আট ও নয়ের দশক জুড়ে নাগরিক বিবর্তনের যে সংলক্ষণ ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছিল কলকাতার শরীরজুড়ে, তাকে ধরার চেষ্টা জারি রেখেছেন লেখক। জারি রেখেছেন কথা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কারণ, ‘তবুও ভাবনাবিলাস’ আসলে ‘ভাবনাবিলাস’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখকের আরেক উপন্যাসের পরবর্তী প্রয়াস। যেখানে শহরের আনাচে-কানাচে বাসা গড়ে থাকা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি, আরও স্পষ্ট বললে ‘গরিবগুর্বো’দের অস্তিত্বের জন্য লড়াইটাই মূল উপজীব্য।
টুকরো টুকরো স্বপ্নগুলো মেঘের খোল। জুড়লে পড়ে এক বুক আকাশ। দুঃখ-হতশায় কখনও তা কান্না হয়ে ঝরে। আবার আনন্দে-উল্লাসে সোনা-রোদ হয়ে ফোটে। মহানগরের পাদপ্রদীপের তলায় পড়ে থাকা ওই যে মানুষ, ব্যাষ্টি ও সমষ্টির সহাবস্থান মিলিয়ে ওই যে তাদের ঘরকন্না, তারই নাম জীবন। যে জীবন আসলে ভাঙা-গড়ার খেলা। সেই খেলায় মুখ অনেক, কিন্তু তার আধার এই শহর তিলোত্তমা। তাকে ঘিরেই পথহারা মানুষের আশ্রয় অনুসন্ধান, একটু থিতু হয়ে আঁকড়ে বাঁচায় চেষ্টা, সেই নিয়ত সংগ্রামে জীবনের দাঁড়িপাল্লা অনবরত ওঠানামা করে। ঘাত-প্রতিঘাতের চড়কি পাকে সেই দাঁড়িপাল্লায় হিসেব মেলে না। তবু মানুষ বাঁচে, ছিন্নমূল হয়ে, কোনও নির্দিষ্ট ভদ্রাসনে থিতু না-হয়েও ভূমিষ্ঠ স্বপ্নকে আঁকড়ে, বারবার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় দেশ তথা ভূখণ্ডের যে মানচিত্র, তাতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। স্বাধীনতা সেই পরিবর্তনকে চিরস্থায়ী করেছে। আর সেই রদবদলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের খাদ্য আর বাসস্থানের সংকট। অস্তিত্বের এই সংগ্রাম ব্যস্ত রেখেছে তাদের আত্মদ্বন্দ্বে, ভাবিয়ে তুলেছে আত্মজিজ্ঞাসায়। অন্নের তাগিদে মানুষ তত সংলগ্ন হয়েছে নগরসভ্যতার বুকে। কলকাতা– এই শহরের চার দেওয়াল, সেই চেনা ছকেই ‘মা অন্নপূর্ণা’ হয়েছে খেটে-খাওয়া মানুষের কাছে।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজ বদলায়। বদলে যায় মানুষের যাপন, জীবনকে দেখার ও বাঁচার দৃষ্টিভঙ্গী। সেই অভিপ্রায়কে আশ্রয় করে শহরও তার রং-রূপ বদলায়। কলকাতাও বদলেছে। সেই পরিবর্তন শুধু আড়ে-বহরে নয়, অন্তরেও। বিশ্বায়নের দমকা হাওয়ায় একান্নবর্তীর পলেস্তরা খসে পড়ে। ‘আয় আয় বেঁধে বেঁধে থাকি’র গিঁটগুলো আলগা হয়ে যায়। সুজিত হালদারের ‘তবুও ভাবনাবিলাস’ সেই ধ্বস্ত নগরজীবনের কথা বলে।
…………………………………………………………..
গ্রাম বদলে যায় শহরে। পুকুর ভরাট হয়ে, গাছগাছালির অস্তিত্ব মুছে মাথা তোলে কংক্রিটের জঙ্গল। আর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র? সেখানে মাথাচাড়া দেয় প্রমোটার-রাজ। টালিগঞ্জ থেকে টালা, একবালপুর থেকে ঢাকুরিয়া– মাথাচাড়া দেয় হাইরাইজ বিল্ডিং। অর্থের প্রলোভনে বিকিয়ে যায় মানুষ। চেনা মুখ মুছে যায়, হারিয়ে যায় নীরবদের ভালোবাসার, স্বপ্নের নিশ্চিন্দিপুর। স্মৃতিই তখন হয়ে ওঠে সম্বল। শরণার্থীর মতো তখন বিপন্ন ভবিষ্যৎ আঁকড়ে তারা ছড়িয়ে পড়ে শহর ছাড়িয়ে, শহরতলিতে।
…………………………………………………………..
আট ও নয়ের দশক জুড়ে নাগরিক বিবর্তনের যে সংলক্ষণ ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছিল কলকাতার শরীরজুড়ে, তাকে ধরার চেষ্টা জারি রেখেছেন লেখক। জারি রেখেছেন কথা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য, কারণ, ‘তবুও ভাবনাবিলাস’ আসলে ‘ভাবনাবিলাস’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখকের আরেক উপন্যাসের পরবর্তী প্রয়াস। যেখানে শহরের আনাচে-কানাচে বাসা গড়ে থাকা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি, আরও স্পষ্ট বললে ‘গরিবগুর্বো’দের অস্তিত্বের জন্য লড়াইটাই মূল উপজীব্য।
স্থান থেকে স্থানান্তরে, অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে মানুষের ভেসে বেড়ানোটাই এ-কাহিনির মূল প্রতিপাদ্য। আর সেই আখ্যানের দুই সূত্রধর দুই চরিত্র। একজন নীরব জোয়ারদার, অপরজন উপন্যাসের ‘গানবাবু’। দু’জনেই ভাবনা-বিলাসী। কলকাতা তাদের শয়নে-স্বপনে বিরাজ করে। একজন প্রিয় শহরকে নিয়ে বাণী রচনা করে, অপরজন তাতে সুর দেয়। সেই যুগলবন্দিতে তৈরি হয় কলকাতার পাঁচালি। এই পাঁচালি তাদের বেঁচে থাকার রসদ। এই ছদ্ম আবরণ সরিয়ে নিলে দুই চরিত্রের মধ্যে যে অনুসন্ধানী আত্মজিজ্ঞাসা, তাই এই উপন্যাসের চাবিকাঠি হয়ে ওঠে।
নীরব এবং গানবাবু– জীবনযুদ্ধে নানা ঝড়-ঝাপটা সামলে মানুষের বেঁচে থাকার অর্থকে তলিয়ে দেখতে চেয়েছে, নির্মোহ দৃষ্টিতে। আর সেই উপলব্ধির কেন্দ্রে বিরাজ করে শহর কলকাতা, তার সর্বগ্রাসী সত্তায়। যে শহর পুরাকালের কালীঘাট থেকে চিৎপুর নয়, আজকের বৃহত্তর কলকাতা। রক্তবীজের মতো যার অস্তিত্ব প্রকট শহর ছাড়িয়ে শহরতলিতে। যে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দাবিতে গ্রাস করে সংলগ্ন মফসসলকে। গিলে নেয় দক্ষিণের সোনারপুর, সুভাষগ্রাম কিংবা সন্নিকটের দমদম, বারাসত, মহিষবাথানকে। বেহালা বাড়তে বাড়তে ছুঁয়ে ফেলে ডায়মন্ড হারবারকে। ভোলবদলে যায় ইস্টার্ন বাইপাস সংলগ্ন অঞ্চলের। গ্রাম বদলে যায় শহরে। পুকুর ভরাট হয়ে, গাছগাছালির অস্তিত্ব মুছে মাথা তোলে কংক্রিটের জঙ্গল। আর কলকাতার প্রাণকেন্দ্র? সেখানে মাথাচাড়া দেয় প্রমোটার-রাজ। টালিগঞ্জ থেকে টালা, একবালপুর থেকে ঢাকুরিয়া– মাথাচাড়া দেয় হাইরাইজ বিল্ডিং। অর্থের প্রলোভনে বিকিয়ে যায় মানুষ। চেনা মুখ মুছে যায়, হারিয়ে যায় নীরবদের ভালোবাসার, স্বপ্নের নিশ্চিন্দিপুর। স্মৃতিই তখন হয়ে ওঠে সম্বল। শরণার্থীর মতো তখন বিপন্ন ভবিষ্যৎ আঁকড়ে তারা ছড়িয়ে পড়ে শহর ছাড়িয়ে, শহরতলিতে। এই ভাঙা-গড়ার পথ পরিক্রমাই শহরবাসের আদিকথা, ইতিকথাও। সেসবের সাক্ষী নীরব, গানবাবু, এবং তাদের ঘিরে বেঁচে থাকা কমলা, তান, বাড়িওয়ালি মাসিমা কিংবা অগণন প্রান্তিক মানুষ, যাদের দিন কাটে ওভারব্রিজের আলোয়, রেললাইনের ধারে অন্ধকারমাখা কলোনির আস্তানায়।
………………………………………………………………
আরও পড়ুন কিশোর ঘোষ-এর লেখা: দুই কবি, প্রেম আর বৃষ্টির কবিতা!
………………………………………………………………
নীরব ও গানবাবু– উপন্যাসের দুই সূত্রধর হলেও আখ্যানের পাঠসমীক্ষায় একটা ব্যাপার স্পষ্ট, নীরব চরিত্র নির্মাণে লেখক যতটা যত্নশীল, ততটাই উদাসীন গানবাবুকে গড়ে তোলায়। সুদর্শন থেকে স্বরূপ, গুণময় থেকে নীরবের পাশের ঘরের বুড়ো দাদু-বুড়িমা– সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও চরিত্রগুলি সংক্ষিপ্ত, সেভাবে দানা বাঁধেনি। কলকাতার পাঁচালির স্বরূপ ঠিক কী, সেটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি উপন্যাসে। তবে রাতের শিয়ালদা স্টেশন কিংবা ভিড়েঠাসা ক্যানিং লোকালের ভেন্ডার কামরার মৌতাত, এমনকী মশগুলে কফি-হাউসের বর্ণনায় লেখকের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন স্পষ্ট। সেটাই সুখপাঠ্য করে তুলেছে এই উপন্যাসকে। প্রচ্ছদভাবনায় ‘একুশ শতক’ একটু্ বেশি গুরুত্ব দিলে সেই সুখের মাত্রা আরও বাড়ত বইকি! তবে ‘ভাবনাবিলাস’-এর মতো যেহেতু ‘তবুও ভাবনাবিলাস’-এর প্রয়াস, সম্ভব হলে তারপর এবং তারপরও এই আখ্যানের পথ এগিয়ে চলতে পারে, সেই ইঙ্গিত উপন্যাসের নান্দীমুখে স্পষ্ট করে দিয়েছেন লেখক, তাই আগামীতে পূর্বের ত্রুটি শুধরে আরও প্রাঞ্জল হয়ে উঠবে ঔপন্যাসিকের ভাবনা, সে আশা করাই যায়।
তবুও ভাবনাবিলাস
সুজিত হালদার
একুশ শতক
২০০ টাকা