এই বই আত্মজীবনী নয়, তবে আত্মজৈবনিক অবশ্যই। এবং আমরা সেই জীবনের সমান্তরালে পথ হাঁটছি। পরিচিত বা অপরিচিত হওয়া তাই ম্যাটার করে না। লেখার ঔজ্জ্বল্যে পরিচয়বাচক সম্পর্কগুলি ফিকে হয়ে আসে– যেভাবে দুপুরের সূর্যের সামনে চাঁদ।
বিধিবদ্ধ একখানি সতর্কীকরণ জানিয়ে লেখা শুরু করি।
‘পথের বাঁকে এসে’ বইটির লেখক কুণাল ঘোষ আমার পরিচিত। সাংবাদিকতা ঘিরে রোজ এটা-সেটা নিয়ে কথা হয়। ফলে তাঁর বই নিয়ে দু’-ছত্র লেখার সময় নিরপেক্ষ থাকার প্রশ্নটি উঠবেই। কিন্তু বেঁচে গেলাম, বইটির কনটেন্টের গুণে ও বৈভবে। ব্যক্তিগত বিষয়কে, কী করে দূরের ও সার্বিক করে তুলতে হয়, তা যেমন তিনি হাতেকলমে দেখিয়েছেন– তেমনই অ-ব্যক্তিগত, কখনও বা নেহাত বস্তুগত বিষয়কে, কেমন করে জারিয়ে নিয়ে হয় স্মৃতি ও সত্তার মিশেলে, সে-ও তুলে ধরেছেন অপূর্ব সাবলীলতায়।
কুণালদা, এই মুহূর্তে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর ‘কনসাল্টিং এডিটর’। তাই ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে টেনেই একটি লেখার উল্লেখ করি। ১৯৯৮ সালের ২৩ অক্টোবর– ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে দেখলে, ২৫ বছরের ওপারের এক পৃথিবী– ‘সংবাদ প্রতিদিন’ প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার উপজীব্য– লাদেনের নেতৃত্বে সংগঠিত জঙ্গিবাহিনী, নিউ ইর্য়কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা চালাবে।
সময়ের ফাতনাটিকে আরও একবার নির্দিষ্ট করে দিতে চাইছি। ঠিক পড়লেন, ১৯৯৮ সালে এই খবর ‘ছাপা’ হচ্ছে। কারগিল যুদ্ধ হবে ১৯৯৯ সালে। তার আরও দু’-বছর পরে, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে পড়বে। সাক্ষর সেনগুপ্তর সঙ্গে জয়েন্ট বাইলাইনে কপিটি লিখেছিলেন কুণাল ঘোষ।
নতুন শতাব্দীর চকমকে ডিজিটালাইজড গোলার্ধে দাঁড়িয়ে ভাবতে বসলে, মাথা ঝিমঝিম করে। জিভ জড়িয়ে যায়। এমন খবর যদি ‘দ্য নিউ ইর্য়ক টাইমস’ বা ‘বিবিসি’ করতে পারত! সহজ উত্তর, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার কাচের ওয়াইন গ্লাসের মতো ধূলিসাৎ হয়ে যেত না। কিন্তু ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ বেরনোর পরে তখন কেমন ‘প্রতিক্রিয়া’ হয়েছিল এই প্রতিবেদনের? কুণাল ঘোষ লিখেছেন, ‘এহেন এক্সক্লুসিভে খানিকটা হাসির খোরাক হলাম। কে লাদেন, যে নিউ ইর্য়কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হানা দেবে? কারা লেখে? পাগল নাকি? আর কাশ্মীরে জঙ্গি জমায়েত হচ্ছে বললেই হল। ওখানে সেনা নেই? মোদ্দা কথা, এক্সক্লুসিভ নয়, মূলত আর্বজনা বলেই চিহ্নিত হল প্রতিবেদনটি।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আলাদা করে বলতে হবে, কুণাল ঘোষের গদ্যের কথা। নির্মেদ, বারুদধন্য। তরতরে নদীটির মতো এগিয়ে যায়, আর দরকারে সমুদ্রের গর্জন ফিরিয়ে দেয় পাঠকের মনে। আর একটা উল্লেখের বিষয়, সেই অর্থে বঙ্গ-রাজনীতির আধুনিক ইতিহাস তো লেখা হয়নি। ভবিষ্যতে যদি তা লেখা হয়, বা ইতিহাসপ্রিয় কেউ যদি ফিরে দেখতে চান অতীতকে, তবে কুণালের এই লেখাগুলো তাঁকে নৈর্ব্যক্তিকভাবেই রসদ জোগাবে। রাজনৈতিক কুণাল ঘোষ যে সাংবাদিক কুণাল ঘোষের কলমটি গ্রাস করেনি, সমকালীন আলোচনার অপচয় পেরিয়ে ভাবীকাল, নিশ্চিতই তা উপলব্ধি করবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো একটি ‘এক্সক্লুসিভ’ কী করে পরিণতির এই করুণ পারে এসে ধাক্কা খেল, কল্পনা করাও দুষ্কর। সন্দেহ নেই– যথোচিত মান বজায় রেখে, খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পরে, যদি পাঠকরা এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারতেন– ‘সংবাদ প্রতিদিন’ সাংবাদিকতার ইতিহাসে চিরকালীন স্থান আদায় করে নিত। আর, সাক্ষর সেনগুপ্তর সঙ্গে কুণাল ঘোষের নামও অক্ষয় হয়ে থাকত এক্সক্লুসিভের দুনিয়ায়।
বস্তুত, এই অভিজ্ঞতাটির উল্লেখ রয়েছে যে-লেখায়, তার নামই– ‘এক্সক্লুসিভের জন্ম ও মৃত্যু’। ব্রেকিং নিউজের অবিরল পুুচ্ছতাড়নায় ‘খবর’ যখন মুড়ি-মুড়কির বেরাদরি অর্জন করেছে, ‘আমরাই প্রথম দেখিয়েছি’ গোত্রীয় দাবিতে ‘এক্সক্লুসিভ’ প্রতিবেদন যখন চূড়ান্ত কৌলীন্য হারিয়েছে, তখন ওসামা বিন লাদেনের আগাম হামলার খবরকে আমরা এর সঙ্গে প্রতিতুলনায় অংশ নিতে বলবই না। ‘এক্সক্লুসিভ’-এর হাই-ফাই সংসারেও এটি উচ্চকোটির মর্যাদায় আসীন থাকবে।
রকমারি বিষয় ও ঘটনাকে কুণাল ঘোষ জিয়নকাঠির মাধুর্যে স্পর্শ করে-করে গিয়েছেন। এত স্পষ্টবাদী স্বরে কথা বলেছেন, এত ঘন করে অস্বস্তিকর জীবনের অধ্যায়গুলিকে তুলে ধরেছেন, পড়ার পরেও ঘোর কাটে না। উত্তর কলকাতার জীবনতরঙ্গ, জেলপর্বে থাকার সময় দুর্গাপুজোর সময়ের মনকেমন, সাংবাদিকতা ইত্যাদি, যেমন এই বইয়ের সূচিতে স্থান পেয়েছে– তেমনই এসেছে রাজনীতি, বিদেশ সফর, ক্রীড়ার জগৎ। বিষয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে বৈচিত্র। অনুভবকে রাঙা করেছে অভিজ্ঞতা। বাস্তবের ছায়াকে শাসন করেছে পরাবাস্তবের রৌদ্র।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সম্পদ ও বিপদ– কলকাতা দুই-ই দিয়েছিল বিবেকানন্দকে, প্রাণভরে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
একটি উদাহরণ তুলে ধরেছি মাত্র। অথচ বইটি উদ্ধৃতিযোগ্য বাক্যের শিকলে আগাগোড়া বাঁধা। আর আলাদা করে বলতে হবে, কুণাল ঘোষের গদ্যের কথা। নির্মেদ, বারুদধন্য। তরতরে নদীটির মতো এগিয়ে যায়, আর দরকারে সমুদ্রের গর্জন ফিরিয়ে দেয় পাঠকের মনে। আর একটা উল্লেখের বিষয়, সেই অর্থে বঙ্গ-রাজনীতির আধুনিক ইতিহাস তো লেখা হয়নি। ভবিষ্যতে যদি তা লেখা হয়, বা ইতিহাসপ্রিয় কেউ যদি ফিরে দেখতে চান অতীতকে, তবে তাঁর এই লেখাগুলো তাঁকে নৈর্ব্যক্তিকভাবেই রসদ জোগাবে। রাজনৈতিক কুণাল ঘোষ যে সাংবাদিক কুণাল ঘোষের কলমটি গ্রাস করেনি, সমকালীন আলোচনার অপচয় পেরিয়ে ভাবীকাল, নিশ্চিতই তা উপলব্ধি করবে।
‘পথের বাঁকে এসে’ বইটির প্রতিটি লেখা নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর সম্পাদকীয় পাতায়। ‘কলাম’ রূপে। কলামটি এখনও বহমান ও ফলবতী। ফলে বাকি লেখাগুলি নিয়ে যে দ্বিতীয় পর্বও গ্রন্থবদ্ধ হবে, বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বই আত্মজীবনী নয়, তবে আত্মজৈবনিক অবশ্যই। এবং আমরা সেই জীবনের সমান্তরালে পথ হাঁটছি। পরিচিত বা অপরিচিত হওয়া তাই ম্যাটার করে না। লেখার ঔজ্জ্বল্যে পরিচয়বাচক সম্পর্কগুলি ফিকে হয়ে আসে– যেভাবে দুপুরের সূর্যের সামনে চাঁদ।
পথের বাঁকে এসে
কুণাল ঘোষ
পত্র ভারতী। মূল্য ৪৫০ টাকা