আমরা যদি উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে পাওয়া বাবুর টুকরো টুকরো সংগ্রহ করে আপন অভিজ্ঞতার ভিতর তাকে বসাই, তবে হয়তো দেখতে পাব নিজেকেই। যে জায়মানতা জীবনের ধর্ম, যা মানুষকে চলিষ্ণু করে রাখে, তাই-ই মানুষকে এই দু’-দণ্ডের অবসর মঞ্জুর করে। যেখানে দাঁড়িয়ে একবার পিছন দিকে ফিরে দেখে নিতে হয়, এই জীবন শুরুর দিনে কী ছিল, এখন কী হয়েছে, আগামীতে কোথায় চলবে।
জল ছুঁয়ে আকাশ। এক-ই সময়ে। চিতসাঁতারের আশ্চর্য কেরামতি। তবে, অত সুখ কি সইবে এক জীবনে! আস্ত জীবন তো বুঝেই উঠতে পারে না যে, কতখানি ডুব বাস্তব হলে ভেসে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠে! কতখানি স্মৃতি জমে উঠলে বেঁচে থাকার কোনদিকের পাল্লা ভারি; কতটা ভুলে-যাওয়া প্রখর হলে দাঁড়িপাল্লার কাঁটা ওঠানামা করে অবিরত; সেই সব অঙ্ক জীবনে মেলে না। তবু মানুষ তো মানুষ-ই। সে বেঁচে থাকে। সেটাই সবথেকে বড় আশ্চর্য। তবে, মানুষ কীভাবে বাঁচে? বদ্ধ একটা গ্রন্থির ভিতর তার চরকি-পাক খাওয়া! নাকি তার ভিতরই থাকে তার স্বতঃস্ফূর্ত জায়মানতা; এ-এক অপূর্ব দ্বন্দ্ব। মানুষ নিজেই মস্ত এক ধাঁধা। সে নিজের ইতিহাস নিজেই রচনা করে। মুশকিল হল সেই ইতিহাসের ভিতর তার ভূমিকাটি যে ঠিক কী হবে, এই নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকে না। জীবন অতএব গড়াতে গড়াতে এগিয়ে চলে সম্ভাব্য পরিণতির দিকে। এ যেমন দর্শনের একটা দিক, মার্কসীয় ভাবনা, তবে, এর অন্য পরতও আছে। আমাদের অস্তিত্বের ওপারে আছে হয়ে-ওঠার অনন্ত সম্ভাবনা। সার্ত্রে তাই ভাবেন, মানুষ সেই অর্থে বদ্ধ নয়; বরং সে সঞ্চারমান এবং অনির্দিষ্ট। কোনও স্থির কাঠামো দিয়ে মানুষকে, জীবনকে মেপে ফেলা হয়তো সত্যিই যায় না। কেননা অস্তিত্বের অনুসন্ধানে গিয়ে মানুষ একদিন টের পেতে পারে যে, যে-‘আমি’ তাকে আজীবন ভাবিয়েছে, সেই ‘আমি’ বস্তুত তারই পছন্দের সমষ্টি। অর্থাৎ ব্যক্তি একক, আবার একই সঙ্গে বহু মানুষের সমবায় তার সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে আছে। বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ হয়তো বা আছে, একেবারে অস্বীকার করা যায় না, তবু শেষ পর্যন্ত, মানুষ মুক্ত, গতিশীল। তার সত্তা চলিষ্ণু। অন্তত সেটুকুই তার অভিপ্রায়।
উজ্জ্বল সিন্হার উপন্যাস ‘উজানযাত্রা’য় শামিল হওয়ার আগে প্রারম্ভিক এই ভূমিকাটুকু আবশ্যিক হয়ে উঠল। কেননা এই উপন্যাস শুধুমাত্র কাহিনির বিন্যাসে মুগ্ধ করে রাখার জন্য লেখা নয়। বরং কাহিনির এই ছদ্ম-আবরণ সরিয়ে নিলে তা হয়ে ওঠে, একজন ব্যক্তির অস্তিত্বের অনুসন্ধান। ‘আমি’-র মুখোমুখি হয়ে, সেই ‘আমি’-কেই ব্যবচ্ছেদের আখ্যান। এই মহাবিশ্ব এবং মহাবিস্ময়ের মধ্যে যে আমি-র বিচরণ; সে গ্রহণ করছে, বর্জন করছে; নিজেই নিজেকে সন্দেহ করছে; আবার কখনও কাছের মানুষের প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হচ্ছে; আসলে ব্যক্তি মানুষ তো মানুষের সমবায়েরই অংশ। অতএব পাশের জনের প্রশ্ন, প্রকৃত প্রস্তাবে হয়ে ওঠে একজন মানুষের আত্মজিজ্ঞাসাই। নিজের প্রতিই ছুড়ে দেওয়া নিজের প্রশ্ন, আর সেই সূত্রে জীবন আর জীবনের মর্মের মুখোমুখি দেখা হয়ে যাওয়া; এই যে দ্বন্দ্বময়তা, ডুবে যাওয়া এবং ভেসে ওঠা, ভুলে যাওয়া আর স্মৃতি হাতড়ানো– এই নিরন্তর প্রক্রিয়াই আসলে মানুষকে সজীব, মুক্ত, অনুসন্ধানী করে রেখেছে। ধরা যাক, সেই অস্তিত্বের সন্ধানী সত্তাটির-ই নাম বাবু।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বাবু বা অস্তিত্বের সন্ধানে ঘুরছে যে-মানুষটা সে তাই পড়তে থাকে সময়ের উথাল-পাতালে। কেমন সেই সময়? উত্তরটা এরকম- ‘আজ অবরোধ তো কাল মিটিং-মিছিল, হরতাল আর পদযাত্রা। এখানে বাস-ট্রামে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলে ওখানে ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশ বেধড়ক পেটায় ছাত্রদের, গুলিও চলে প্রায়ই।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এখন এই বাবু কে? সহজ উত্তর, সে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাকে ঘিরেই লেখক গড়ে তুলেছেন আখ্যান। বেশ কয়েক পর্বে বিন্যস্ত সেই কাহিনি। বলা যায়, যেন ভাঁজে ভাঁজে খুলে গিয়েছে জীবন নিজেই। প্রতি ভাঁজেই আমরা বাবুকে পাচ্ছি নতুন করে। ছোটবেলার বাবুর দু’-চোখ মেলা বিস্ময়। একটা পরিবারের খুঁটিনাটির সঙ্গে তার মন বাঁধা। ফলে নানাদিকে লাগছে টান। বাবু সেদিকেই ফিরে তাকায়, আর সেই সূত্র ধরে উঠে আসতে থাকে বাঙালি যাপনের মঙ্গলকাব্য। সেই তোলা উনুন, ফ্যান সরিয়ে রাখা, ভিখারিদের ফ্যান দেওয়া সঙ্গে বাতাসা, সেই সদ্য শেখা দু’টি অপশব্দ, সে-শব্দের ছন্দে মনদোলা, সেই খাটা পায়খানা, সেই পরিবারের কর্তাটির হাঁকডাক– এ কি কেবল বাবুর একার? পরিজন, প্রিয়জনের সেই পৃথিবীটা বাঙালির নিজস্ব। মুশকিল এই যে, সে-পৃথিবী সে-শিশুর বাসযোগ্য থাকে না বেশিদিন। এই অমোঘ মেনে নিয়ে সেই কবে অপুকে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। বাবুও তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারে না। ফলে তাকে বেরিয়ে পড়তেই হয় মহানগরে, মানুষের মহা সম্মেলনে। এখানে সে সমষ্টির ভিতর একক। অতএব আবার শুরু নিজেকে খোঁজা। ‘আমি কে’-র মতো একখানা দার্শনিক প্রশ্নই তো আমাদের ব্যক্তিজীবনে নানা প্রেক্ষিতে ফিরে ফিরে আসে। আর সেই উত্তরের সমষ্টি হয়ে ওঠে গোটা জীবন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: রহস্য-রোমাঞ্চের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া হেমেন্দ্রকুমার উদ্ধার
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বাবু বা অস্তিত্বের সন্ধানে ঘুরছে যে-মানুষটা সে তাই পড়তে থাকে সময়ের উথাল-পাতালে। কেমন সেই সময়? উত্তরটা এরকম- ‘আজ অবরোধ তো কাল মিটিং-মিছিল, হরতাল আর পদযাত্রা। এখানে বাস-ট্রামে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলে ওখানে ক্যাম্পাসে ঢুকে পুলিশ বেধড়ক পেটায় ছাত্রদের, গুলিও চলে প্রায়ই।’ এই জীবনই আবার চিনতে শেখে প্রেম। একবুক তোলপাড় নিয়ে বুঝে নিতে জানে সেই প্রেম, যা সুখানুভূতি বয়ে আনে, তা যন্ত্রণাতে দীর্ণও করে। এই তার ধর্ম। বাবু এগোতে থাকে। জীবন থেমে থাকার নয়। বাবু যেন তাই এক-একটা উপাখ্যান থেকে পালাতে থাকে অন্য আর-একটায়। আমরা পাঠকরা জানি, এই যাত্রার শেষ নেই। এই যে পালিয়ে যাওয়া, অথবা এগিয়ে যাওয়া, এই যে পিছনপানে তাকানো– এ আসলে নিজেকে গ্রহণ এবং প্রত্যাখ্যানের এক অদ্ভুত মোকাবিলা। খেয়াল করলে দেখা যায়, এ-উপন্যাসে বাবু যা করছে, তা আসলে করে চলেছে একটা নির্দিষ্ট সময়পর্বের মানুষ। আধুনিকতা যাকে একইসঙ্গে দিয়েছে অগ্রসর হওয়ার উপহার আর উচ্ছিন্ন হওয়ার নিয়তি। একই সঙ্গে যে জানে বিশ্বজোড়া তার ভুবন, অথচ তার বুকের মধ্যে জেগে থাকে শৈশবের সেই টলটলে কালো দিঘির জল আর সেই পুরনো নিমগাছ। যে জানে, বিশ্বায়িত পৃথিবীতে সে নিজেই এক গ্লোবাল বাস্তবতা, অথচ তার মহাজীবনের ভিতর তার স্থানাঙ্ক চিহ্নিত হয়ে আছে তার স্মৃতির ভাঁড়ারঘরে। স্মৃতি ছাড়া আশ্রয় নেই, স্মৃতি তার একমাত্র দাঁড়ানোর জায়গা। ভিতরপানে তাকানোর চাবিকাঠি।
অতএব, বাবু একজন আধুনিক মানুষেরই সর্বজনীন প্রতিনিধি। সে একা, তবে একমাত্র নয়। আমরা যদি উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে পাওয়া বাবুর টুকরো টুকরো সংগ্রহ করে আপন অভিজ্ঞতার ভিতর তাকে বসাই, তবে হয়তো দেখতে পাব নিজেকেই। যে জায়মানতা জীবনের ধর্ম, যা মানুষকে চলিষ্ণু করে রাখে, তাই-ই মানুষকে এই দু’-দণ্ডের অবসর মঞ্জুর করে। যেখানে দাঁড়িয়ে একবার পিছন দিকে ফিরে দেখে নিতে হয়, এই জীবন শুরুর দিনে কী ছিল, এখন কী হয়েছে, আগামীতে কোথায় চলবে। জীবনের পূর্ণচ্ছেদ দেখে ফেলা মানুষের সাধ্যের অতীত। তবে, সে-গন্তব্য তার অজানা নয়। মধ্যের দুই সেমিকোলনের ভিতর যে একটুখানি দীর্ঘশ্বাস, আক্ষেপ, আনন্দ, মনস্তাপ, পরিতাপ, মাধুর্য ও বিধুরতা– তাকে উদযাপন করতেই হয়। জীবন আর কিছুই নয়, এই সবকিছুরই যোগফল। শেষ পাতায় যার হিসেব মেলানো আর হয় না মানুষের। শুধু জীবনভর অঙ্কটা এগিয়ে এগিয়ে চলে।
সুতরাং, সময় যখন আমাদের ছিন্ন করে, নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়, তখন অস্তিত্বের চিহ্নগুলো খুঁজে পাওয়া জরুরি। কেননা সেই চিহ্নই মানুষের পরবর্তী সমবায়ে পদ-ছাপ হয়ে থেকে যায়। মানুষ মিলিয়ে যায়, মানুষের গল্প ফুরোয় না। বাবুর গল্পেরও তাই শেষ নেই। যেখানে উপন্যাসের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি, সেখান থেকে যে কোনও বাবুর যাত্রা শুরু হতে পারে। সমষ্টির ভিতর একক আর এককের ভিতর সমষ্টির দ্যোতনায় বাবু আসলে সর্বনাম হয়ে ওঠে। তার ‘উজানযাত্রা’ তাই নানা অর্থে, নানা প্রেক্ষায় জীবনের উদযাপনই। উজ্জ্বল সিন্হা তাঁর এই উপন্যাসে পাঠককে ঠেলে দেন সেই উদযাপনে; বাবুর হাত ধরে তখন যে অভিযাত্রা শুরু হয়, তা পাঠকের নিজস্ব। অথবা সে-ও আসলে বাবুর-ই গল্প।
উজানযাত্রা
উজ্জ্বল সিনহা
দে’জ পাবলিশিং
৪৯৯ টাকা