১৯৮৩ থেকে ২০১৯– সময় নিরীক্ষণে ৩৬ বছর, ক্রিকেটের সেই প্রবাহমানতায় বিগত দশ বিশ্বকাপে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের রাজ সিংহাসনে পদার্পণ থেকে কক্ষচ্যুতি, সিংহাসন পুনরুদ্ধার থেকে বিয়োগান্তক ব্যর্থতা, মূর্ত হয়েছে লেখকের সহজাত ও সাবলীল দক্ষতায়। অতীতে ফেলে আসা সেই অভিজ্ঞতা, আবেগ, উত্তেজনা, বিতর্ক, সমর্পণ, বিচ্ছেদের সমাহার গ্রন্থরূপ পেয়েছে ‘বিশ্বকাপ তুঝে সেলাম’-এ।
‘তাই ভাবলে কেমন লাগে একটা স্বপ্নের পিঠে জিন দিয়ে জঙ্গল-পাহাড়-সমুদ্র পেরিয়ে এতদূর চলে এলাম। যে রাস্তার বাঁকে বাঁকে আরব্য উপন্যাস। সেই স্বপ্নকে সেলাম না জানালে গভীর পাপ হত!’ এক গভীর আত্মপ্রত্যয় এবং তমোঘ্ন অনুভূতিতে উপনীত হয়ে ‘বিশ্বকাপ তুঝে সেলাম’-এ দাঁড়ি টেনেছেন লেখক, ক্রীড়া সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য। সঙ্গে ছুঁয়ে গিয়েছেন তাঁর বহুল অভিজ্ঞতাময় ক্রীড়া সাংবাদিকতার এক অমোঘ পর্বকে। যার ধ্যানবিন্দুতে বিরাজ করছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ১৯৮৩ থেকে ২০১৯– সময় নিরীক্ষণে ৩৬ বছর, ক্রিকেটের সেই প্রবাহমানতায় বিগত দশ বিশ্বকাপে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের রাজ সিংহাসনে পদার্পণ থেকে কক্ষচ্যুতি, সিংহাসন পুনরুদ্ধার থেকে বিয়োগান্তক ব্যর্থতা, মূর্ত হয়েছে লেখকের সহজাত ও সাবলীল দক্ষতায়। অতীতে ফেলে আসা সেই অভিজ্ঞতা, আবেগ-উত্তেজনা-বিতর্ক-সমর্পণ-বিচ্ছেদের সমাহার গ্রন্থরূপ পেয়েছে ‘বিশ্বকাপ তুঝে সেলাম’-এ।
নিছকই অভিজ্ঞাত ঘটনার সাংবাদিকসুলভ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ নয়, সেই অনুবর্তনের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে ক্রিকেট ও কালচক্রের বিবর্তনকে তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক গৌতম ভট্টাচার্য। ৫০ ওভারের খড়-মাটির অবয়ব সংস্থানে সজ্জিত বিশ্বকাপের ক্রিকেট ক্লাসিকের দলিল রচনার জন্য তিনি এমন একটা সময় বেছে নিয়েছেন, যখন ওয়ান ডে ক্রিকেট বিপন্নতার চোরাবালিতে ক্রমশ বিলীয়মান। ৩৬ বছরের এই দীর্ঘ গৌরবময় ক্রিকেট-অধ্যায়ে ২২ গজের লড়াইকে ছাপিয়ে ড্রেসিংরুমের অন্তরালে লুটিয়ে থাকা নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে লেখকের উপজীব্য। সময়ের মায়াজালে সেই কথনকথায় সন্নিবিষ্ট হয়ে ‘টাইম ট্র্যাভেল’-এর আশ্চর্য মানসযানের হাতছানি অগ্রাহ্য করা পাঠকের দুঃসাধ্য। তন্নিষ্ঠ পাঠে, লেখক গৌতম ভট্টাচার্যের অনন্য বক্তব্য চয়নে তা যে সময়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই ঘটনাবহুল অভিজ্ঞতা লেখককে কখনও আকস্মিকতায় কম্পিত করেছে। কখনও বা স্নাত করেছে আবেগ মোহনায়। আবার কখনও তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন ঘটনার আবিলতায়।
১৯৮৩-কে লেখক সূচিত করেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের স্বাধীনতা লাভের ব্রাহ্মমুহূর্তরূপে। তিরাশির সেই স্বপ্নজয়ী জীবন্ত গল্পগাছা যা লেখক আত্মস্থ করেছেন সেই ইতিহাসসৃষ্টির কাণ্ডারীদের কাছে, তার উদ্ভাস ঘটেছে এই গ্রন্থের শুরুতে। তিলে তিলে সেই অভিজ্ঞতা বিশ্বকাপের ছায়াপথ ধরে এগিয়ে গিয়েছে ভবিষ্যতের সমাপ্তিযাত্রায়। সময় গ্রাস করেছে ’৮৩- র পরবর্তী ‘৮৭, ‘৯২-এর ব্যর্থতা, ‘৯৬-র স্বপ্নভঙ্গ, ‘৯৯-এর পিতৃবিয়োগে শোকানল সঞ্জাত শচীন, কিংবা ২০০৩, ’০৭-এর যন্ত্রণাকে। লেখকের মানসলোক অভিজ্ঞতার আলোয় পরিপুষ্ট হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতা আমরা দেখতে পাই শেষ তিন বিশ্বকাপে, সাফল্যের আলোয় ব্যর্থতার অন্ধকারে। স্মৃতিপটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই মণিমালাকে বিনিসুতোয় গেঁথেছেন গৌতম ভট্টাচার্য। রচনা করেছেন এক প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবিম্ব। সেখানে মন্থিত হয়েছে বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে ১০০টি স্মৃতি।
সেই দর্পণকে দশ অধ্যায়ে ও একশোটি উপপর্বে লিপিবদ্ধ করেছে ‘দীপ প্রকাশন’। সূচিপত্রে দশ অধ্যায়ের নামকরণের ক্ষেত্রে রাবীন্দ্রিকতার আশ্রয়, বিশ্বকাপের কথকতার আবহ নির্মাণকে আরও চমকপ্রদ করেছে। পরিশেষে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’-এর মতো ‘ডেথ ওভার’-এর উপস্থিতি লেখকের উৎকর্ষবোধ এবং গ্রন্থের আকর্ষণকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। যেহেতু দশ বিশ্বকাপের ঘরে-বাইরের নাটকীয় কাহিনি এই গ্রন্থের আধার, তাই প্রারম্ভিক পর্যায়ে ‘দশকাহন’ নামটাই বিবেচনা করেছিলেন লেখক গৌতম ভট্টাচার্য। তবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে উপমহাদেশীয় প্যাশনকে মান্যতা দিয়ে গ্রন্থের নাম ‘বিশ্বকাপ তুঝে সেলাম’ সঠিক নির্বাচন।
সবমিলিয়ে এ গ্রন্থ এক ক্রিকেট চলন্তিকা, সেখানে ২২ গজের চেনা কুশীলবরা ভিন্ন পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিতে ধরা দেন নতুনভাবে। তাঁদের অচেনা আলোয় আবিষ্কার করেন পাঠক। ক্রিকেটের নকশিকাঁথায় সেই চলিষ্ণু সময়কেই এঁকেছেন লেখক গৌতম।
বিশ্বকাপ তুঝে সেলাম
গৌতম ভট্টাচার্য
দীপ প্রকাশন। ২৭৫
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved