না, শিরোনামে ভুল নেই। যদিও এই নামের কবিতার বইও নেই। কবি আহমেদ রফিকের কাব্যগ্রন্থের তালিকার একটি বই, এই নামেই ছাপা হয়েছে শিমুল সালাহ্উদ্দিনের ‘কবির মুখোমুখি কবি’ বইতে। ভূমিকায় শিমুল লিখেছেন, ৭ বছরের দীর্ঘ পরিশ্রম ও খুঁতখুঁতানির পর প্রকাশিত হয়েছে এই বই। দীর্ঘসূত্রতা মানেই যে দুরন্ত কাজ, তা নয়, প্রমাণিত। স্বল্প সময়ের শ্রমে ও বানান সংশোধকদের প্রতি সম্মান বজায় রাখা হলে বাংলা বই প্রকাশে যে অযত্ন দেখা যায় না, তা ইদানীংকালের বহু বই ওল্টালেই দেখতে পাওয়া যায়।
“‘শেক্হ্যাণ্ড’ আর ‘দাদা’ বল সব শোধ বোধ ঘরে চল।
ডোণ্ট পরোয়া অল্ রাইট্ হাউ ডুয়ুডু গুড্ নাইট্।”
ভেবেছিলাম, আমাদের ক্ষণজন্মা ভাবুকচূড়ামণি সুকুমার রায়ের ‘নারদ নারদ’ কবিতার শেষ এই দু’টি লাইন লিখে দিলেই তো হয়! কাব্যময় রহস্যময় চিত্ররূপময় পাঠকের জন্য অনেকখানি স্পেস-পরিসর সংবলিত রিভিউটি ধরিয়ে সম্পাদকীয় দপ্তরের কাছে জমা দিয়ে তব অচিন্ত্যে ঝাঁপ দেব। কিন্তু, বিনা বাক্যব্যয়ে নাহি দিব নিডল সুডৌল রিভিউ!
সত্যি বলছি, বই যখন চক্ষু-কর্ণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা পেরিয়ে স্পর্শসম্ভব হল, কৌতূহল বেড়েছিল দ্বিগুণ। সূচিমুখে গিয়ে আগ্রহ বাড়ল চারগুণ। ‘কবির মুখোমুখি কবি’– এপার ও ওপার বাংলা মিলিয়ে একঝাঁক কবির সাক্ষাৎকার– নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী থেকে শুরু, সুবোধ সরকারে গিয়ে শেষ হয়েছে সাক্ষাৎকারগ্রাহক শিমুল সালাহ্উদ্দিনের সাক্ষাৎকার সংকলনের প্রথম খণ্ড ‘শিমুল সাক্ষাৎমালা ১’। কে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন– এর থেকে সূচিতে সাক্ষাৎকারদাতা কবিদের নামেই হার্ডবাইন্ড চারশো পাতার ভার তুলতুলে ঠেকেছিল হাওয়ার মতন, নেশার মতন। আশ্বাস জেগেছিল, রবি ঠাকুর যতই বলুন ‘কবিকে পাবে না তার জীবনচরিতে’, এত বিস্তর আলাপে কিছু জোড়-ঝালাপালা পেরিয়ে চেনার একটা নতুন দিক কি খুলবে না? সূচিমুখ পেরিয়ে তাই মুখবন্ধে যাওয়ার উৎসাহ বাড়ল আরও আটগুণ, যখন দু’-তিন লাইন যেতে না যেতেই জানতে পারলাম– মাননীয় সাক্ষাৎকারগ্রাহক ‘নানামুখী খুঁতখুঁতি আর ব্যস্ততার জন্য’ সাত বছর ধরে এই সংকলনকে গুছিয়েছেন। প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬-য়, মুক্তি পাচ্ছে শেষমেশ ২০২৪ সালে। গত দেড় দশকে সাক্ষাৎকারগ্রাহক প্রায় ১৫০ জন শিল্পী-সাহিত্যিক ক-কবির দীর্ঘ আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার নিয়েছেন– বইটিকে গোগ্রাসে গেলার উচাটন বাড়ল এবার দশগুণ, এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, মুখবন্ধে তাই অভিনিবেশ আরও বাড়ল, ইতিউতি বানানের বিভ্রম গুস্তাখি মুয়াফ করে এগিয়ে গেলাম যেই, আমার চক্রবৃদ্ধি আগ্রহের আরশিতে প্রথম ঢিল মারলেন সাক্ষাৎকারগ্রাহক নিজেই।
………………………………………..
আরও বইয়ের খবর: মাতলা: ভাঙা-গড়ার সুন্দরবনে স্মৃতিচিহ্নের প্রবাহ
………………………………………..
‘কবির মুখোমুখি কবি’ শীর্ষক মুখবন্ধে সাক্ষাৎকারগ্রাহকের যে আত্মজৈবনিক সংলাপের একটি আশা তৈরি হয়েছিল পড়ার শুরুতে, ক্রমশ সেই পাঠ পর্যবসিত হল সাক্ষাৎকারগ্রাহকের আত্মকথনে। কলেজজীবন থেকে সাংস্কৃতিক, বৈপ্লবিক বিভিন্ন গতিপ্রবাহে তিনি কীভাবে সাক্ষাৎকার গ্রহণের দিকে কাজে রত হলেন, তার আভাস দিতে গিয়ে প্রায় জীবনচরিতের ঝাঁপি খুলে বসেছেন। কোথায় কীভাবে ক্রমশ তিনি বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগতে একজন প্রতিনিধি হয়ে উঠছেন, সেই পোর্টফোলিও নিশ্চিতভাবে প্রশংসনীয়, হয়তো-বা মনে হতে পারে আমার ক্ষমতার বাইরে তাই ‘ইলিশ মাছ টক’ বলছি– কিন্তু, এই তথ্য তাঁর কাছে কোন সাক্ষাৎকারগ্রাহক জানতে চাইলেন, তাঁর নাম উল্লেখ নেই কেন? ভারি বিভ্রমে পড়লাম। অব্যবহিত পরেই খেয়াল পড়ল, মুখবন্ধের শিরোনাম। সেখানে কবি নিজেই নিজের মুখোমুখি। তাহলে সাক্ষাৎকারগ্রাহক কে? তিনিই কবি? তাহলে তাঁর কবিসত্তার আখ্যান এখানে অনুল্লেখমুগ্ধ হল কেন? এক শরীরে দুই কবি একে-অপরকে কাটাকুটি করে সাক্ষাৎকারগ্রাহক সত্তা বেঁচে রইল, আখেরে ভালোই হল– এ-ও মনে হয়। কথাতেই আছে, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’!
অগত্যা নিজের সুবিধার্থে পাঠক নিজেই সাক্ষাৎকারগ্রাহকের মতো প্রশ্ন সাজাল। কবি, আপনার স্মৃতিরপ্ত একাকী সমাগম পেরিয়ে সাক্ষাৎমেলায় কীভাবে এলেন? উত্তর পেলাম।
………………………………………..
আরও বইয়ের খবর: স্মৃতির বিশ্রামতলায় গভীর ইতিহাস
………………………………………..
ক্রমশ কবিয়ালাপ শুরু হল। মাননীয় শিমুলবাবু (সাক্ষাৎকারগ্রাহক কবি) এই সাক্ষাৎমালার ক্রম নির্ণয় করেছেন বয়সোচিত বরিষ্ঠতার নিরিখে। বলা বাহুল্য, জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা বা ফেভারিটিজমের নিরিখে সাজালে বিতর্ক বাড়ত, সম্ভ্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারত। কিন্তু, সাক্ষাৎকারগুলি নেওয়ার সময়কালের নিরিখে যদি ক্রমটি তৈরি হত, তাহলে শিমুলবাবুর প্রশ্ন ভঙ্গিমা বা আলাপের একটা ধারাবাহিক বিবর্তন পাঠকের কাছে পৌঁছত, সাক্ষাৎকারে দুই দিকের কবি-কেই চেনার পরিসর আরও বাড়ত, নয় কি?
শুধু তো উত্তর দিয়েই নয়, প্রশ্ন দিয়েও ভাবনার বিবর্তনগতিকে অনুধাবন করা যায়। শুরুর সাক্ষাৎকারগুলিতে শিমুলবাবু সময়-সাল কিছুক্ষেত্রে দিনক্ষণও উল্লেখ করেছেন সাক্ষাৎকার গ্রহণের, যা থেকে সেই সময়ের আঁচ পেতে আরও সুবিধেই হয়, কথোপকথনের প্রবণতা, প্রশ্নের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের আবাহন আরও বোধগম্য হয়ে ওঠে। কিন্তু, ক্রমশ, শিমুলবাবু উদাসীন হয়ে পড়েছেন এই সময়োল্লেখে। তাঁর কবিভাব এক্ষেত্রে জাগরুক? একদিন বিকেল, কিংবা কোনও এক ঘন সন্ধ্যা টাইপ কালক্ষণবিলাপে যে নিঃসময় স্মৃতি, কালহীন কালের আখ্যানমঞ্জরীর প্রয়াস তো আর আজকের নয়, সেই রাখাল-বাঘের গল্প থেকে চলছে। কিন্তু এভাবে তো সাক্ষাৎকার তার অথেনটিসিটি হারায়। এই উদাসীনতা কবিকে যতই মানাক, সাক্ষাৎকার লিখনে মানায় কি?
শিমুলবাবুকে সৈয়দ শামসুল হক যে-বাক্যবাণ তাক করেছিলেন, সেটি তাই স্মরণ করিয়ে দিতে মন চায়– ‘ইউ ইয়াং পিপল, সহজ রাস্তা পছন্দ করো, ইন্টারভিউ নিলে লিখতে হয় না, ভাবতে হয় না, সহজ রাস্তা।’ প্রত্যুত্তরে শিমুলবাবু নিজের লেখালিখির সময়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রায়োরিটি-গরজ নিক্ষেপ করলে, উপরি পাল্টা দিয়েছেন, ‘না খোঁজ নিয়ে আসি নাই’ বটে, কিন্তু তার ব্যত্যয়ই ধরা পড়েছে পাতায় পাতায়। আহমদ রফিকের সাক্ষাৎকার শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে তিনি যে একাগ্র ছানবিন করেননি, হুবহু উইকিপিডিয়া টুকতে গিয়েছেন এবং সেখানেও ভুল করেছেন– তার প্রমাণটি দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত আহমদ রফিকের একটি বইয়ের নাম ভুল রয়েছে বোধকরি, আর তা উইকিপিডিয়ায় এমন– ‘ঝবষবপঃবফ চড়বসং’। সেটি তিনি তুলে এনে সম্ভবত অন্য কোনও ভাষায় অনুবাদ করে আকার দিয়েছেন এই– ‘ছত্রনত্রত্বণ্ঠত্রত্ম ঞ্ঝদ্রত্রদ্বম্’। এ তো চরম গাফিলতি!
………………………………………..
আরও বইয়ের খবর: তোমার কবিতার ঘোরগ্রস্ত খেলার পুতুল নই কেউ আমরা
………………………………………..
শুধু তা-ই নয়, একাধিক কবিকে প্রশ্নের ক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছে প্রশ্নের সমাপতন, খুঁচিয়ে অকারণ ব্যক্তিগতয় অনুপ্রবেশের প্রয়াসও ধরা পড়ে যা কবি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। দুই বাংলার কবি সমাগম যেহেতু, অবধারিত দেশভাগ-দাঙ্গার স্মৃতি আসবেই। কিন্তু, শিমুলবাবুর প্রশ্নের মধ্যে রাজনৈতিকতা অস্পষ্ট মনে হয় দেশ ও রাষ্ট্রের ভাবনাকে মিলিয়েমিশিয়ে অহেতুক বিতর্কিত প্রশ্নের মধ্য দিয়ে গনগনে উত্তর পাওয়ার চেষ্টায়। এহেন আলেখ্য যত না ইন্টারভিউ, তার চেয়ে ‘এন্তার ভিউ’ এনে দিতে পারে, ভাইরাল কন্টেন্টের দিক উন্মোচন করে– এই প্রলোভনের প্রতি সংযমী, সংবেদনশীল ও সচেতন কথোপকথনের আশা রাখতেই পারি, এত অগণিত মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া ব্যক্তিত্বের কাছে।
বইজুড়ে বিদঘুটে সব বানান– ‘ভূমিকা’ হয়েছে ‘ভুমিকা’, ‘সত্তা’ হয়েছে ‘সত্ত্বা’, ‘দূরত্ব’ হয়েছে ‘দুরত্ব’, একাডেমি একাডেমী একাদেমি অকাডেমি অকাদেমী– ছত্রে ছত্রে ভ্রম বিভ্রম প্রুফহীন গাফিলতির হদ্দমুদ্দ– যা চোখকে ক্লান্ত করে। বিষয়ের মধ্যে ঢুকতে বাধা দেয়। মনে পড়ে যায়, ভূমিকায় লেখা ওঁর কথা, ‘নানামুখী খুঁতখুঁতি আর ব্যস্ততার জন্য’ এই বই দীর্ঘকাল প্রকাশে দেরি হয়েছে। তা কি সচেতন প্রয়াসে ভুলগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য?
সবচেয়ে প্রশ্ন জাগায় সম্পাদনার ধরনধারণ। কোনও সাক্ষাৎকার আগাগোড়া কথ্য ভাষ্যে রাখা, কোনও সাক্ষাৎকার কথ্য-লেখ্যর মিশ্রণ, কোথাও-বা বলপূর্বক লেখ্য ভাষ্যের আবাহন– এই সমস্যা পাঠ-কে ক্ষতিগ্রস্ত করে না তত, কিন্তু কেন কথ্য-কে রেখে দেওয়া হল, কেনই বা লেখ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হল– তার উল্লেখের দায়িত্ব রয়েছে এরকম মিশ্র পাঠের ক্ষেত্রে। সাক্ষাৎকারদাতার উদ্দেশ্যে করা প্রশ্ন বা কথোপকথনে বিস্তৃত কবিতা আবৃত্তি করছেন শিমুলবাবু, সেটি লাইন-বাই-লাইন লেখা এবং কবি তার প্রশংসা করছেন– এখানে পাঠক পাচ্ছে কী? অযথা পাতার অপব্যয় ঠাওর হয়, প্রশ্ন হতে পারত আরও সংক্ষিপ্ত। নয়তো যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে, তাঁর বলার সুযোগ কমে যায় না কি?
এসব পেরিয়ে গত শতকের পাঁচের দশক থেকে সাতের দশক অবধি কবিদের সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত এক ইতিহাস যে এখানে ধরা রয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বিভিন্ন কথোপকথনে এমন সব তথ্য মেলে, যা আগ্রহী পাঠককে সময়কাল ও সময়কাল পেরিয়ে কবি ও কবিদের লেখালিখিকে চিনতে সাহায্য করবে বইকি। সে-অর্থে শিমুলবাবুর এই প্রয়াসকে সাধুবাদ, শুধু আশা পরবর্তী সংকলনে তিনি তাঁর ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে আরও সচেতন থাকবেন। তাঁর সাংবাদিক সত্তা, আবৃত্তিকার সত্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় বইয়ের ব্লার্বে, কিন্তু কবিসত্তা এই সাক্ষাৎমালায় খুব জরুরি ছিল কি না, ভাবা প্রয়োজন বলেই মনে হয়েছে। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে নৈর্ব্যক্তিক সাক্ষাৎকারগ্রাহকের ব্যক্তিসত্তা বা তার পছন্দের সত্তাটি উঠে আসার প্রবণতা থেকে যায়, যে কোনও দীর্ঘ কথোপকথনের অসুখ বা গুণ, যা-ই বলুন। কিন্তু, তার পরিমিতিবোধ বড়ই জরুরি। নয়তো ‘নারদ নারদ’ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, কী বলেন?
কবির মুখোমুখি কবি
শিমুল সালাহ্উদ্দিন
হাওয়াকল
৮০০