নাইট স্কুলে পড়াতে যাওয়ার সময় কবি দেখেছিলেন, ঋণ শোধ করতে না পারায় পাওয়াদাররা হুমকি দিয়ে যান এক প্রৌঢ়কে। কিছু পরেই সেই প্রৌঢ় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে নেন। জ্বলন্ত অবস্থায় রাস্তায় দৌড়াচ্ছিলেন সেই প্রৌঢ়। সকলেই বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। এই দৃশ্য দেখে তিনি অনুধাবন করেন ‘গরিব লোকেরাও দলিত’।
‘একটা লোক দুটো মানুষের কাঁধে জোয়াল চাপিয়ে আইনোরুর জমিতে লাঙল দিচ্ছে। ছোট ছোট পায়ে দু’জন মানুষ বলদের মতো করে হাল টানছে আর পিছন থেকে একজন চাবুক চালাচ্ছে…। তারপরই দেখলাম যারা লাঙন টানছিল তাদের মধ্যে একজন আমার বাবা।’ এটি কন্নড় কবি সিদ্দালিঙ্গাইয়া আত্মজীবনীর একটি অনুচ্ছেদ।
দলিত কবি বা সাহিত্যিকের আত্মজীবনীমূলক লেখার সংখ্যা কম নয়। তবে সিদ্দালিঙ্গাইয়ার আত্মজীবনী ‘আমারও কিছু বলার আছে’ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কেন গুরুত্বপূর্ণ? সাধারণত দলিত সাহিত্যিকরা বর্ণ বৈষম্য, শোষণ, অত্যাচার, সংবেদনশীলতা বর্ণিত করেন। এই আত্মজীবনীতে মজার ছলে বর্ণিত হয়েছে এসব। বর্ণ বৈষম্যের অন্তর্নিহিত চিত্র তুলে ধরে, বারবার লেখক প্রশ্ন ছুড়েছেন, সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে। দলিত আন্দোলনের ইতিহাস সফলভাবে সংযুক্ত হয়েছে। নিম্নবর্গীয় সমাজচিত্র, কুসংস্কার, বর্ণ বৈষম্যজনিত হিংসা-সহ নানা ঘাত-প্রতিঘাতের আখ্যান এখানে মেলে। নিজের সংগ্রাম, দুর্দশার কথা বলেছেন লেখক। চারপাশের জীবন-যাপনচিত্রকে তুলে ধরেছেন।
পাঠ করতে গিয়ে, আমার জীবনের ব্যক্তিগত বেশ কিছু স্মৃতি ভেসে উঠেছে বারবার। বহু ঘটনার সঙ্গে মিল পেয়েছি। বর্ণ বৈষম্যের শিকার আমার বাবা-মা, আমি নিজেও। কন্নড় কবির জীবনে, ঘটে চলা মুহূর্তগুলির সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছি বারবার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সিদ্দালিঙ্গাইয়া প্রথমদিকে, একটি কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছিলেন। সুপারভাইজার পদে। তবে সেই কাজ তিনি পারেননি। তাই তাঁকে শাস্তিস্বরূপ, একটি ভোজ বাড়িতে পাঠানো হয়, এঁটো পাতা তোলার জন্য। পাতা তুলতে তুলতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। পাতা তুলে অন্যত্র ফেলতে হচ্ছিল। তাঁকে যাতে কেউ না চিনে ফেলে, তার জন্য মুখে কালি মেখেছিলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
শৈশবে, পড়াশোনায় বারবার ব্যাঘাত ঘটেছে সিদ্দালিঙ্গাইয়ার। একাধিকবার স্কুলছুট হয়েছেন। নাইট স্কুলে পড়াশোনা। শেষে, যে হস্টেলে তাঁর মা সাফাইকর্মী হিসেবে কাজ করতেন, সেখানে থেকে পড়াশোনার সুযোগ পান। হস্টেলেও ছিল খাদ্য সংকট। পেট পুরে খেতে পেত না কোনও ছাত্রই। তাই ৩০০ জন ছাত্র একত্রে রাস্তায় বেরিয়ে যেত, অন্যের কাছে খাদ্যসামগ্রী চাইতে। সেই সব খাদ্য সামগ্রী নিয়ে এসে চলত রান্নাবান্না। হস্টেলের মধ্যেই কিছু ছাত্রের বাড়ির অবস্থা ছিল কিছুটা ভালো। সেই সব ছাত্রের বাক্সে থাকত আপেল, স্ন্যাকস বা অন্য খাদ্যসামগ্রী। সেই খাবারও, সহপাঠীদের সঙ্গে চুরি করে খেয়েছেন লেখক ও তাঁর সহপাঠীরা।
ছাত্রজীবনে বন্ধুদের বাড়িতে গিয়েছেন সিদ্দালিঙ্গাইয়া। খাবার খেতে বসেছেন। সেই খাবারের থালা, বন্ধুর মা অন্যত্র সরিয়ে রাখেন। যা নজর এড়ায়নি লেখক ও তাঁর বন্ধুর। এই অনুচ্ছেদটি পাঠ করতে গিয়ে, আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল একটি ছবি। আমি পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর কলেজে পড়েছি। কিছু বন্ধুবান্ধব জুটেছিল। তো একবার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমাকে বসতে দেওয়া হল, ঘরের ভিতরে নয়, উঠোনে। বন্ধুর মায়ের বানানো চা এল। সঙ্গে বিস্কুট। পেটে খিদে ছিল। খেলাম। চা খাওয়া শেষে আমাকে বলা হল, কাপ ধুয়ে দিতে। সেই কাপ ধুয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম। যে বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম, তারা জাতিতে ছিল ব্রাক্ষ্মণ।
সিদ্দালিঙ্গাইয়া, আর্ট কলেজে যখন পাঠরত, সেই সময় এক শিক্ষক তাঁকে খাবার জল আনতে নির্দেশ দেন। পরে যখন সিদ্দালিঙ্গাইয়ার জাত জানতে পারেন শিক্ষক, জল আনতে নিষেধ করেন।
সিদ্দালিঙ্গাইয়া প্রথমদিকে, একটি কারখানায় কাজে যোগ দিয়েছিলেন। সুপারভাইজার পদে। তবে সেই কাজ তিনি পারেননি। তাই তাঁকে শাস্তিস্বরূপ, একটি ভোজ বাড়িতে পাঠানো হয়, এঁটো পাতা তোলার জন্য। পাতা তুলতে তুলতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। পাতা তুলে অন্যত্র ফেলতে হচ্ছিল। তাঁকে যাতে কেউ না চিনে ফেলে, তার জন্য মুখে কালি মেখেছিলেন।
সিদ্দালিঙ্গাইয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পদে যোগ দিয়েছিলেন। সঙ্গে চলছিল, তাঁর দলিত সাহিত্য নিয়ে আন্দোলন। জাতিভেদের কথা বলতে গিয়ে রক্তাক্ত হয়েছেন বারবার। হামলার শিকার হয়েছেন। দমে যাননি। পিছিয়ে আসেননি। দলিত বান্ডায়া আন্দোলন, তাঁর নেতৃত্বে পূর্ণতা পেয়েছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: বিষয় আফগানিস্তান: ক্ষমতা দখলের অন্ধকার সিংহাসন ও মানুষ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিয়ে সিদ্দালিঙ্গাইয়া দেখেছিলেন পেশাগত বিভাজন। সরকারি উচ্চপদে আসীন সাহিত্যিক হলে আলাদা ব্যবস্থাপনা, আর অধ্যাপক হলে আলাদা ব্যবস্থা। এর প্রতিবাদে সরব হয়েছিন কন্নড় কবি।
সিদ্দালিঙ্গাইয়া, নিজের আত্মজীবনী শুধু লেখেননি। তাঁর চারপাশ, জীবনচিত্র, শ্রেণিবিন্যাস, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সংস্কার, রূপকথা-লোকগাঁথা নানা বর্ণনা দিয়েছেন। নাইট স্কুলে পড়াতে যাওয়ার সময় কবি দেখেছিলেন, ঋণ শোধ করতে না পারায় পাওয়াদাররা হুমকি দিয়ে যান এক প্রৌঢ়কে। কিছু পরেই সেই প্রৌঢ় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে নেন। জ্বলন্ত অবস্থায় রাস্তায় দৌড়াচ্ছিলেন সেই প্রৌঢ়। সকলেই বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। এই দৃশ্য দেখে তিনি অনুধাবন করেন ‘গরিব লোকেরাও দলিত’। আরও একটি কাহিনির বর্ণনা দিয়েছেন সিদ্দালিঙ্গাইয়া। ভুট্টা চুরির অপরাধে, কয়েকজন দলিতকে শাস্তি হিসেবে ‘গু’ খেতে বাধ্য করেছিলেন, এক কারখানার ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
ওই ঘটনার কয়েক দশক পরেও, সেই ছবির বদল হয় না ভারতে। এখনও বিভিন্ন রাজ্যে দলিতদের শোষণ, নিষ্পেষণের ঘটনা, বারবার উঠে আসে। কয়েক মাস আগেই মধ্যপ্রদেশে উচ্চবর্ণের এক ব্যক্তিকে ছোঁয়ায়, এক দলিতকে মল-মূত্র খাওয়ানোর ঘটনা ঘটে।
বিপ্লবী গান লেখার কারণে, একবার সিদ্দালিঙ্গাইয়ার জেলের যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। এর জেরে তাঁর বাবা কবিতার খাতা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাতে ১০০টির বেশি কবিতা ছিল। কয়েক বছর পর অবশ্য যখন কবিতার বই বের হয়েছিল, তাঁর বাবা সেই বই উল্টে-পাল্টে দেখছিলেন।
সিদ্দালিঙ্গাইয়ার ‘ওরু কেরি’ কন্নড় ভাষায় লেখা আত্মজীবনী গ্রন্থ। তার ইংরেজি অনুবাদ করেন এস আর রামকৃষ্ণ। নাম, ‘A Word With You, World: The Autobiography of a poet’– এই গ্রন্থ সম্পর্কে ডি আর নাগরাজ লিখেছেন, ‘সিদ্দালিঙ্গাইয়ার আত্মজীবনীতে দলিত সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান রয়েছে, যেমন দারিদ্র, ক্ষোভ ও অপমান। কিন্তু এই আত্মজীবনীতে আমরা একটি নতুন ও অভাবনীয় বিষয় দেখতে পাই, তা হল, দারিদ্র ও হিংসার মুখোমুখি হয়েও কোনোরকম ভয়ের উল্লেখ নেই। যদিও এই আত্মজীবনী আরও অন্যান্য দলিত সাহিত্যের মতো, একইরকম বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত। কিন্তু তাঁর রচনাশৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য দলিত সাহিত্যের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। একটি দলিত কাহিনিতে, যদি দারিদ্র এবং জাতিগত অপমান, বৈষম্য না থাকে তবে তা মিথ্যে হয়ে যায়। কিন্তু সেই জাতিগত অপমানকে লেখক পিছনে ঠেলে দিয়ে চেষ্টা করছেন অগ্রগতির দিকে যাওয়ার। তাই কবি সিদ্দালিঙ্গাইয়া ক্ষুধা ও অপমানের জীবন থেকে একটু সরে গিয়ে তথাকথিত জাতিগত বাধাকে অতিক্রম করে, তাঁদের জনজাতির অগ্রগতির পথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন।’
সিদ্দালিঙ্গাইয়া আধুনিক কন্নড় সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি নাট্যকার ও গণ আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। দলিত বান্ডায়া আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। দলিত সংঘর্ষ সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৮ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তিনি কর্ণাটক বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন। পেশাগতভাবে ছিলেন, ব্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্নড় সাহিত্যের অধ্যাপক।
সিদ্দালিঙ্গাইয়ার আত্মজীবনী, ইংরেজি থেকে বাংলায় অধ্যায়-ভিত্তিক অনুবাদ করেছেন ২৫ জন। সম্পাদনা করেছেন, মৃন্ময় প্রামাণিক। প্রতিটি অধ্যায় সুসম্পাদিত।
আমারও কিছু বলার আছে: একজন কন্নড় দলিত কবির আত্মজীবনী
সিদ্দালিঙ্গাইয়া। সম্পাদনা: মৃন্ময় প্রামাণিক
প্রকাশক: মান্দাস। ৫০০ টাকা