ছোটবেলা থেকে আমরা জেনে এসেছি, ‘একবৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।’ ভারত কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমান নয়, আরও অনেক ধর্ম-বর্ণ, জনজাতির সমাহার। স্বাধীনতা যুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শহিদ হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে এই ভেদ-ভাবনা ছিল না। অথচ আজকের ভারতে তার অদ্ভুত বৈপরীত্য। সমাজের একটা শ্রেণি ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরিতে ব্যস্ত। আর সেটাই তিলে তিলে জন্ম দেয় ঘৃণার। তার পরিণতি কী ভয়ংকর, ইতিহাস তার সাক্ষী।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখাটা শুরু করা যাক। খুব বেশিদিন নয়, বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। এক বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত পরিবারের স্নাতক শিক্ষার্থীকে পড়াতে যেতাম সল্টলেকে। ঘটনাচক্রে তা জানতে পেরে, একরাশ বিস্ময় নিয়ে আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু প্রশ্ন করেছিল– ‘ওই বাড়িতে ওদের হাতের খাবার খাস?’ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ানোয় বিস্ময়ের মাত্রা চড়েছিল বন্ধুটির। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপদেশ-বর্ষণ। আমিও অবাক হয়েছিলাম। অবাক হয়েছিলাম, এই আধুনিক সমাজে বাস করেও সেই বন্ধুর মনে জমে থাকা বিভেদকামী মানসিকতা দেখে। ‘উদার আকাশ’ প্রকাশিত সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পাশাপাশি বাস তবে কেন উদাসীন?’ পাঠের মধ্য দিয়ে সেই স্মৃতি নতুন করে ফের জেগে উঠল মনে।
ছোটবেলা থেকে আমরা জেনে এসেছি, ‘একবৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।’ ভারত কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমান নয়, আরও অনেক ধর্ম-বর্ণ, জনজাতির সমাহার। স্বাধীনতা যুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শহিদ হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে এই ভেদ-ভাবনা ছিল না। অথচ আজকের ভারতে তার অদ্ভুত বৈপরীত্য। সমাজের একটা শ্রেণি ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরিতে ব্যস্ত। আর সেটাই তিলে তিলে জন্ম দেয় ঘৃণার। তার পরিণতি কী ভয়ংকর, ইতিহাস তার সাক্ষী। তবু সেই ভুল থেকে সমাজ যে শিক্ষা নেয়নি, ধর্মের নামে রাজনীতি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ‘পাশাপাশি বাস তবে কেন উদাসীন?’ সেই বিভেদের ছবিকে একসুতোয় বেঁধেছে। পাশাপাশি সহাবস্থান সত্ত্বেও একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের প্রতি সমাজের একটা বৃহৎ শিক্ষিত অংশের অবজ্ঞা, অবহেলা এবং বেআব্রুভাবে সেই নির্লজ্জ মানসিকতার প্রকাশ, এখনও চলছে ধারাবাহিকভাবে। এর শেষ কোথায়, ছোট ছোট পরিচ্ছেদ শেষে সেই প্রশ্নই সকাতরে রেখেছেন লেখক সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘পাশাপাশি বাস তবে কেন উদাসীন?’ সেই বিভেদের ছবিকে একসুতোয় বেঁধেছে। পাশাপাশি সহাবস্থান সত্ত্বেও একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের প্রতি সমাজের একটা বৃহৎ শিক্ষিত অংশের অবজ্ঞা, অবহেলা এবং বেআব্রুভাবে সেই নির্লজ্জ মানসিকতার প্রকাশ, এখনও চলছে ধারাবাহিকভাবে। এর শেষ কোথায়, ছোট ছোট পরিচ্ছেদ শেষে সেই প্রশ্নই সকাতরে রেখেছেন লেখক সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘বাজেয়াপ্ত ইতিহাস’ গ্রন্থে গোলাম আহমদ মোর্তাজা লিখেছেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধি ও হিন্দু মুসলমানে দাঙ্গার মূলে আছেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কিছু লেখক। সেই লেখা যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এই অশান্তি সহজেই দূরীভূত হবে।’ বস্তুত, সাম্প্রদায়িকতা বন্ধের যে উপায় তিনি বাতলে দিয়েছেন, তার উল্টোছবিটাই বর্তমান ভারতে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে। উত্তরপ্রদেশে ‘দাদরি কাণ্ড’-এর প্রসঙ্গ টেনে সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন লেখক।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: শিল্প নিয়ে কোনও টিকরমবাজি রেয়াত করতেন না অহিভূষণ মালিক
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দৃষ্টান্ত একটা নয় একাধিক। ঈদ আর মহরমে তফাত করতে না পারা সুশীল সমাজ আদপে কতটা কূপমণ্ডুক, তার উদাহরণও এই বইতে রয়েছে। ধর্ম কীভাবে, সম্প্রীতির পরিবর্তে বন্ধুত্ব-বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, রয়েছে তার উদাহরণও। অথচ এই ধর্ম নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনাচক্রে অনেক সময় আমরা ভুলে যাই, শ্যামাসংগীতের একটা বিপুল অংশের রচয়িতার নাম কাজী নজরুল ইসলাম। যে রফিক, সালাম, বরকত, শফিউর, জব্বারের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা লাভ এবং ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক ভাষাদিবসের মর্যাদা অর্জন, সেই শহিদ-রা বাঙালি, ধর্মের মানদণ্ডে তাদের বিচার চলে না।
একপেশে বিভেদ-বৈষম্যের দৃষ্টান্ত কিংবা প্রতিবাদ জানিয়ে পাতা ভরানো নয়, সম্প্রীতির ছবিটাও রয়েছে এই বইয়ে। কিন্তু সংখ্যায় তা নগণ্য। সেই সামান্যকে আঁকড়েই এ-পথেই পৃথিবীর তথা বর্তমান সমাজের ক্রমমুক্তির সন্ধান করেছেন লেখক সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর ‘পাশাপাশি বাস তবে কেন উদাসীন?’ গ্রন্থে।
পাশাপাশি বাস তবে কেন উদাসীন?
সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়
উদার আকাশ
মূল্য ১২৫ টাকা