অগভীরতা তথা ক্রমাগত জনপ্রিয় প্রোডাক্ট তৈরি করা এক কঠিন সমাজ বাস্তবতা। যার নিকট আত্মীয় সেয়ানা শাসকের চাল। তাই তৈরি হয় ‘কেরালা স্টোরিস’, ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর মতো ছবি। ‘আরও কত কত স্টোরি। আরও কত কত ফাইলস। করমুক্ত। বাস ভরে, ট্রেন ভরে, যে স্টোরি দেখাতে নিয়ে গেছে নেতা-মন্ত্রীরা। যে স্টোরি দেখতে গিয়ে হল-ভর্তি মানুষ চিৎকার করে বলে– গোলি মারো শালো কো।’ এর ঠিক বিপরীতে দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে যে সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে তার কথা বলে ‘প্রতিরোধের সিনেমা’।
হয়তো আমাদের বুঝে নেওয়া উচিত যে আইপিএল, চিয়ার লিডার, বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারির বন্যা, বিজ্ঞাপনী সুন্দরী, কোটি টাকার জুয়া আর ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ এক পৃথিবীতে ঘটছে না! হয়তো বা এও সমঝে নেওয়া উচিত যে, পৃথিবীতে ‘পাঠান’, ‘জওয়ান’-এর মতো একশো শতাংশ আনন্দের ‘সিনেমা’ তৈরি হচ্ছে, সেখানে ‘মাত্র সাড়ে তিন মাসে আমেরিকার মদতে ইজরায়েলের সামরিক আক্রমণে গাজা ভূখণ্ডে ২৪ হাজার প্যালিস্তানীয়র নির্মম গণহত্য়া সম্ভব নয়!’ নির্দয় পরিসংখ্যানের দাবি, মৃতদের মধ্য়ে ৯,৬০০ শিশু ও কিশোর। সংখ্যাটা প্রতিদিন বাড়ছে ব্যাপক হারে। অর্থাৎ একদিক ‘আনন্দ’, তথা অগভীর বিনোদনের ঢালাও আয়োজন এবং বুদ্ধি করে সেই আয়োজনকে মোটা দেওয়ালের কায়দায় ব্যবহার করছে শাসক। যার আড়ালে ধর্মের নামে, জাতের নামে দুর্বলের রোটি-কাপড়া-মকান কেড়ে নেওয়া, তাকে হত্যা করে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র। গত কয়েক দশকে এই প্রবণতা কি বেড়েই চলেছে?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অন্যতম জরুরি কাজ ‘রাজনৈতিক গান, গানের রাজনীতি’ শিরোনামে একালের দুই গণসঙ্গীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় এবং মৌসুমী ভৌমিকের আড্ডা। দু’জনেই নিজের কাজে বাঁধা গতের বাইরে অর্গলমুক্ত পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন। কেবল শিল্পসৃষ্টিতে নয়, জীবনযাপনেও। আমরা জানি প্রতুল এবং মৌসুমীর একাধিক ‘হিট’ গান রয়েছে। এর পরেও তাঁরা আনন্দ তথা বিনোদন জগতের ‘বিনোদ’ ও ‘বিনোদিনী’ হয়ে ওঠেননি, ‘সেলিব্রেটি’ হননি, সচেতনভাবে হতে চাননি বলেই। আলাপচারিতার শুরুতেই প্রতুলের রসিকতা– ‘সবাই যে বলে স্বর্ণযুগের গান, স্বর্ণযুগের গান আমরা কি তবে অ্য়ালমুনিয়ামের যুগের হলাম?’
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দ্বৈপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কস্তুরী বসু সম্পাদিত ‘পিপলস ফিল্ম কালেকটিভ’ প্রকাশিত পত্রিকা ‘প্রতিরোধের সিনেমা’-র প্রতিটি সিনেমা ও থিয়েটার বিষয়ক প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র আলোচনা, সাক্ষাৎকার সভ্যতার কুটিল মুখোশ খুলে এই প্রশ্নই তুলে দিয়েছে। অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যার সূচিপত্র সমৃদ্ধ। অন্যতম জরুরি কাজ ‘রাজনৈতিক গান, গানের রাজনীতি’ শিরোনামে একালের দুই গণসঙ্গীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় এবং মৌসুমী ভৌমিকের আড্ডা। দু’জনেই নিজের কাজে বাঁধা গতের বাইরে অর্গলমুক্ত পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছেন। কেবল শিল্পসৃষ্টিতে নয়, জীবনযাপনেও। আমরা জানি প্রতুল এবং মৌসুমীর একাধিক ‘হিট’ গান রয়েছে। এর পরেও তাঁরা আনন্দ তথা বিনোদন জগতের ‘বিনোদ’ ও ‘বিনোদিনী’ হয়ে ওঠেননি, ‘সেলিব্রেটি’ হননি, সচেতনভাবে হতে চাননি বলেই। আলাপচারিতার শুরুতেই প্রতুলের রসিকতা– ‘সবাই যে বলে স্বর্ণযুগের গান, স্বর্ণযুগের গান আমরা কি তবে অ্য়ালমুনিয়ামের যুগের হলাম?’
‘স্বর্ণযুগ’ শব্দটি থেকেই সলিল চৌধুরীর প্রসঙ্গ ওঠে। ২০২৫ সাল হল প্রয়াত শিল্পীর শতবর্ষ। প্রতুল জানান, সলিল চৌধুরীর শতবর্ষে তাঁকে কেউ ডাকবে না, কারণ ‘যারা ওই গ্রামারের ব্য়াপারগুলো ঠিক মতো জানে না, মানে একটা গানকে মিউজিকের টার্মোলজি দিয়ে এক্সপ্লেন করতে পারে না, তাদের অনেকই পছন্দ করে না।’ যেহেতু শিল্পের দুনিয়াও ‘জ্যাঠা-খুড়ো’ শাসিত এক সমাজ। সেই সমাজ কাকে গ্রহণ করবে, কাকে সমাজচ্যুত করবে, তা নির্ভর করে অ্য়াকাডেমিক জ্ঞানের ওপরে, বোধের ওপরে নয়। গান, কবিতা, সিনেমা না জানলেও চলবে, তবে গান, কবিতা, সিনেমার গ্রামার জানা চাই। এই হল মোদ্দা কথা!
সহশিল্পী মৌসুমীর সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রতুল বলতে দ্বিধা করেন না যে, ‘এরকম প্রচুর মানুষ আছেন যাঁরা গানের মেথোডোলজির মধ্যে যাননি, গানটাকে গান হিসেবে গেয়েছেন। সেইরকম লোকই বেশি। আমিও তাদের দলে।’ এই যে মেথড তথা গ্রামার-বিশ্ব, তার নিকট আত্মীয় পপুলার জগৎ। প্রতুল নির্দ্বিধায় বলেন, সলিল চৌধুরীর ‘বেশ কিছু গান রয়েছে যেগুলি অত্যন্ত পপুলার, এবং যেগুলো আমার কাছে অবশ্যই বর্জনীয়।’ উদাহরণ হিসেবে ‘সাত ভাই চম্পা’ গানটির বিস্ফোরক মূল্যায়ন করেন কিংবদন্তি গণসঙ্গীত শিল্পী। তিনি বলেন, ‘যেভাবে সুর করা উচিত নয়, সেটা তিনি একেবারে ফুটিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, একটা কথাকে কী করে, কতখানি ডিসটর্ট করা যায়, জাস্ট ফর দ্য সেক অফ পপুলারিটি অ্য়ান্ড সেল, মার্চেন্ডাইস হিসেবে, এই গানে সেটা দেখিয়ে দিলেন।’ আলাপচারিতার এক জায়গায় মৌসুমী মনে করিয়ে দেন, প্রতুল নিজেকে ‘এররিস্ট’ বলেন। এই বিষয়ে প্রতুল জানান ‘এরর’ নেগেটিভ শব্দ নয়। তিনি বলেন, ‘এ-বেয়ার মানে হচ্ছে, টু গো অ্যাস্ট্রে, বাঁধা গৎ থেকে সরে যাওয়া। এবং প্রতিভার লক্ষণই হচ্ছে টু গো অ্যাস্ট্রে। এভরি জিনিয়াস ইস অ্যান এররিস্ট। টেররিস্ট না হলেও এররিস্ট।’
বলা বাহুল্য যে এররিস্টের টেরর সহ্য করে না সমাজ। যে কারণে দীর্ঘ কথোপকথনের এক জায়গায় মৌসুমী আক্ষেপ করেন, ‘আমার ক্ষেত্রেও দেখেছি কোন গানগুলো মানুষ শুনতে চায়। সেই ঘুরেফিরে আমি শুনেছি সেদিন, যশোর রোড, যেগুলোর একটা সিঙ্গেবিলিটি রয়েছে, সহজ কথা আছে, সহজে তোলা যায়।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সাদা-কালো নির্মল বাঙালিয়ানা
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
অগভীরতা তথা ক্রমাগত জনপ্রিয় প্রোডাক্ট তৈরি করা এক কঠিন সমাজ বাস্তবতা। যার নিকট আত্মীয় সেয়ানা শাসকের চাল। তাই তৈরি হয় ‘কেরালা স্টোরিস’, ‘কাশ্মীর ফাইলস’-এর মতো ছবি। ‘আরও কত কত স্টোরি। আরও কত কত ফাইলস। করমুক্ত। বাস ভরে, ট্রেন ভরে, যে স্টোরি দেখাতে নিয়ে গেছে নেতা-মন্ত্রীরা। যে স্টোরি দেখতে গিয়ে হল-ভর্তি মানুষ চিৎকার করে বলে– গোলি মারো শালো কো।’ এর ঠিক বিপরীতে দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে যে সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে তার কথা বলে ‘প্রতিরোধের সিনেমা’।
যেমন বাংলাদেশের পরিচালক লিসা গাজির ‘রাইজিং সাইলেন্স’। এই ছবিতে উঠে এসেছে বাংলাদশে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে অসংখ্য নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন, সেই বীরাঙ্গনাদের কথা। লিসার ছবি নিয়ে লিখেছেন উৎসা সারমিন। ‘বাবার মুখের সেই গল্প তাড়া করত লিসাকে, সেই তাড়না থেকে শুরু ধর্ষিতাদের নিয়ে গবেষণা।’ যার প্রথম পরিণতি একটি থিয়েটার প্রোডাকশন– ‘বীরাঙ্গনা: উইমেন অফ ওয়ার’। পরবর্তীতে তথ্যচিত্র হয় ‘রাইজিং সাইলেন্স’। যেখানে একুশ জন বীরাঙ্গনা তাঁদের জীবনের কথা ক্যামেরার সামনে এসে নিজের মুখে লিসাকে জানিয়েছেন। উৎসা লেখেন, ‘ধর্ষণ, নির্যাতন, নিগ্রহ, যন্ত্রণা, লজ্জা, একাকীত্ব, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, একঘরে করে রাখা, প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, ভিটেমাটি উচ্ছেদ… ছবিতে উঠে আসে যুদ্ধের কারণে উলটেপালটে যাওয়া জীবনের নানা দিক।’
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সংগীতের সুর ধরে মিলেমিশে গিয়েছে গুরু-শিষ্যের জীবনচিত্র
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এছাড়াও ‘সিনেমা ভাবনা’ বিভাগে ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘সুবর্ণরেখা’য় শব্দ ও সঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে জরুরি প্রবন্ধ লিখেছেন সুকান্ত মজুমদার। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে কিছু অন্যধারার ভারতীয় ছবির বিশ্লেষণ করেছেন চলচ্চিত্রবিদ্যার গবেষক সায়ন্তন দত্ত। রয়েছে অত্যন্ত জরুরি কাজ– মুসলিম মহিলাদের অধিকার– কিছু ছবি, কিছু প্রশ্ন। লেখক উমা চক্রবর্তী। ‘জনপ্রিয়’ দুনিয়ার ট্রেন্ডি দেখা হল ওয়েব সিরিজ। এই বিষয়ে প্রবন্ধ জিগীষা ভট্টাচার্যের (ওয়েব সিরিজ, বর্তমান সময় এবং সংস্কৃতির রাজনীতি)। এছাড়াও ‘তৃতীয় থিয়েটার’ বিষয়ক লেখা এবং নকশালবাড়ি পরবর্তী গণসাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম চরিত্র কবি ও সঙ্গীত শিল্পী বিপুল চক্রবর্তীর ‘কথাবার্তায়’ আক্ষরিক অর্থেই কঠিন সময়ের দলিল হয়ে উঠেছে ‘প্রতিরোধের সিনেমা’।
যেহেতু সস্তা জনপ্রিয়তা নয়, বরং ‘মানুষের জন্য সিনেমা’র স্বপ্ন দেখেন এই পত্রিকার দুই সম্পাদক, তাই সুলিখিত সম্পাদকীয় শেষ হয়– ‘অন্য ভারত। সবার দেশ। যেখানকার সিনেমা হলে কেউ উন্মত্তের মতো অন্য মানুষদের খুনের স্লোগান দেয় না…।’ সার্থক হবে কি রক্তিম সূর্যোদয়?