড়া দেওয়ার আগেই নটে গাছের মতো মুড়িয়ে যায়। ফুটবল ছেড়ে পৌলমী গায়ে চাপিয়ে নেন টকটকে লাল রঙের টি-শার্ট। না, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি নয়। ফুড ডেলিভারি সংস্থার টি-শার্ট। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়েই ফুটবলের বুট তুলে রেখে কাঁধে তুলে নিয়েছেন খাবারের বোঝা। ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে পৌলমীর এই জীবন সংগ্রাম কোনও ‘বিগ ব্রেকিং’ নয়। একবছর আগেই প্রচারের আলোয় উঠে এসেছিলেন পৌলমী। ওই প্রচারটুকুই সার। সমস্যার সমাধান হয়েছে কি? বছর পেরিয়ে গেলেও পৌলমীর বর্তমান অবস্থা দেখে মনে পড়ে যাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার সেই চেনা পংক্তি, ‘কেউ কথা রাখেনি’। এ শুধু পৌলমীর নয়, পৌলমীদের জীবনের চেনা-গল্প। যেখানে ছত্রে ছত্রে মিশে রয়েছে উপেক্ষা, বঞ্চনার জ্বালা। যুগে যুগে সেই বঞ্চনা, অবহেলার শিকার হতে হয়েছে মেয়েদের। ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ হয়েও তারা কিন্তু দমে যায়নি। বরং চোয়ালচাপা লড়াইয়ে নিজের পায়ের তলার জমি শক্ত করার শপথ নিয়েছে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে নিজেদের প্রতিষ্ঠা দিতে। সেই সংকল্পের, সেই প্রতিবন্ধকতা জয়ের আয়না হল, পৌলমী ঘোষের ‘ভারতীয় নারী: ফুটবল মাঠে’ বইটি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের ফিটনেস বিশেষজ্ঞ হিসেবে যুক্ত থাকার দরুন বৈষম্যের ছবিটা লেখিকা পৌলমীর কাছে আরও স্পষ্ট। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটবলার পৌলমীদের যন্ত্রণাকে খুঁজে তাঁর কলমের সমস্যা হয়নি। দশটি অধ্যায়, সঙ্গে পরিশিষ্ট ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের পুনর্মুদ্রণকে হাতিয়ার করে লেখিকা সামাজিক বৈষম্যের বাস্তব দলিল নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছেন। সত্যিকারের সুরাহার সন্ধানে তাই গবেষণার প্রাচীর ভেঙে তৈরি করেছেন তাঁর এই গ্রন্থ, ‘ভারতীয় নারী: ফুটবল মাঠে’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মূলত গবেষণাপত্র হলেও সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা লিঙ্গবৈষম্য ও ফুটবল মাঠে তার প্রভাব শিকড়ের কতটা গভীরে বিস্তৃত, তা তুলে ধরার উদ্দেশেই এই গ্রন্থ রচনায় উদ্যোগী হয়েছেন লেখিকা। ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের ফিটনেস বিশেষজ্ঞ হিসেবে যুক্ত থাকার দরুন বৈষম্যের ছবিটা লেখিকা পৌলমীর কাছে আরও স্পষ্ট। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটবলার পৌলমীদের যন্ত্রণাকে খুঁজে তাঁর কলমের সমস্যা হয়নি। দশটি অধ্যায়, সঙ্গে পরিশিষ্ট ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের পুনর্মুদ্রণকে হাতিয়ার করে লেখিকা সামাজিক বৈষম্যের বাস্তব দলিল নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছেন। সত্যিকারের সুরাহার সন্ধানে তাই গবেষণার প্রাচীর ভেঙে তৈরি করেছেন তাঁর এই গ্রন্থ, ‘ভারতীয় নারী: ফুটবল মাঠে’। মেয়েদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে আধার হিসেবে ফুটবল ও তার পরিসরকে বেছে নিলেও সেটা নিমিত্ত মাত্র। বাস্তবে ফুটবলের পরিধি ছাপিয়ে পৌলমী ঘোষের এই গ্রন্থ বৃহত্তর সমাজে বঞ্চিত নারীমানসের কথা তুলে ধরার স্পর্ধা দেখিয়েছে। ‘নারীবাদের আয়না’ পরিচ্ছেদে লেখিকা পৌলমী তাই লিখছেন, ‘কিংবদন্তি দৌড়বিদ মিলখা সিং বিশ্বাস করতেন ক্রীড়াঙ্গনে লিঙ্গভেদ থাকতে পারে না এবং প্র্যাকটিসকে তিনি ধর্মাচরণ বলে ভাবতেন। মিলখা সিং-এর এই ধর্মদর্শনকেই আমাদের দেশের ফুটবল খেলা মেয়েগুলো সাধনব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছে। এত ত্যাগ এত নিষ্ঠা সত্ত্বেও আমাদের রোজনামচায় তারা হয়তো এখনো জায়গা করতে পারেনি। তবু ধৈর্যশীলা রমণী ব্রতপরায়না। এই নিষ্ঠাই নারীত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। আমজনতা অনেকেই মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে নাটসিটকায় এবং মনে করে মেয়েদের শরীরি গঠন আর মনোবিন্যাসের সাথে ফুটবল বেমানান। তাদের বোঝা দরকার দৈনন্দিনতায় নূন্যতম শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক তৎপরতার যুগলবন্দী; এবং যে-কোনো প্রতিবেশে নিজেকে টিকিয়ে রাখার সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা দুয়েরই একান্ত আস্থাশীল মাধ্যম হলো ফুটবল।’ বস্তুত আধুনিকতার প্রলেপ লাগা সত্ত্বেও, প্রগতিশীল ভাবনার শরিক হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় সমাজচেতনায় যে প্রদীপের নিচে জমাট-বাঁধা অন্ধকারের মতো উন্নাসিকতা এবং ছুৎমার্গ আজও বজায় রয়েছে, তার প্রতিফলন ঘটেছে লেখিকার কলমে। আরও একটা ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন লেখিকা পৌলমী ঘোষ। তা হল, ফুটবলকে পেশা হিসেবে মেয়েদের বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের রক্তচক্ষু প্রদর্শন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ‘কাল আবার বিপ্লব জেগে উঠবে, আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব’ রোজা লুক্সেমবার্গ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এভাবে কি নারীর অধিকারবোধকে নস্যাৎ করা যায়? যায় না। আর তাই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা জয় করে সাফল্যের ডানা মেলেছে ভারতীয় নারী, বৃহত্তর পরিসরে। এ গ্রন্থে শুধু তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে সেটা ফুটবলের ব্যপ্ত পরিসরে। ভারতীয় ফুটবলে মেয়েরা ছেলেদের থেকে সাফল্যের নিরিখে অনেকটাই এগিয়ে। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে তাদের এই সাফল্য প্রমাণ করে দেয় মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত চেষ্টা ও ফুটবলের প্রতি অনুরাগকে। শান্তি মল্লিকেরা যে সাফল্যের ভিত গড়েছিলেন, তাকেই পরবর্তীতে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন বেমবেম দেবী থেকে বালা দেবী, সঙ্গীতা বাসফোর থেকে মণীষা কল্যাণরা। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন সুলঞ্জনা রাউল থেকে মৌসুমী মুর্মুর মতো নতুন মুখ। কিন্তু তাদের সাফল্যের ভিত্তিভূমি মোটেই মসৃণ নয়, বৈষম্যের খরতাপে তা কর্কশ, বন্ধুর। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মহিলা ফুটবলারদের সেই ‘অহর্নিশ’ প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতিদানের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে পৌলমী ঘোষের এই মলাটবন্দি গ্রন্থ।
ভারতীয় নারী: ফুটবল মাঠে
অহর্নিশ
পৌলমী ঘোষ
মূল্য ৪০০ টাকা