বিবাহে বিভ্রাটের কাহিনিগুলি কমবেশি পরিচিত হলেও, সবগুলিকে একত্রে সংকলন করার বিষয়টি অভিনব। সাংবাদিকসুলভ অভিজ্ঞতায় বিবাহকাহিনির সঙ্গে তৎকালীন রাজনীতির যোগাযোগকেও বিশ্লেষণ করেছেন লেখক।
সারাটা জীবন হাতে হাত রেখে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দু’জনে, অথচ তাতে সামাজিক সম্পর্কের সিলমোহর পড়া কার্যত অসম্ভব। একে তো যুবকের চেয়ে বয়সে খানিক বড়ই তাঁর প্রেমিকা। উপরন্তু প্রায় ছোটবেলা থেকেই দু’জনে একই ছাদের তলায় একসঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, সম্পর্কে তাঁরা মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন। আর সেই সম্পর্কের দরুনই বিভ্রাটের মুখে পড়েছিল সত্যজিৎ আর বিজয়া রায়ের বিয়ে। রায় পরিবারে বিবাহ বিভ্রাট অবশ্য এই প্রথম নয়। সত্যজিতের পিসি লীলা মজুমদার নিজের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করার দরুন বাবা প্রমদারঞ্জনের সঙ্গে তাঁর আজীবনের মতো সম্পর্ক চুকে গিয়েছিল। পাত্রকে পছন্দ হলেও ব্রাহ্ম বিয়ের জায়গায় হিন্দু মতে বিয়েকে মেনে নিতে নারাজ ছিলেন প্রমদারঞ্জন রায়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়া স্বাভাবিক, কেশবচন্দ্র সেনের মেয়ে সুনীতির বিয়ের সময় হিন্দু বনাম ব্রাহ্ম রীতির বিবাদ ঘিরেই ভাঙন ধরেছিল ব্রাহ্মসমাজে।
আসলে, গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ ‘বিয়ে’ নামের এই প্রতিষ্ঠানটির উপর অনেকখানি নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল বলেই হয়তো সে প্রতিষ্ঠানের নীতিনিয়ম নিয়ে তার এত কড়াকড়ি। কথায় বলে, লাখ কথা না হলে নাকি বিয়ে হয় না। বস্তুত এ দেশের সমাজের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বহু মানুষের বিয়ের আগে পরে বাস্তবিকই কথার ঝড় বয়ে গিয়েছে। উনিশ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কাল ধরে সেই বিয়ে সংক্রান্ত সংকটগুলিকেই দু’মলাটে তুলে এনেছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়। কখনও সমাজের কোনও বিশিষ্ট জন, কখনও আবার তাঁদের সন্তানেরা রয়েছেন সেই সংকটের কেন্দ্রে। পারিবারিক, সামাজিক বা ধর্মীয় বাধা অতিক্রম করা সেইসব বিবাহ অনুষ্ঠান নিয়ে সেকালের পত্রপত্রিকা ব্যঙ্গবিদ্রুপে পাতা ভরিয়েছে, আর ফিসফিস কানাকানিতে একে অপরকে চোখ ঠেরেছে সেকালের সমাজ। সত্যজিৎ-বিজয়ার মতোই মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন অতুলপ্রসাদ এবং হেমকুসুমের বিয়ে, নজরুল-প্রমীলা কিংবা অরুণা গঙ্গোপাধ্যায় ও আসফ আলির ভিনধর্মে বিয়ে, আবার অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সরোজিনীর সঙ্গে অবাঙালি গোবিন্দরাজুলু নাইডুর বিয়ে— সমাজ ও সময়ের ভিন্ন ভিন্ন পর্ব থেকে এমনই একাধিক বিবাহ বিভ্রাটের কথা তুলে এনেছেন লেখক। ‘বিশিষ্টজনেদের বিবাহে বিভ্রাট বিবাহে বিপ্লব’ বইয়ে রয়েছে এমনই ১৬টি বিয়ের বর্ণনা।
যেমন ধরা যাক, বিদ্যাসাগরের কথাই। জ্বলন্ত চিতার আগুন থেকে যে বিধবা মেয়েদের ফিরিয়ে এনেছিলেন রামমোহন, সেই মেয়েদের ফের জীবনের স্বাদ দিতেই লাগাতার লড়াই ছিল তাঁর। তবুও, ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাশ এবং স্ব-উদ্যোগে একের পর এক বিধবার বিয়ে দেওয়ার পরও বিদ্যাসাগরকে শুনতে হয়েছিল, তাঁর সমাজসংস্কারের নিশানায় কেবল পরের ছেলেরাই কেন! পরবর্তীতে একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্র যে বিধবাবিবাহ করে তাঁর মুখরক্ষা করেছিলেন, সে কথা নিজেই বলেছেন বিদ্যাসাগর। যে ঠাকুরবাড়ির নির্দেশে এককালে বলেন্দ্রনাথের বিধবা স্ত্রী সাহানাকে পুনরায় বিয়ে করা থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেখানেই নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাল্যবিধবা প্রতিমার বিয়ে দেন তিনি। বাল্যবিধবা রাধারাণী দেবীর সঙ্গে নরেন্দ্র দেবের বিয়েতেও কনেকে স্নেহাশীর্বাদ পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু। সে বিয়েতেই আবার আত্মসম্প্রদান করে হিন্দু বিয়ের প্রচলিত নিয়ম ভাঙেন নবনীতা-র মা। ধর্ম আলাদা, তবুও ছন্নছাড়া নজরুল ইসলামের সঙ্গে একমাত্র মেয়ে প্রমীলার বিয়ে দিয়েছিলেন নিষ্ঠাবতী হিন্দু বিধবা গিরিবালা দেবী। একশো বছর আগেকার সেই বিয়েতেও কিন্তু বর কনে কারও ধর্ম পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়েনি। আবার আসফ আলি কিংবা অরুণা একে অপরের ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ করেননি, তবে নিঃসন্তান থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে সম্ভাব্য সামাজিক সমস্যাকে পেরিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। যে সমাজ ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ মন্ত্রে বিশ্বাসী, সেখানে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণও কম বৈপ্লবিক নয়। এইরকম বিয়েগুলি নিয়ে সেকালে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন অনেকেই, কিন্তু এই বিয়েগুলি বিবাহের ক্ষেত্রে সংস্কারের পথও অনেকখানি খুলে দিয়েছিল বলেই মনে করছেন এ বইয়ের লেখক। কেবল বৈপ্লবিক বিয়েই নয়, বিপ্লবের স্বার্থে বিয়ের উদাহরণও তিনি দিতে ভোলেননি। যেমন জাপানে গিয়ে আত্মগোপনের স্বার্থে তোসিকো-কে বিয়ে করেছিলেন রাসবিহারী বসু।
বিবাহে বিভ্রাটের কাহিনিগুলি কমবেশি পরিচিত হলেও, সবগুলিকে একত্রে সংকলন করার বিষয়টি অভিনব। সাংবাদিকসুলভ অভিজ্ঞতায় বিবাহকাহিনির সঙ্গে তৎকালীন রাজনীতির যোগাযোগকেও বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। এহেন বিতর্কিত বিষয় নির্বাচন করলেও আগাগোড়া নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছেন তিনি, যদিও রাণু-ভানুর সম্পর্কের মতো জটিল বিতর্ককে তিনি এড়িয়েই গিয়েছেন। তবে নিরাবেগ হতে গিয়েই হয়তো খানিক টান পড়েছে গদ্যের লালিত্যে।
বিশিষ্টজনেদের বিবাহ বিভ্রাট: বিবাহে বিপ্লব
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
মান্দাস
৩৫০্