ঘরোয়া গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ছোট্ট বই। যে বই পড়ে কাছের, স্পর্শক্ষম মনে হয় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। লিখেছেন গগনঠাকুরের দৌহিত্র দ্বারকানাথ চট্টোপাধ্যায়। ‘টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ থেকে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল এই নাতিদীর্ঘ স্মৃতিগদ্য গ্রন্থটি। এই কলকাতা বইমেলায়, ‘খসড়া খাতা’ ও ‘টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশ পেল এই অমলিন বই।
কড়া রোদ এসে পড়েছে আবার। আকাশ বদলে যাচ্ছে গ্রীষ্মকালে। হাতে পেলাম এমন এক বই, যার প্রথম বাক্য: বাবা-মা নাম রাখলেন গগন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একবার। সবসময় তো বিস্তার বোঝা যায় না। ক্ষমতা বোঝা যায় না আকাশের। কিন্তু হঠাৎ, তালুর চেয়ে সামান্য বড়, চৌকো বইয়ের থেকে মাথা তুলে যখন এই সীমান্তহীন ওপরে তাকাই, তখন ঘুরে যায় মাথা! ‘উদার’ ও ‘গম্ভীর’– এই দু’টি শব্দ ডানা নামিয়ে স্থির হয়ে বসে গগন ঠাকুরের জীবনশৈলীতে, তাঁর ছবির কৌশলে ও মায়ায়। এই বই, যদিও শিল্পী গগন ঠাকুরের পরিচায়ক নয়, এই বই, পাঠকদের টেনে আনে ঠাকুরবাড়ির পুরনো অন্দরমহলে।
প্রথমে আসি, গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়। গগন ঠাকুরের বাবা। আমুদে, মজলিশি লোক। ছেলেবেলায় বউবাজারের ভাড়াটে বাড়ির আর্ট স্কুলের ঠিকানায় আঁকা শিখেছেন। তাঁর বৈঠকখানা বাড়ির হলঘরে নানা জ্ঞানীগুণির দেখা মিলত সন্ধে হতে না হতেই। গানে সুর দিতেন। নাটক লেখাতেও ছিল পারদর্শিতা। কিন্তু এই সব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয় তাঁর মঞ্চসজ্জা। নাটকের নাম ‘রাজর্ষি’। নাটকে নিশুতি রাতে বনপথের মধ্য দিয়ে যাওয়ার একটি দৃশ্য রয়েছে। যখন এই নাটক হচ্ছে, দেখা গেল, মঞ্চের গাছগুলোয় জোনাকি পোকা জ্বলছে-নিভছে। সকলেই হতবাক! কী করে হল এটা! কীভাবে সম্ভব! খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল, গুণেন্দ্রনাথ আগেই জোনাকি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, তারপর দৃশ্যমতো ছেড়ে দেন সেইসব জোনাকি।
গুণেন্দ্রনাথের কথায় যখন এলাম, সৌদামিনী দেবীর কথাও বলা যাক। সৌদামিনী দেবী গগন ঠাকুরের মা। একদিন গুণেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাংসারিক যুক্তি-প্রতিযুক্তি চলছে। বিষয়: তুমি কাকে ভালোবাস বেশি, নিজেকে না গগনকে? প্রশ্নকর্তা গুণেন্দ্রনাথ। সৌদামিনী দেবী, জোরের সঙ্গেই বলেছেন, গগনকে। এর পরের ঘটনাটি বিস্ময়কর! গ্রীষ্মকাল, গঙ্গার ধারের বাড়ির লাগোয়া শানবাঁধানো ঘাটে গল্পের আসর বসেছে। হঠাৎ ঝোপ থেকে আস্ত একটা বাঘ বেরিয়ে এল! এবং সক্কলে পড়ি-মরি দে ছুট ঘরের ভেতরে। ঘরে গিয়ে সৌদামিনী দেবীর খেয়াল হল, গগন আসেনি। চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেছেন। গুণেন্দ্রনাথ এই পরিস্থিতিতে টিপ্পনি কাটলেন, বললেন, নিজের প্রাণ বাঁচাতে ছেলেকে বাঘের মুখে দিয়ে এলে? জানলা খুলে দেখা গেল, ঘাটের ওপর বাঘ এবং গগন– দু’জনে গল্পে মশগুল। এই হল গুণেন্দ্রনাথ ও তাঁর নাটকীয় মীমাংসা। জানা যায়, বর্ধমান থেকে এই বহুরূপীকে আনিয়েছিলেন গুণেন্দ্রনাথ।
মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কাছে গিয়ে উপস্থিত কন্যাদায়গ্রস্ত এক গরিব ব্রাহ্মণ। কিন্তু দেখা করতে পারছেন না, কারণ দারোয়ানেরা কোনওভাবেই প্রবেশাধিকার দিচ্ছে না। গরিব ব্রাহ্মণটিরও জেদ তুলনাহীন। এত হট্টগোলে মহারাজ নিজেই দেউড়িতে নেমে এলেন, ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কী! সেই ব্রাহ্মণের কাতরোক্তি– তিনি গরিব, কন্যাদায়গ্রস্ত, কিছু অর্থ দিয়ে যদি মহারাজ সাহায্য করেন। কিন্তু শুধু উদ্বেগ নয়, ব্রাহ্মণের মুখে কিঞ্চিৎ হাসিরও আভাস ছিল। তা দেখতে পেয়ে, মহারাজের কৌতূহল হয়। জিজ্ঞাসা করেন এই হাসির কারণ। ব্রাহ্মণ দাড়ি-পরচুলা খুলে ফেলেন। দেখা যায়, তিনি গগনেন্দ্রনাথ! আসলে, এ ঘটনার আগের দিনই মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ঘোষণা করেছিলেন, শ্রেষ্ঠ ছদ্মবেশধারীকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। আর পরের দিন ভোরবেলাতেই, ছদ্মবেশে এসে পড়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথ!
‘ঘরের মানুষ গগনেন্দ্রনাথ’ বইতে ধরা পড়েছে এমনই চমৎকার কিছু কিংবদন্তি। ঘরোয়া, কাছের, স্পর্শক্ষম মনে হয়েছে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। লিখেছেন গগনঠাকুরের দৌহিত্র দ্বারকানাথ চট্টোপাধ্যায়। ‘টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ থেকে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকরের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল এই নাতিদীর্ঘ স্মৃতিগদ্য গ্রন্থটি। এই কলকাতা বইমেলায়, ‘খসড়া খাতা’ ও ‘টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর যৌথ উদ্যোগে প্রকাশ পেল এই অমলিন বই। বইটির অঙ্গসৌষ্ঠব চমৎকার। সে কারণেই দু’-একটি ছবি ছাপার ক্ষেত্রে তাল বিচ্যুতি চোখে লাগে। দিনশেষে গগন-প্রেমিকদের কাছে এই বই আদরণীয়।
ঘরের মানুষ গগনেন্দ্রনাথ
দ্বারকানাথ চট্টোপাধ্যায়
প্রথম খসড়া খাতা ও টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংস্করণ
২০০্
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এখন ৯০ বছরের। আমাদের একান্ত ইচ্ছা, শতবর্ষ পালনটা ওঁর সঙ্গে আমরা একসঙ্গেই করব। এই যে নাটকের একটা আলাদা সংসার এবং সে সংসারে সদস্যদের সবার মন জুগিয়ে, ভালো-মন্দ বুঝে দীর্ঘদিন ধরে কাজটা সুন্দর করে করলেন রুদ্রদা, সেটা ওঁর আজকালকার হাসি দেখেই বুঝতে পারি।