গান্ধীহত্যা থেকে উত্তর-পূর্বের সমস্যা, যে স্মৃতিকথা বরুণ দাসগুপ্ত ধারণ করেন, তা দুর্ভাগ্যের মতো ফিরে ফিরে আসে। তাঁর মতো সাহসী, নিরপেক্ষ কলমে তা লিপিবদ্ধ করতে পারেন কজন? মনে পড়তে পারে, ক্যাথারিন গ্রাহামের ‘পারসোনাল হিস্টরি’ বা সেইমোর এম হার্শের ‘দ্য রিপোর্টার’-এর কথা। আত্মজীবনীতে কথা বলে ওঠে ইতিহাস। ‘স্মৃতির সরণি বেয়ে’ সে জাতীয় নয়। ক্ষমতার অলিন্দে থেকে সেই ক্ষমতার বিকৃত রূপ তুলে ধরে না এই গ্রন্থ। বরং দাঁড়িয়ে থাকে বেশ খানিকটা বাইরে।
রাজনীতিবিদ দেখেন এক চোখ বন্ধ করে। দু’চোখ খুলে দিনদুনিয়া দেখা তাঁর ধর্মে মানা। এই প্রচলিত ধারণা থেকে সরে আসার সমস্ত পথই আপাতত বন্ধ হয়ে গিয়েছে অন্ধ রাজনীতির দাপটে। মুক্তধারা যে চিরকাল ছিল, তা দৃপ্তকণ্ঠে স্বীকার করা যাবে না। তবু এদেশের রাজনীতি, তার ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে জলাচল ভেদ রেখে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। স্বাধীনোত্তর সময়ে বিভিন্ন বিষাক্ত অধ্যায়েও চোখ-কান খুলে খুলে চলেছে রাজনীতির গতিপথ। সকলেই নয়, কেউ কেউ তো বটেই। তাই উত্তরকালের পাঠকের কাছে ইতিহাসের বহুমুখী পাঠের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় না।
বরুণ দাসগুপ্তের ‘স্মৃতির সরণি বেয়ে’ সেই কণ্টকাকীর্ণ সময়ের দিনলিপি। একদিকে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়, তার সঙ্গে জড়িত কর্মকাণ্ড। অন্যদিকে সাংবাদিকের চোখ দিয়ে লিপিবদ্ধ করে চলা সংকটমুখর পর্বের ইতিহাস। সময় এগিয়ে চলে, পরিপক্ব হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও সাংবাদিক সত্তার যৌথ অভিজ্ঞতা। তবু তাঁর গ্রন্থে আশ্চর্য নিরাসক্তির ছাপ থাকে সর্বত্র। ব্যক্তিগত জীবনচারণে তিনি সাংবাদিক হয়েও সাংবাদিক নন, রাজনীতিবিদ হয়েও রাজনীতিবিদ নন। ‘জনস্বার্থ বার্তা’য় প্রকাশিত সেই স্মৃতির ঝাঁপি অনুরীতা মুখোপাধ্যায় ও নিত্যানন্দ ঘোষের সম্পাদনায় রূপ পায় এই গ্রন্থে।
প্রথম জীবনের বর্ণনায় তিনি সরল, অকপট। সোদপুরের গান্ধী আশ্রমে তাঁর বড় হওয়া। গান্ধীজির ‘লাঠি’ হয়ে ওঠা থেকে নেহরুকে মঞ্চ থেকে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা ভিড় করে আসে এই গ্রন্থে। গান্ধীবাদী পরিবারের অংশ হয়েও ক্রমে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন মার্কসীয় দর্শনে। সদস্য হয়েছিলেন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া বা আরসিপিআইয়ের সঙ্গে। রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গেই সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। গুরু হিসেবে পেয়েছেন পান্নালাল দাসগুপ্তকে। কম্পাস, মেইনস্ট্রিম, লিঙ্ক, পাইওনিয়রের পাতা উলটে পৌঁছে যাওয়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘কনফ্রন্টেশন’। মার্কসবাদের বিপ্লবী পাঠ পান্নালাল দাসগুপ্তের শিষ্যত্ব ছুঁয়ে পরিণতি পেয়েছে সংবাদের বিশ্লেষণে গভীর প্রশান্তিতে। হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে সময়ের ভাষ্য। কখনও সেটা গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গা, তো কখনও আবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যত দৃষ্টি শাণিত হয়েছে, তত অতিকথন-অতিবর্ণনের পর্ব ছেড়ে নির্মেদ চেহারা পেয়েছে এই গ্রন্থ।
…………………………………………………….
রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গেই সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। গুরু হিসেবে পেয়েছেন পান্নালাল দাসগুপ্তকে। কম্পাস, মেইনস্ট্রিম, লিঙ্ক, পাইওনিয়রের পাতা উলটে পৌঁছে যাওয়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ‘কনফ্রন্টেশন’। মার্কসবাদের বিপ্লবী পাঠ পান্নালাল দাসগুপ্তের শিষ্যত্ব ছুঁয়ে পরিণতি পেয়েছে সংবাদের বিশ্লেষণে গভীর প্রশান্তিতে। হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে সময়ের ভাষ্য। কখনও সেটা গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গা, তো কখনও আবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যত দৃষ্টি শাণিত হয়েছে, তত অতিকথন-অতিবর্ণনের পর্ব ছেড়ে নির্মেদ চেহারা পেয়েছে এই গ্রন্থ।
…………………………………………………….
যার ফলপরিণতিতে ‘স্মৃতির সরণি বেয়ে’-কে তথাকথিত আত্নজীবনীর ধারাপাতে ফেলতে দ্বিধা হয়। বরং বলা যায় এক বহুদর্শী মানুষের স্মৃতি ছুঁয়ে তৈরি হওয়া ইতিহাস। গান্ধীহত্যার বিষয়ে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ বণর্না ভবিষ্যতের গবেষকের জন্য যত্ন করে তুলে রেখেছেন। গুলিয়ে দেওয়া সময়ে স্পষ্ট দাবি করেন, ‘সর্দার প্যাটেল থেকে হিন্দু মহাসভার নেতার স্বীকৃতি, গান্ধী হত্যায় আরএসএসই দায়ী’। আবার কখনও ঘেঁটে দেখেছেন কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ইতিহাস। তবে সবচেয়ে বেশি আছে আরসিপিআইয়ের কার্যকলাপ। ভারতবর্ষের বাম আন্দোলন নিয়ে প্রচারে কিছু নির্দিষ্ট দলের ঢক্কানিনাদের বাইরেও যে সমান্তরাল গতিপথ আছে, তা নিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার থেকে উজাড় করে দেন বরুণ দাসগুপ্ত। বলা যায়, আরসিপিআইয়ের ইতিহাসের উপাদান লিপিবদ্ধ করে যান তিনি।
আর শুধু তো রাজনীতি নয়। আছে খগেন বড়ুয়া, বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার মতো সাংস্কৃতিক জগতের কিংবদন্তিদের প্রসঙ্গ। উত্তর-পূর্ব ভারতের সামাজিক-অর্থনৈতিক দলিলের সূত্র ধরে আজকের সময়ে পৌঁছে যান তিনি। যার শেষ পর্বে রয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে নাগাল্যান্ডের এনএসসিএন (আইএম)-র শান্তি চুক্তির কথা। তার সঙ্গে লেখেন, “কী আছে সেই চুক্তিতে? কেউ জানে না। কারণ চুক্তিটি প্রকাশ করা হয়নি, গোপন রাখা হয়েছে। কবে, কতদিনের মধ্যে ও কীভাবে এই চুক্তি রূপায়ণ করা হবে সে সম্পর্কে না ভারত সরকার না নাগা নেতারা, কেউ একটি শব্দও খরচ করেননি।” আজ উত্তর-পূর্ব ভারতের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার সঙ্গে এই লুকোচুরির ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ জানে না।
তাই ‘শেষ পর্ব’ বলাটা ভুল হল। এই ইতিহাসের শেষ নেই। এই গ্রন্থেরও সমাপিকা নেই। গান্ধীহত্যা থেকে উত্তর-পূর্বের সমস্যা, যে স্মৃতিকথা বরুণ দাসগুপ্ত ধারণ করেন, তা দুর্ভাগ্যের মতো ফিরে ফিরে আসে। তাঁর মতো সাহসী, নিরপেক্ষ কলমে তা লিপিবদ্ধ করতে পারেন ক’জন? মনে পড়তে পারে, ক্যাথারিন গ্রাহামের ‘পারসোনাল হিস্টরি’ বা সেইমোর এম হার্শের ‘দ্য রিপোর্টার’-এর কথা। আত্মজীবনীতে কথা বলে ওঠে ইতিহাস। ‘স্মৃতির সরণি বেয়ে’ সে জাতীয় নয়। ক্ষমতার অলিন্দে থেকে সেই ক্ষমতার বিকৃত রূপ তুলে ধরে না এই গ্রন্থ। বরং দাঁড়িয়ে থাকে বেশ খানিকটা বাইরে। অনেকটা বামে। ঠিক তাঁর হৃদয় যতটা বামে, ততটাই।
স্মৃতির সরণি বেয়ে
বরুণ দাসগুপ্ত
মান্দাস
৫৫০ টাকা