তাঁর আঁকার মূল উপাদান এমন এক প্রকাশভঙ্গি, যা ছুঁয়ে যায় মানুষের নিত্য যাপন। যে স্টাইলের সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ হার্জ-এর ‘টিনটিন’-এর হাত ধরে। সেই একই ইউরোপিয়ান ‘ক্লিয়ার লাইন’ স্টাইলের ব্যবহার দেখা যায় তাঁর ছবিতে।
জীবনের প্রথম চাকরি রেজাল্ট বেরনোর পরদিন থেকে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য়। তারপর একে একে তাবড় সমস্ত হাউজে। খুশবন্ত সিং-এর সম্পাদনায় ‘নিউ দিল্লি’, ‘দ্য টেলিগ্রাফ’, ‘দ্য স্টেটসম্যান’। তিনি, স্বনামধন্য শিল্পী দেবাশীষ দেব। ইলাস্ট্রেশন, কার্টুন, ক্যারিকেচার, বিজ্ঞাপনের ছবি, বেড়ানোর ছবি, প্রচ্ছদ– কোনও জঁরই অধরা নেই তাঁর।
আঁকার ঝোঁক ছোট থেকেই। বাবার ‘ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স’-এ কাজ করার সুবাদে বাড়িতে আসত ১২ পাতার ইয়াব্বড় ক্যালেন্ডার। সাধারণ আঁকার খাতার মাপের চারগুণ। একটা করে মাস কেটে যাওয়ার পরই সেই মাসের ক্যালেন্ডারের পিছনের সাদা দিকটা হয়ে উঠত তাঁর আঁকার খাতা।
অলংকরণ করেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, তারাপদ রায়, বাণী বসু-সহ বহু বিশিষ্টজনের কাজ। নয়ের দশকে রবিবারের একটি ক্রোড়পত্রের জনপ্রিয়তা বাড়ার প্রায় সিংহভাগ ক্রেডিট তাঁরই। তাঁর আঁকার মূল উপাদান এমন এক প্রকাশভঙ্গি, যা ছুঁয়ে যায় মানুষের নিত্য যাপন। যে স্টাইলের সঙ্গে আমাদের প্রথম আলাপ হার্জ-এর ‘টিনটিন’-এর হাত ধরে। সেই একই ইউরোপিয়ান ‘ক্লিয়ার লাইন’ স্টাইলের ব্যবহার দেখা যায় তাঁর ছবিতে। আঁকার এহেন সহজ-স্বাভাবিক ছন্দের কারণেই আর্টের নাড়িনক্ষত্র না বুঝেও তাঁর ইলাস্ট্রেশনের সবটুকু আস্বাদ নিংড়ে নিতে পারে আমজনতা। কখনও তাঁর কলমে ধরা দেয় আমাদের নিত্যদিনের চেনা ঘটনা, কোথাও পলিটিক্যাল স্যাটায়ার, সমালোচনা, পানিং আবার কোনও বিশ্বকাঁপানো ব্রেকিং নিউজ।
১৯৭৮ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম অলংকরণ জুড়ে ছিল বিড়ালের উজ্জ্বল উপস্থিতি। ফলে তাঁকে আজীবন শুনতে হয়েছে ‘আপনার ছবি মানেই বেড়াল’। শিল্পীর মতে, ইলাস্ট্রেশনে খানিক বাড়তি মজার এলিমেন্ট যোগ করার জন্যই তিনি শরণাপন্ন হন পশুপাখির। কিন্তু ‘যেহেতু সাইজে ছোটো আর যত্রতত্র গতিবিধি বলে একটা বেড়ালকে অনায়াসে আলমারির মাথায়, ঝুড়ির নীচে কিংবা ছাদের আলসের ওপর বসিয়ে দেওয়ার সুবিধে আছে। ফলে আমার ছবিতে বেড়াল অন্যদের দিব্যি টেক্কা দিয়ে দিল।’ এমনকী, পাঠকের চাহিদা মেটাতে অনেক সময় নানা ছবিতে স্রেফ ‘ফিলার’ হিসাবে চলে আসে বেড়াল।
ব্যক্তিগত জীবনে আদ্যোপান্ত খাদ্যরসিক, তবে স্বল্পাহারী, তায় ফিটনেস ফ্রিক তিনি। কলকাতার কোথায় কোন খাবারের ডেরা, তা তাঁর নখদর্পণে। আঁকার টানে ঘুরে বেড়িয়েছেন বহু জায়গায়। সেখানকার স্কেচও চমক লাগায় দর্শকের।
তাঁর গুণের গুনতি দু’চার কথায় করা কঠিন নয়, বলা যায় অসম্ভব। বাকি অনকহিঁ-অনশুনি কিস্সার জন্য পড়ে ফেলতে হবে তাঁর বই ‘আঁকায় লেখায় চার দশক’, যা পুর্নমুদ্রিত হল এ বছরের বইমেলায়। বইটির প্রথম প্রকাশ ২০১৯ সালে। শিল্পীর প্রায় জীবনপঞ্জি ছাড়াও রয়েছে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার কথা। সঙ্গে বিশেষ কিছু ছবির সঙ্গে জুড়ে থাকা গল্প, শিল্পীর লেখা ডায়েরি, অপ্রকাশিত আঁকা-গুচ্ছ, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত লেখা ও কিছু বিশেষ সাক্ষাৎকার। বইটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন শিল্পী নিজে।
আঁকায় লেখায় চার দশক
দেবাশীষ দেব
প্রকাশক বুক ফার্ম। মূল্য ৯৯৯
এই সহস্রাব্দীতে বিশ্বের যে তিনটি বড় সংঘর্ষ, ইরাক, ইউক্রেন এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন, সবক’টাই কূটনৈতিক এবং শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ‘নিয়ন্ত্রিত’ভাবে যুদ্ধ জিইয়ে রাখা হয়েছে। আর তার জন্য বিশ্বজুড়ে নির্মিত হয়েছে বিপুলায়তন স্যাটেলাইট-টিভি নামক এক অ্যাম্ফিথিয়েটার।