একসময় যা ছিল সুন্দরবন অঞ্চলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নদী, যার তীব্র স্রোত আর উত্তাল উন্মাদ ঢেউ চার-পাঁচ দশক আগে পর্যন্ত সুন্দরবনের মানুষের কাছে ভীতি ও সম্ভ্রমের কারণ হয়ে উঠেছিল, সেই মাতলা আজ জোয়ারের জলের ভরসায় কোনওমতে তার অস্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে। জোয়ার সরে গেলেই মজে যাওয়া নদীর বুকে হেঁটেই চলাফেরা করেন মানুষজন। হয়তো কয়েক দশকের মধ্যেই মৃত্যু হবে মাতলার। কিন্তু অতীত গৌরবের স্মৃতি আর বেদনার দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে শেষ হতে থাকা একটি নদী ও তার জনপদের ইতিহাসকে পত্রিকার দুই মলাটে এবার ধরতে চেয়েছেন সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী।
আপনি নদীমাতৃক বাংলার জনপদ নিয়ে আগ্রহী হলে কিংবা বাংলার নদনদীর ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে চাইলে আপনার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’ ত্রৈমাসিকের সাম্প্রতিক ‘মাতলা’ সংখ্যাটি।
ঠিকই ধরেছেন, বাংলার সুন্দরবন অঞ্চলের ক্যানিং থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত– মাতলা নদীকে নিয়েই একটা সংখ্যা। একসময় যা ছিল সুন্দরবন অঞ্চলের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নদী, যার তীব্র স্রোত আর উত্তাল উন্মাদ ঢেউ চার-পাঁচ দশক আগে পর্যন্ত সুন্দরবনের মানুষের কাছে ভীতি ও সম্ভ্রমের কারণ হয়ে উঠেছিল, সেই মাতলা আজ জোয়ারের জলের ভরসায় কোনওমতে তার অস্তিত্বটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে। জোয়ার সরে গেলেই মজে যাওয়া নদীর বুকে হেঁটেই চলাফেরা করেন মানুষজন। হয়তো কয়েক দশকের মধ্যেই মৃত্যু হবে মাতলার। কিন্তু অতীত গৌরবের স্মৃতি আর বেদনার দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে শেষ হতে থাকা একটি নদী ও তার জনপদের ইতিহাসকে পত্রিকার দুই মলাটে এবার ধরতে চেয়েছেন সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী।
দশটি গুচ্ছে মোট ২১ জন লেখকের ২১টি প্রবন্ধ, মাতলাকেন্দ্রিক দুটি ধারাবাহিক গদ্য এবং ১৬ নভেম্বর ২০২৩ থেকে ১৫ জুলাই ২০২৪ পর্যন্ত সুন্দরবনের ঘটনাপঞ্জি দিয়ে সাজানো হয়েছে এই সংখ্যাটি। বিশেষজ্ঞ নদীগবেষক কল্যাণ রুদ্রর ‘মাতলা মোহনা ও ক্যানিং বন্দরের ইতিকথা‘ প্রবন্ধে তথ্যসমেত ধরা আছে ঔপনিবেশিক আমলে মাতলা নদীর ইতিহাস। ১৮৬২-তে লর্ড ক্যানিংয়ের আমলে গড়ে ওঠা ক্যানিং পোর্ট ছিল এই মাতলারই মোহনায়। কিন্তু ঝড়প্রবণ মাতলার বুকে সে বন্দর এক দশকও টেকেনি। ১৮৬৭-র এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সেই বন্দরের পরিকাঠামো। ফলে ১৮৭১ সালে ব্রিটিশ সরকার বন্দর গুটিয়ে ফেলাই মনস্থির করে। কল্যাণ রুদ্র এবং অনিমেষ সিংহর লেখায় সেই ইতিহাসের বিস্তৃত বিবরণ আছে। অন্যদিকে কানাইলাল দাস ও করবী দাসের যুগ্মভাবে লেখা প্রবন্ধটিতে আছে মানচিত্র ও তথ্যসারণি-সহ মাতলা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের চমৎকার ইতিহাস। আটখানি সারণির মধ্যে দিয়ে দুই প্রাবন্ধিক মাতলার উপগ্রহচিত্র ও অতীতের মানচিত্র তুলে ধরে, উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর গতিপথের পরিবর্তনের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন।
মাতলা-পারের বসতির ইতিহাস ধরা আছে সৌমেন দত্ত ও স্বপনকুমার মণ্ডলের প্রবন্ধ দু’টিতে। মাতলা-তীরবর্তী অঞ্চলের প্রত্ন-ইতিহাস নিয়ে খুব মূল্যবান দুটি প্রবন্ধ আছে ক্ষিতীশ বিশাল ও উজ্জ্বল সরদারের। মাতলা পারের বাস্তুতন্ত্র, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন জয়ন্ত কুমার মল্লিক। মাতলার বাঘবনে সালওয়াড়ি বাঘের সংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধির বিবরণ, অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, পাখ-পাখালি, মাছ প্রভৃতি জীববৈচিত্র্য এবং সুন্দরবনের জঙ্গল ও ভূমিরূপের বৈচিত্র্য ও ঘনত্ব নিয়ে এমন তথ্যবহুল পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা পত্রিকাটির মান বাড়িয়েছে।
……………………………………….
আরও পড়ুন অন্তরা ব্যানার্জী-র লেখা: দশ দিন ব্যাগহীন পড়ুয়ারা, কিন্তু অভিভাবকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভার কি লাঘব হবে?
……………………………………….
মাতলার অতীত ইতিহাস এবং মাতলার চরের উপর নির্ভরশীল জনজীবন, মাঝিমাল্লা, লঞ্চঘাট, পাখিশিকার–এই সমস্ত ইতিহাসকে পূর্ণেন্দু ঘোষ তাঁর ‘আমি মাতলাচরের মানুষ’ শীর্ষক গদ্যের আধারে চমৎকার ভাবে ধরেছেন।অন্যদিকে, যোগাযোগের ব্যবস্থা হিসেবে মাতলা নদীপথের গুরুত্বের ইতিহাসকে ধরতে চেয়েছেন অনাথ মৃধা ও নিরঞ্জন মণ্ডল।
মাতলা নদীর স্মৃতি ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে রয়েছে সুকুমার পয়রা, উৎপলেন্দু মণ্ডল, বিকাশকান্তি মিদ্যা, অপরেশ মণ্ডল, পবিত্র মণ্ডল প্রমুখের লেখা একগুচ্ছ প্রবন্ধ। সে-সব স্মৃতিকথায় ধরা আছে মাতলার ঢেউ, ঝড়-ঝাপটা, দুর্ঘটনা, খেয়াঘাট, নৌকা, মাঝিমাল্লার কথা। একটি গুচ্ছে ধরা আছে মাতলা নদী নিয়ে লেখা বাংলা সাহিত্যের পরিচয়। সুব্রত চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন বাংলা কথাসাহিত্যে মাতলা নদী ও তার সংলগ্ন জনপদের কথা। অন্যদিকে, বরেন্দু মণ্ডলের ‘স্মৃতির মাতলা, ছন্দের মাতলা’ আদতে মাতলা নদীকে নিয়ে লেখা বাংলা কবিতাচর্চার একটি চমৎকার ইতিহাস।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
ছাপাখানার ভূতের উপদ্রপে কিছু বানানবিভ্রাট বাদ দিলে বর্ণবিন্যাস, ঝকঝকে ছাপা ও দুর্দান্ত সব ফটোগ্রাফ এই সংখ্যাটিকে চমৎকার করে তুলতে সাহায্য করেছে। ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’র ‘মাতলা’-কে নিয়ে এই নিবিড় ও পরিশ্রমী চর্চা নদীকেন্দ্রিক আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চায় নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে রইল।
মাতলা বিশেষ সংখ্যা
পত্রিকা: শুধু সুন্দরবন চর্চা
সম্পাদক : জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী
মূল্য: ৩০০ টাকা
আমরা তো এদিকে হোম-ডেলিভারিকে বিদায় দিয়ে ততদিনে ভাতের হোটেলে বেঞ্চি বুক করে ফেলেছি। যে কোনও মেসতীর্থেই ধীরে জেগে ওঠে এই সব হোটেল। তাদের হোটেল বললে বড় পাঁচ-সাত তারা-রা কুপিত হতে পারে। না বললে, আমাদের সম্মানে লাগে।