ট্রেকিংয়ের জন্য সবথেকে বেশি কী প্রয়োজন বলে মনে হয়? টাকাপয়সা? ট্রাভেল কিট? ট্যুর গাইড? না। সময়, সুযোগ, ইচ্ছা, অর্থ আর শরীর না সঙ্গ দিলে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ দুঃসাধ্য বইকি! ‘সৃষ্টিসুখ’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে অয়নজিৎ মাহাতার ট্রাভেলগ ‘উত্তরাখণ্ডের কাশী’। লেখক এবং তাঁর সহকর্মীদের গন্তব্য ছিল পিন্ডারি গ্লেসিয়ার। অর্থাৎ পিন্ডার গঙ্গার উৎসে। হিমালয়ের অন্যতম প্রাচীন আর জনপ্রিয় ট্রেক রুট এই পিন্ডারি হিমবাহ। লেখক তাঁর লেখা শুধুমাত্র প্রকৃতি কিংবা হিমালয়ের বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি।
ওঁরা আটজন। বেরিয়ে পড়েছেন হিমালয়কে আরও কাছ থেকে দেখতে। আটজনই পেশায় শিক্ষক। কেউ রসায়ন, কেউ ভূগোল, কেউ গণিত তো কেউ পদার্থবিদ্যা। অয়নজিৎ মাহাতা, পেশায় কম্পিউটার শিক্ষক। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা বেড়ানোর নেশায় মশগুল। বন্ধুভাগ্য যেমন সবার সমান হয় না, তেমন সহকর্মীদের বন্ধু হিসেবে পাওয়াও বিরাট কপালজোর। বিশেষ করে তারা যদি ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে সমমনস্ক হয়, যাত্রাপথ যতই কঠিন হোক, সে পথে ক্লান্তি আসে না। একা হলে আপনি নিজেই একমেবাদ্বিতীয়ম্। দুই বা ততোধিকের মধ্যে যদি কেউ খেয়ালি মেজাজের হয়, তাহলে তেমন লোকজনের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার চেয়ে ঘরে বসে থাকা ভাল। কর্মক্ষেত্রের সৌজন্যেই অয়নজিৎ এবং তাঁর সহকর্মীদের প্রচেষ্টা ‘মিত্র ট্রেকার্স’। মিত্রতার ডাকে সাড়া দিয়েই তাঁদের পদব্রজে হিমালয় ভ্রমণ। পায়ে পায়েই আনন্দ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: কলকাতার ২০০ বছরের থিয়েটারের পথঘাট যেভাবে হাঁটবেন
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ট্রেকিংয়ের জন্য সবথেকে বেশি কী প্রয়োজন বলে মনে হয়? টাকাপয়সা? ট্রাভেল কিট? ট্যুর গাইড? না। সময়, সুযোগ, ইচ্ছা, অর্থ আর শরীর না সঙ্গ দিলে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ দুঃসাধ্য বইকি! ‘সৃষ্টিসুখ’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে অয়নজিৎ মাহাতার ট্রাভেলগ ‘উত্তরাখণ্ডের কাশী’। লেখক এবং তাঁর সহকর্মীদের গন্তব্য ছিল পিন্ডারি গ্লেসিয়ার। অর্থাৎ পিন্ডার গঙ্গার উৎসে। হিমালয়ের অন্যতম প্রাচীন আর জনপ্রিয় ট্রেক রুট এই পিন্ডারি হিমবাহ। লেখক তাঁর লেখা শুধুমাত্র প্রকৃতি কিংবা হিমালয়ের বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। স্থানীয় ইতিহাস, পুরাণের কাহিনি, স্থানীয় ও প্রচলিত বিশ্বাস, অভিযাত্রী ও অভিযানর কথা, রহস্যময় ঘটনা, হিমালয়ের প্রাচীন গ্রামের অধিবাসীদের জীবনযাত্রা, মন্দিরের বিবরণে সাজানো বইয়ের প্রতিটি অক্ষর। লেখায় উঠে এসেছে হিমালয়ের দুর্গম পথে চলার নানা সমস্যা এবং সমাধানের প্রসঙ্গ। পূর্ণিমার চাঁদের আলো হিমালয়কে আরও মোহময় করে তোলে। পাহাড়ে চাঁদের আকারকে আরও বড় মনে হয়। কালিঝোরে তেমন বড় চাঁদ চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতাও লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক। সারা আকাশ জুড়ে তারাদের ঝিকিমিকি। দূরের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ স্পষ্ট দৃশ্যমান। বাইরে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। শান্ত চরাচর। আকাশের তারাগুলোকে আঁকা মনে হয়। দূরে মুকুটের মতো দেখতে লাগে অন্ধকারে কালো হয়ে যাওয়া সব পাহাড়কে। হিমালয়ে কোলে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে যাওয়া।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
লেখকের রসবোধও চমৎকার। লেখার মধ্যে মধ্যে রয়েছে নানা মজার অ্যানেকডোট। যেমন অয়নজিৎ লিখছেন, হিমালয়ের রাজ্যে হাঁটতে এসেও বাঙালি তার স্বাতন্ত্র্য ভোলে না। সকাল-সন্ধে-রাত– যা-ই হোক, যত ঠান্ডাই পড়ুক বা যত দূরেই যেতে হোক, গামছা পরেই বেরিয়ে পড়তে পারে। তার সঙ্গে পায়ে থাকে সাধারণ চটি, পাহাড়ি রাস্তাতেও। ওই যাতে পা ধুয়ে নেওয়া যায় আর কী!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
‘মিত্র ট্রেকার্স’-এর সদস্যদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল রকমারি আড্ডা। প্রবল ঠান্ডায়, রাতের দিকে লেপ-কম্বল চাপা দিয়ে বা স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে চলে তাঁদের গল্পগাছা। লেখকের রসবোধও চমৎকার। লেখার মধ্যে মধ্যে রয়েছে নানা মজার অ্যানেকডোট। যেমন অয়নজিৎ লিখছেন, হিমালয়ের রাজ্যে হাঁটতে এসেও বাঙালি তার স্বাতন্ত্র্য ভোলে না। সকাল-সন্ধে-রাত– যা-ই হোক, যত ঠান্ডাই পড়ুক বা যত দূরেই যেতে হোক, গামছা পরেই বেরিয়ে পড়তে পারে। তার সঙ্গে পায়ে থাকে সাধারণ চটি, পাহাড়ি রাস্তাতেও। ওই যাতে পা ধুয়ে নেওয়া যায় আর কী! নাসিকার তর্জন-গর্জনেও কেউ কম যায় না। কারওর কী আর ঘুমের মধ্যে খেয়াল থাকে কে কতটা জোরে নাক ডাকে! মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল নাক ডাকার উৎসব!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: লেখক, প্রকাশকের জন্য ‘আত্ম-উন্নয়নমূলক’ কাজ
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
রণে, বনে, পথেঘাটে, বিপদে পড়লে মানুষ ঈশ্বরকেই স্মরণ করে। পরীক্ষা এবং ভ্রমণের আগেও। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। তাই ট্রেকে যাওয়ার পথেই বাগেশ্বরে বাগনাথ মন্দির-দর্শন। তখন প্রায় শেষ-বিকেল। সরযূ ও গোমতী নদীর সংগমস্থলে শিবের এই মন্দির আনুমানিক সপ্তম শতাব্দীর। অয়নজিতের লেখার বিশেষত্ব তাঁর গল্প বলার কৌশল। লেখাকে মূলত ভাগ করেছেন ছ’টি পর্বে। ‘উত্তরাখণ্ডের কাশী’, ‘শেষ গ্রাম’, ‘মনখারাপের দোয়ালি’, ‘পর্বতের মন্দির’, ‘হিমবাহের দেশে’, এবং ‘ফেরা’-এ। তাঁর ট্রেকিংয়ের বর্ণনা একটি আস্ত গাইড বুক। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ উৎসাহিত করবে। হিমালয় আরও কাছে টেনে নেবে। চলার পথে বাধা আসবেই। নামবে তুষার ধস। তবুও নিজের পথ নিজেকে তৈরি করেই এগিয়ে যেতে হবে। হিমালয় হয়তো কষ্ট দেয়। শারীরিক ক্ষমতাকে নিঃশেষিত করে আস্তে আস্তে। তবুও ‘মিত্র ট্রেকার্স’ বারবার ছুটে যায় হিমালয়ের কাছেই। এই কষ্টটাই ভাল লাগা। সেটা যাঁরা ট্রেক করেন, তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেন আরও। পিন্ডারি হিমবাহর পথ চড়াই। ধীরে ধীরে না উঠলেই বিপদ। হিমবাহর সুন্দর অথচ ভয়াল রূপের বর্ণনা লেখক যেভাবে করেছেন, এই ট্রাভেলগ আক্ষরিক অর্থে মানসভ্রমণ।
উত্তরাখণ্ডের কাশী
অয়নজিৎ মাহাতা
সৃষ্টিসুখ
১৯৯ টাকা