শিল্ড জিতেও কেন গত মরশুমে আইএসএল ট্রফি অধরা থাকল মোহনবাগানের? গোয়ায় সাফল্যের রাতে ‘এটিকে’ মুছে সঞ্জীব গোয়েঙ্কার মাস্টারস্ট্রোক কিংবা সুপার কাপে তারকাখচিত মোহনবাগানকে হারিয়ে ইস্টবেঙ্গলের ডার্বি জয়। কার্লেস কুয়াদ্রাদ নামক এক ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’-এর সমর্থকদের চোখে খলনায়কে পরিণত হওয়ার করুণ কাহিনি– এই গ্রন্থে শুধু সাজিয়ে দেননি লেখক, পাশাপাশি তুলে এনেছেন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, ঘটনাক্রম– যা দৈনিকপত্রে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গল। শতাব্দীপ্রাচীন এই দুই ক্লাবকে বাদ দিয়ে ভারতীয় ফুটবল অসম্পূর্ণ।
চেনা কথা। ময়দানের হাওয়াবাতাসে ঘুরতে ঘুরতে একথা মিথে পরিণত হয়েছে। তবু মরচে পড়েনি। বিশ্বের দরবারে ভারতীয় ফুটবলের পরিচয় হয়ে আজও বিদ্যমান কলকাতার দুই প্রধান। যাদের সোনালি ইতিহাসে জড়িয়ে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ সমস্ত কিছুর উৎস-আধার দুই ক্লাবের কোটি কোটি সমর্থকদের আবেগ এবং স্বার্থহীন ভালোবাসা। সেই উষ্ণতাই মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্রের মতো বাঁচিয়ে রেখেছে ময়দানের দুই পরাশক্তিকে।
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মোহন বেঙ্গল’ সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাসের এক খণ্ডচিত্র। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই শিবির। সমন্বয়ের চেয়ে সংঘাতই যেখানে উপজীব্য দু’দলের সমর্থকদের। সেই ময়দানি দ্বৈরথকে স্বীকৃতি ও সম্মান জানিয়েই লেখক তাঁর গ্রন্থের নামাঙ্কন করেছেন দুই ক্লাবের নাম অনুযায়ী, মোহনবাগানের ‘মোহন’, ইস্টবেঙ্গলের ‘বেঙ্গল’। দুইয়ের ‘দ্বন্দ্বে’ এই ‘মোহন বেঙ্গল’।
একশো বছর পেরিয়ে আজও সাফল্যের স্রোতে তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে মোহনবাগানের পালতোলা নৌকা, প্রতিকূলতার শত ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যেও দেদীপ্যমান ইস্টবেঙ্গলের জ্বলন্ত মশাল। সেই স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসের যে খণ্ডচিত্র লেখক দুই মলাটের মধ্যে ধরার চেষ্টা করেছেন, তার পরিসর দু’হাজার সালের পরবর্তী সময়। অর্থাৎ, চলতি শতকের প্রথম দুই যুগ উঠে এসেছে অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে।
শতাব্দীপ্রাচীন দুই প্রধানের গৌরবময় ফুটবল ইতিহাস সুবিদিত। সেই ইতিহাসকে দুই মলাটে ধরা সহজসাধ্য নয়। লেখক তাঁর পূর্বপ্রয়াসে ‘মোহনবাগান, সবুজ ঘাসের মেরুন গল্প’ এবং ‘লাল হলুদের ডায়েরি’-তে সেই ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। তবে মোহনবাগান যেমন ফুটবলে মহাসমুদ্র, তেমনই ইস্টবেঙ্গল যেন মহাকাশ। এক নয়, বারেবারের দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে তাই অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ফিরে আসতে হয়। সেই অন্বেষার মধ্যেই ভারতীয় ফুটবল সত্তার স্বরূপকে জানা যায়। ভারতীয় ফুটবল যে রত্নগর্ভা, তার নেপথ্যে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের অবদান কিছু কম নয়। দশকের পর দশক মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান স্পোর্টিংয়ের মতোই ক্লাবই ছিল ভারতীয় ফুটবলের ‘সাপ্লাই লাইন’। বাংলা যে প্রকৃত অর্থে ভারতীয় ফুটবলের মক্কা, তা যে কথার কথা নয়, সেটা তিন প্রধানের অতীত সাফল্যেই প্রমাণিত।
……………………………..
ফুটবলের সঙ্গে বাঙালির নাড়ির যোগ। উত্তরাধিকার সূত্রে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা সঞ্চারিত হয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। লেখক নিজেও তার ব্যতিক্রম নন। সেই বাল্যকালের ভালোবাসা যখন হয়ে ওঠে জীবনের অবলম্বন তখন তা পূর্ণতা পায়। একজন পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে তাই মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের সাফল্য গাথাকে ছুঁয়ে দেখা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছে, নিরপেক্ষ নিরীক্ষণে।
……………………………..
ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের সেই সাফল্যের শেষ চব্বিশ-পঁচিশ বছরকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে দেখার চেষ্টা করেছেন ‘মোহন বেঙ্গল’-এর রচনাকার, যা তাঁর চোখে দেখা। সেখানে যেমন উঠে এসেছে মোহনবাগানের আইএসএলের সাফল্য, তেমনই ব্যর্থতার আঁধার ঘুচিয়ে সুপার কাপে ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যে ফেরা। এবং অবশ্যই ’২৪-এর আগস্টের সেই দ্রোহকাল!
ফুটবলের সঙ্গে বাঙালির নাড়ির যোগ। উত্তরাধিকার সূত্রে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা সঞ্চারিত হয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। লেখক নিজেও তার ব্যতিক্রম নন। সেই বাল্যকালের ভালোবাসা যখন হয়ে ওঠে জীবনের অবলম্বন তখন তা পূর্ণতা পায়। একজন পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে তাই মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের সাফল্য গাথাকে ছুঁয়ে দেখা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছে, নিরপেক্ষ নিরীক্ষণে।
৩২টি ভিন্ন স্বাদের লেখা। আলাদা গল্প উঠে এসেছে ‘মোহন বেঙ্গল’-এ। স্রেফ রিপোর্টিং নয়, একজন সাংবাদিকের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় ও পরিধি আরও বড়। সংবাদপত্রের সীমিত পরিসরে নির্দিষ্ট দিনে তাকে জায়গা দেওয়া পরিস্থিতি সাপেক্ষে সম্ভব হয় না। এই গ্রন্থে সেই আক্ষেপ মিটিয়েছেন লেখক। এনেছেন রিপোর্টিং এবং তার পারিপার্শ্বিক এক আলোচনার পরিসর। সেই বিশ্লেষণ পাঠকদের জন্য এক বড় প্রাপ্তি।
শিল্ড জিতেও কেন গত মরশুমে আইএসএল ট্রফি অধরা থাকল মোহনবাগানের? গোয়ায় সাফল্যের রাতে ‘এটিকে’ মুছে সঞ্জীব গোয়েঙ্কার মাস্টারস্ট্রোক কিংবা সুপার কাপে তারকাখচিত মোহনবাগানকে হারিয়ে ইস্টবেঙ্গলের ডার্বি জয়। কার্লেস কুয়াদ্রাদ নামক এক ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’-এর সমর্থকদের চোখে খলনায়কে পরিণত হওয়ার করুণ কাহিনি– এই গ্রন্থে শুধু সাজিয়ে দেননি লেখক, পাশাপাশি তুলে এনেছেন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, ঘটনাক্রম– যা দৈনিকপত্রে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
তবে এই বইয়ে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে ‘মোহনবাগানের সেই আড্ডাটা’, “জংলার অভিমান, সুভাষের ‘আয়-আয়” এবং অবশ্যই দুই বিশেষ ফুটবল সমর্থক গণেশ দাস ও প্রদীপ দাসের প্রিয় ক্লাবের প্রতি আবেগ, ভালোবাসার গল্প। ২০২৪-এর ১৮ আগস্ট, গোটা বাংলা এক অন্য রূপ দেখেছিল ময়দানের। আরজি কর কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে অভয়ার ন্যায় বিচারের দাবিকে সামনে রেখে মুখর হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই ক্লাবের সমর্থকরা। বরাবর যারা পরস্পরের উদ্দেশে গ্যালারি থেকে বিষোদ্গারে ব্যস্ত থাকে, তারাই পরস্পরের হাত ধরে মুখর হয়েছিল মিছিলে, এক ‘অন্য ডার্বি’-র উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল সল্টলেক স্টেডিয়াম চত্বরে। সবুজ-মেরুন সমর্থকের কাঁধে চড়ে লাল-হলুদ অনুরাগীর দীপ্ত স্লোগান, জনতার সেই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ আজ ইতিহাস। সেই অতীতকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন লেখক তাঁর এ গ্রন্থে। সাদা মলাটের ওপর দুই কিংবদন্তি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও জহর রায়ের কাঁধে হাত রেখে ছবি, হাতে ধরা ইলিশ-চিংড়ি, বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টানোর আগেই প্রচ্ছদে চোখ আটকাতে বাধ্য পাঠকের। তার সঙ্গে লেখক অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাবলীল গদ্য ‘মোহন বেঙ্গল’কে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আক্ষেপ একটাই। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল শুধু নয়, তার সঙ্গে মহমেডান মিলে বাংলা ফুটবল পরিপূর্ণ। তিন প্রধানের কাউকে বাদ দিয়ে কেউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই ‘মোহন বেঙ্গল’-এর পর সাদা-কালো শিবিরের ইতিহাসও লেখকের কলমে বাঙ্ময় হোক, তার অপেক্ষা থাকল।
মোহন বেঙ্গল
অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শালিধান
৩৪৯ টাকা