যুবক আবিষ্কার করে এত রূপ আর এত ক্ষত আপাদমস্তক নিয়েও যে কলকাতা আবহমান এবং বহমান, সেখানেই তো গঙ্গার বুকে নেমে আসতে পারে তরল ছলছল অন্ধকার। কলকাতা প্রকৃত প্রস্তাবে আশ্চর্যময়ী। ফলত তার রহস্যময়ী হাতছানিতে যাবতীয় আগল শুধুই নস্যাৎ হয়ে যায় যায়। গুন্টার গ্রাস তাই কলকাতাকে যতই ‘ঈশ্বরের বিষ্ঠা’ বলুন না কেন, সে তির্যকে কতক্ষণ আর থিতু হওয়া যায়! কলকাতা ভারি মিশুকে, গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে সে মিশে যায় অন্যের নির্জনতায়। যুবকটি দেখে, সে-ও মিশে গেছে কলকাতা অরণ্যের অমোঘ নেশায়।
কলকাতা একদিন ফুসলে নিয়ে গিয়েছিল সেই যুবককে। তিনশো বছর কিংবা তারও বেশি বয়সের প্রাচীনা ডাকিনী সে। কুহকে একবার কারও মাথা খেলে, মাথা ঠিক রাখা দায়! যুবকটিও তাই পথভোলা হল, ঘরছাড়া, তারপর সম্মোহিত কলকাতার উন্মুখ বেপরোয়া ফষ্টিনষ্টিতে। ফুটপাথে, কফিহাউসে, খালাসিটোলায় তখন কেবলই ক্রমাগত দুলে ওঠে তাদের যুগলছায়া। শ্বাস ঘন হয়ে আসে গাঢ় আলিঙ্গনে। রূপমুগ্ধ যুবক হেঁটে যায় কলকাতার বুকে আর ঘেঁটে দেখে কলকাতার মুখ। মুখের ওপর, যত আন্তরিক দেখা যায়, বিজবিজিয়ে ওঠে অফুরন্ত জীবন। মানুষ, মানুষ, নাছোড় মানুষ কলকাতার ত্বকে যুগ যুগ যাবৎ এঁকে দিয়ে চলেছে নখরাঘাত, সোহাগে– হয়তো বা। কলকাতা তো কাউকেই ‘না’ বলতে পারে না। প্রত্যাখ্যানের ভাষা তার অনায়াত্ত। হরেক কিসিমের চাহিদা, অভূতপূর্ব দাবি, মিছিল-মিটিং, নকশাল, বাস্তুহারা, সংস্কৃতি, ধান্দাবাজ, ধর্ম-অধর্ম, রাজনীতি নিয়ে তাকে চলতে হয় রোজ, যুবকটি জানে। কলকাতা নিজের অস্থিমজ্জায় মিশিয়ে নেয় সেই সব কিছুকেই, যেমনটা সকলকেই নিতে চায়, যুবককে হয়তো একটু বেশিই। যুবক আবিষ্কার করে এত রূপ আর এত ক্ষত আপাদমস্তক নিয়েও যে কলকাতা আবহমান এবং বহমান, সেখানেই তো গঙ্গার বুকে নেমে আসতে পারে তরল ছলছল অন্ধকার। কলকাতা প্রকৃত প্রস্তাবে আশ্চর্যময়ী। ফলত তার রহস্যময়ী হাতছানিতে যাবতীয় আগল শুধুই নস্যাৎ হয়ে যায় যায়। গুন্টার গ্রাস তাই কলকাতাকে যতই ‘ঈশ্বরের বিষ্ঠা’ বলুন না কেন, সে তির্যকে কতক্ষণ আর থিতু হওয়া যায়! কলকাতা ভারি মিশুকে, গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে সে মিশে যায় অন্যের নির্জনতায়। যুবকটি দেখে, সে-ও মিশে গেছে কলকাতা অরণ্যের অমোঘ নেশায়।
অথচ যুবকটিকে দাগিয়ে দেওয়া যেত স্পাই বলে। অন্তত রটনা সেরকম ছড়াতেই পারে। সময়টা তো ভালো নয়। অবশ্য কোন সময়ই বা ভালো যায়! ভালো-মন্দ তাই তেমন কাজের কথা নয়। সময়টাকে মেপে নেওয়া দু’-এক পোয়া ঘটনায়। এ হল সেই সময় যখন শুটিং-ফুটিং না থাকলে প্রায়ই সকালের দিকে গাড়ি চালিয়ে কফিহাউসে আড্ডা দিতে চলে যেতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা কবিতার ভুবন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সন্ন্যাসী রাজা শক্তি। যাপনের অবিন্যস্ততায় কেবলই কিসসার জন্ম। তবে ঘনিষ্ঠ চ্যালাই শুধু জানে যে মানুষটার ভিতরে বসত করে আর একজনা; যাঁর চিন্তায় প্রায় সব পরিস্থিতিতেই জায়মান নতুন কোনও রচনা। দ্বৈততার সেই অপূর্ব উদযাপন। ওদিকে খালাসিটোলার শাসন করছেন বাবু কমলকুমার মজুমদার, বাংলা গদ্যও। নিজস্ব জলছাপে বদলে দিচ্ছেন অথবা নতুন করে ভেঙে গড়ে নিচ্ছেন সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি। অতএব সুনীল, শক্তি, মোহিত, উৎপল, পৃথ্বীশ, ইন্দ্রনাথ, সন্দীপন, দীপেনের মতো ঝড়ো হাওয়া পাক খাচ্ছে তাঁকে কেন্দ্র করে। হাংরির দেখা তখনও নেই, সকলেই গোকুলে বাড়ছেন। পূর্ববঙ্গে চলছে রাজনৈতিক ঝঞ্ঝা, আঁচ কলকাতাতেও। ‘চান-তারা’ মার্কা পতকারা বদলে ‘লাল সূর্যখচিত সবুজ জমিনের পতাকা’র উড়ান সমাসন্ন। হিন্দুদের দলে দলে দেশ ছাড়তে হচ্ছে। আশ্রয় নিতে হচ্ছে প্রতিবেশী দেশে। সংস্কৃতির বৃত্তে বসে তা টের পাওয়া যাচ্ছে ভালোই। আর তখনই খেয়াল হয়, যুবকটি, যাকে ঘরছাড়া করেছিল কলকাতা, সে-ও তো এসেছে সেই ভূমি থেকেই। তাহলে অনন্ত রটনাসূত্রে তাকে কি স্পাই বলে ক্রুশকাঠে ফেলে দেওয়া যায় না! যেত, তবে, রুখে দাঁড়ালেন বাবু কমলকুমার। যে-ছেলে রাত্রিদিন তাঁদের সঙ্গেই পড়ে আছে, সে আবার স্পাই হতে যাবে কেন! স্পাইগিরি কি অতই সহজ! অতঃপর স্পাইগিরির আদিঅন্ত নিয়ে এক ঘণ্টা ঝাড়া বক্তৃতা। সব ঠান্ডা, সকল দ্বন্দ্ব ও সন্দেহের অবসান। সময়টা এরকমই, তাই বলে কি খুব সুখের সময়! ধর্মে ধর্মে ততদিনে বেশ ভালোরকমই ঘনিয়ে উঠেছে অবিশ্বাস। ছেচল্লিশের কিলিং ততদিনে গল্প থেকে আবার নতুন রূপে পুনরাবৃত্তিতে। পঁয়ষট্টিতে ফের ধর্মীয় সংঘর্ষের মুখোমুখি মানুষ। মানুষ মানুষকে কাটছে। মানবিকতার কী নিষ্ঠুর অপচয়! যুবকটি, কলকাতা যার মায়াতরণি, সাক্ষী সেই অনিবার্যের। একাত্তরে ঘনিয়ে ওঠে শ্রেণিসংগ্রাম। দাপুটে ইন্দিরা গান্ধী অবধি বুঝতে পারেননি, মধ্যবিত্ত ছাপোষা ডাল-ভাতের ঘরের যুবকবৃন্দ এমন বিপ্লবমুখর হয়ে উঠল কী করে! যুবকটি দেখতে থাকে, লিখতে থাকে। ভাঁজে ভাঁজে যেন তার সামনে খুলে যায় কলকাতা। উন্মুখ উন্মোচনে দিগন্তের অন্তহীন ইশারা। কলকাতার যেন কূল মেলে না!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: ঢাকা শহরে গেলে সবাই বদলে যায় কয়েক ঘণ্টার জন্য
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভুলে গেলে তবু চলে না যে, যুবকটি কবি। কলকাতাকে সে তাই নিজের মতো করে দেখতে জানে। আর তাই জানে যে, কলকাতা হাজার চারেক জুতো ‘পলিশঅলারও’ শহর। বৃষ্টি নামলে এ-শহরে আত্মহত্যা কমে যায়। আর অভিজাত মহিলারা ঠোঁটের কোণে বারোমাস ঝুলিয়ে রাখেন ‘শীতল কিন্তু যথাযথ মাপের পরিপাটি হাসি’। কলকাতার রাস্তায় রাজার মতো ঘুরে বেড়ায় গরু কিংবা ষাঁড়। কলকাতার রকবাজরা মূলত সন্ত। আর হাওড়া ব্রিজ কখনও নিঃশব্দ থাকে না, বরং ‘অপ্রতিরোধ্য কোনও বারাঙ্গনার মতোই সৌন্দর্যবিলাসীদের চোখ থেকে নিজের গোপনীয়তাকে রক্ষা করে সে। এই কলকাতা সর্বজনীন, তবু যে দেখতে জানে তো তারই। কলকাতা কি সবার কাছেই ধরা দেয় এমন উজ্জ্বল প্লাবিত উদ্ভাসে! বোধহয় না। প্রণয়ের মুহূর্তভাষ্য কোনও সাক্ষী চায় না। রূপানুরাগ এবং এই যুগলসম্ভাবনা তাই যুবকের নিজস্ব, একান্ত। অতএব নির্দ্বিধায় যুবকটি সেই কলকাতাকে বলে উঠতে পারে, ‘…লাস্যময়ী নটীর মতো ডাগর হয়েছ দিনে দিনে/তুমি আমার বিনাশ ও বেদনা তুমি আমার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ’। ব্যক্তিগত সেই দিনপঞ্জিতে গেঁথে আছে সময়ের ভাঙা কাচ। কেউ কেউ তা পেরিয়ে যেতে পারে সন্তর্পণে। কবি পারে না, যুবকটিও না। অতএব থেকে যায় রক্তক্ষরণের শুকিয়ে যাওয়া দাগ। যা দেখে ভাবীকাল চিনতে পারবে উত্তরপুরুষের অবস্থানকে। বলা যায়, ইতিহাস তো আছেই সেই ধরতাইটুকু দেওয়ার জন্য। তবে, কে না জানে, ইতিহাসের কার্পণ্য! এত এত মানুষের জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন তার জবানিতে মেলে না। তখন ওই কাচে বেঁধা কবির জীবনই হয়ে ওঠে মানুষের ইতিহাস। যুবকটি জানত, প্রেম তাকে পথে নামিয়েছে। যুবকটি তাই যাপনের আগুনে পুড়িয়ে পথের পাঁচালিটিকেই দিতে চেয়েছিল মহাকাব্যের ব্যাপ্তি। আর আমাদের এই উপমহাদেশে তো কাব্য আর ইতিহাসে ক্রমাগত শঙ্খ লেগে যায়। জোড়ে জোড়ে বাঁধা পড়ে মহাপৃথিবী, মানুষের।
রহস্যময়ী কলকাতা যুবকটির হৃদয় নিংড়ে ফতুর করে তাকে উপহার দিয়েছিল স্বর্গ আর নেশা। দিয়েছিল সখ্য আর কাব্যের সিন্দুক। বহুদিন পর যার ডালা খুললে বেরিয়ে আসে স্মৃতির সাপেরা। জড়িয়ে ধরে মন, ছোবল দেয় অকাতরে, জ্যান্ত হয়ে ওঠে নীলাভ আবছা দিন। জীবন আর জীবনের ভগ্নাংশ এসে বসে মুখোমুখি। অঙ্ক মেলে না, মেলারও নয়। শুধু সংখ্যার গায়ে লেগে থাকে অসংখ্য কিস্সা। তাকে যে কোনও নামেই ডাকা যায়– ইতিহাস কিংবা অফুরন্ত মায়া; অথবা শুধুই ভালবাসার খণ্ডকাব্য।
কলকাতা আর কবি বেলাল চৌধুরীর এক দশকের সহবাস-স্মৃতি এরকমই।
আমার কলকাতা
বেলাল চৌধুরী
সংকলন ও সম্পাদনা: পিয়াস মজিদ
প্রথমা প্রকাশন