প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, দেবস্থানের পুরোহিত সচরাচর হন ব্রাহ্মণ– এমনটা দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এই গ্রন্থে লেখক রাঢ়বাংলার বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান করে দেখেছেন, সেখানকার অধিকাংশ দেবস্থানে পূজারি ব্রাহ্মণ নন, নিযুক্ত রয়েছেন অব্রাহ্মণ পুরোহিত। কোথাও রয়েছেন লোধা-শবর পুরোহিত, কোথাও বা বাগদি, বাউরি-র জনজাতির কেউ। কোথাও আবার জেলেকৈবর্ত কিংবা কুড়মি পুরোহিত। কোথাও তাদের পরিচয় ‘দেহরি’, কোথাও আবার ‘দেয়াসি’ কিংবা ‘লায়া’। পরিচয়ে আলাদা হলেও একটা স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্য সকলেই বহন করছে, প্রত্যেকেই ‘অব্রাহ্মণ’।
ত্রিলোকেশ্বর মন্দির। রাজার নির্দেশ শিরোধার্য করে দেবতার মূর্তি নতুন করে গড়ে তুলছেন কিরাত-অধিপতি মাধব। চোখ বাঁধা। অমাবস্যা পার করে হাজির শুক্লপক্ষ। পাণ্ডুর আকাশে উদয় ঘটল একাদশী-চাঁদের। প্রহরী মারফত খবর গেল রাজার কাছে– মাধবের কাজ শেষ। দেব-নির্মাণ সমাপ্ত। একাদশীর পূর্ণ চাঁদের আলো তখন এসে পড়েছে দেবমূর্তির ওপর। চোখের বাঁধন খুলে সেদিকে বিহ্বল হয়ে চেয়ে বেদীর সামনে বসে মাধব। রাজা প্রবেশ করলেন মন্দিরে। বেদীমূলে মাথা নত কিরাতদলপতির। ঝলসে উঠল রাজার তলোয়ার। দেবতার পায়ে অর্পিত হল প্রথম পুজো। শেষ প্রণাম।
এ কাহিনি নতুন নয়, অনেককালের। আমাদের সকলের চেনা এই ‘প্রথম পূজা’। হাজার হাজার বছর ধরে উগ্র ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র এবং রাজন্যবর্গের ক্ষমতার লোভ নিম্নবর্গীয় মানুষের ওপর শোষণ, লাঞ্ছনা চালিয়ে গিয়েছে। সেই অত্যাচার শুধু সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক স্তরে নয়, প্রভাব ফেলেছে জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেও। তৈরি করেছে এক বিভেদের রূপরেখা, যা থেকে দলিত, আদিবাসীদের মতো প্রান্তিক সমাজের বাস্তব ছবিটাকে স্পষ্টভাবে ধরা যায়। সেই নিম্নবর্গীয় সমাজের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাদের একান্ত ধর্মবিশ্বাস, যা অনার্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। সুশীলকুমার বর্মনের ‘অব্রাহ্মণ পুরোহিত’ গ্রন্থটি সেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চায় আলো ফেলেছে, যা একদিক থেকে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনই অভিনব।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, দেবস্থানের পুরোহিত সচরাচর হন ব্রাহ্মণ– এমনটা দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এই গ্রন্থে লেখক রাঢ়বাংলার বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান করে দেখেছেন, সেখানকার অধিকাংশ দেবস্থানে পূজারি ব্রাহ্মণ নন, নিযুক্ত রয়েছেন অব্রাহ্মণ পুরোহিত। কোথাও রয়েছেন লোধা-শবর পুরোহিত, কোথাও বা বাগদি, বাউরি-র জনজাতির কেউ। কোথাও আবার জেলেকৈবর্ত কিংবা কুড়মি পুরোহিত। কোথাও তাদের পরিচয় ‘দেহরি’, কোথাও আবার ‘দেয়াসি’ কিংবা ‘লায়া’। পরিচয়ে আলাদা হলেও একটা স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্য সকলেই বহন করছে, প্রত্যেকেই ‘অব্রাহ্মণ’। ক্ষেত্রবিশেষে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ পুরোহিত– রাঢ়বাংলায় সেই সহাবস্থানেরও দেখা মেলে। পুরোহিতহীন দেবস্থান, তাও রয়েছে। ১২টি অধ্যায়ে সেই ‘অব্রাহ্মণ পুরোহিত’দের পরিচয়, জীবনযাত্রা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও আর্য এবং অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধনকে তুলে ধরেছেন লেখক, এই গ্রন্থে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভোলগ্রামে বাগদি সম্প্রদায়ের শশাঙ্ক দিগরের পাকাবাড়িতে পূজিত হন অসিদেব। কোনও দেব-দেবী মূর্তি নয়, অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে পূজিত হয় প্রায় তিন ফুট লম্বা দু’টি খাপমুক্ত তলোয়ার। এই অস্ত্রপুজোর নেপথ্যে রয়েছে এক লড়াইয়ের ইতিহাস। মূলত বর্গী-প্রতিরোধ করে বেলিয়াতোড় অঞ্চলকে রক্ষা করেছিলেন দুই দিগর-যোদ্ধা। তাঁদের আত্মত্যাগকে ভোলেনি বাগদি সম্প্রদায়। মরচে পড়লেও দুই তলোয়ার আজও শৌর্যের প্রতীক হয়ে বিরাজমান দিগর-পরিবারে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই বইতে আঞ্চলিক ও অপৌরাণিক দেবদেবী বা পৌরাণিক দেবদেবীর লৌকিক নির্মাণের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন উপাসক ও ধর্ম সম্প্রদায়ের কথা উঠে এসেছে, তেমনই জায়গা করে নিয়েছে এইসকল লৌকিক দেবদেবীর বিচিত্র ইতিহাস। বেদ-পুরাণ এমনকী মঙ্গলকাব্যে অব্রাহ্মণ পুরোহিতের উল্লেখ রয়েছে। পুরীধামের জগন্নাথের আদিরূপ নীলমাধব, যার পূজারি শবর সম্প্রদায়ের বিশ্বাবসু। সেবাইত হিসেবে আজও যাঁরা পুজো করেন জগন্নাথের, সেই দয়িতাপতিরা অন্ত্যজ সমাজভুক্ত। একইভাবে নিম্নবর্গীর পুজোপাঠের কথা আমরা পাই চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে, কালকেতুর চণ্ডী পুজো প্রবর্তনে। আর ভাগীরথীর পশ্চিমতীর থেকে ছোটনাগপুর মালভূমি পর্যন্ত যে রাঢ়বাংলা, তা আসলে ধর্মঠাকুরের দেশ। যার পূজারি ডোম সম্প্রদায়ভুক্ত। ঝাড়গ্রাম জেলার শুগনিবাঁসা গ্রামে রয়েছে গুপ্তমণির থান। মূলত অরণ্যবাসী শবরদের বনদেবী হলেন গুপ্তমণি। পরে সেইসঙ্গে ভক্তদের দেওয়া দশভুজা দেবী দুর্গা ও সিংহবাহিনী চণ্ডীপ্রতিমাও পুজোলাভ করে। অর্থাৎ অনার্য সংস্কৃতির পাশে আর্য সংস্কৃতির সহাবস্থান স্পষ্ট।
এই লৌকিক-শাস্ত্রীয় পুজোর মেলবন্ধনের পাশে অবাক করার মতো ব্যাপার হল, ‘ছলন’-এর অবস্থান। ‘ছলন’ অর্থাৎ পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়া, যা দেবতার উদ্দেশে দান করেন ভক্তরা। জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের বিশ্বাস, তাদের দেওয়া হাতি, ঘোড়ার পিঠে চড়ে অলক্ষ্যে ঘুরে বেড়ান দেবতারা, রক্ষা করেন বিপদের হাত থেকে। গুপ্তমণি মায়ের পুরোহিত অব্রাহ্মণ। লোধা-কুড়মি অধ্যুষিত শুগনিবাঁসা গ্রামে এই পুরোহিত বংশের বাস। লোকমুখে পরিচিতি ‘দেহরি’ নামে। আবার ঝাড়গ্রামেরই আরেক পূজিত দেবী জয়চণ্ডীর থানে আর্যীকরণের প্রভাব স্পষ্ট। অব্রাহ্মণ লোধা-শবর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি দ্বারা পূজিত হলেও শারদোৎসবের সময় শাস্ত্রীয় উপাচার মেনে দুর্গাপুজো হয় জয়চণ্ডীর থানে।
একই জেলার রাজপাড়া গ্রামে খোলাআকাশের নিচে রয়েছে এক প্রাচীন প্রস্তরপ্রতিমা। মূর্তিটি জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের। স্থানীয় আদিবাসীরা তা পুজো করেন সত্যনায়ারণ জ্ঞানে। বংশপরম্পরায় তার পুজো করেন শবর সম্প্রদায়ের মানুষ। মুণ্ডা দেহরির দেখা মেলে বেলপাহাড়ি ব্লকের পতিরাজগুড়ার দুর্গামায়ের থানে। এখানকার পুরোহিত মুণ্ডা উপজাতির গুণিন সহদেব সিং। দেবীর থানে দুর্গাপুজো হলেও সেখানে কোনও সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ হয় না, ঢাক-ঢোল কাঁসরের তালে তালে চলে পুজোপাঠ। নাচতে নাচতে ভরে পড়েন ভক্তরা। স্থানীয় ভাষায় তাকে বলে ‘ব্যাকড়া লাগা’।
এছাড়াও আছে বাগদি, কেওড়, দণ্ডছত্র, খয়রা দেহরি অর্থাৎ অব্রাহ্মণ পুরোহিত। ভোলগ্রামে বাগদি সম্প্রদায়ের শশাঙ্ক দিগরের পাকাবাড়িতে পূজিত হন অসিদেব। কোনও দেব-দেবী মূর্তি নয়, অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে পূজিত হয় প্রায় তিন ফুট লম্বা দু’টি খাপমুক্ত তলোয়ার। এই অস্ত্রপুজোর নেপথ্যে রয়েছে এক লড়াইয়ের ইতিহাস। মূলত বর্গী-প্রতিরোধ করে বেলিয়াতোড় অঞ্চলকে রক্ষা করেছিলেন দুই দিগর-যোদ্ধা। তাঁদের আত্মত্যাগকে ভোলেনি বাগদি সম্প্রদায়। মরচে পড়লেও দুই তলোয়ার আজও শৌর্যের প্রতীক হয়ে বিরাজমান দিগর-পরিবারে। আবার পশ্চিম মেদিনীপুরে মনসাথান রয়েছে মইশা গ্রামে। সেখানে কোনও পুরোহিত নেই। ভক্তের আরাধনাতেই পূজিত হন দেবী।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: এই বই বইপাড়া থেকে শুরু করে নিবিড় বইপড়ায় ঢুকে যায়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রাঢ়বঙ্গে বিভিন্ন জনজাতির সহাবস্থান। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রয়েছে লোকায়ত দেবদেবীর পূজক হিসেবে তপশিলি জাতি, কুড়মি, আদিবাসী পুরোহিতদের প্রাধান্য। আসলে এঁরাই রাঢ়বাংলার আদিতম মূল বাসিন্দা। আর্য সংস্কৃতির প্রভাব-প্রতিপত্তি লাভের বহু আগে থেকেই এঁরা নিজেদের ধর্ম-সংস্কৃতিকে অনাড়ম্বরে প্রতিপালন করছেন। সেই ধর্মচেতনাকে লোকসংস্কৃতির দৃষ্টিকোণে উপস্থাপিত করেছেন লেখক সুশীলকুমার বর্মন।
মূলত ক্ষেত্রসমীক্ষার ওপরে তৈরি হয়েছে এই গ্রন্থ। দু’টি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন লেখক। এক, মন্ত্রতন্ত্রহীন অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের পুজো অনেক বেশি প্রাঞ্জল, হৃদয়স্পর্শী। দুই, শহর থেকে যত দূরে গ্রাম ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করা গিয়েছে, সেখানে ততই অব্রাহ্মণ পুরোহিতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে যেটুকু দুই মলাটে বন্দি করতে পেরেছেন লেখক, যা সমগ্রের তুলনায় সামান্য। অর্থাৎ শুধু রাঢ়বঙ্গে নয়, গোটা বাংলাতেই ছড়িয়ে রয়েছে অব্রাহ্মণ পুরোহিতদের লোকায়ত সংস্কৃতি, যা উহ্য রয়ে গিয়েছে। তবে ভারতীয় সংস্কৃতি যে আসলে মিশ্র ও স্বতন্ত্র, তার সাক্ষ্যবহন করে এই ক্ষেত্রসমীক্ষা। এমন কঠিন কাজকে মলাটবন্দি করার জন্য লেখকের প্রয়াসকে যেমন কৃতিত্ব দিতে হয়, তেমনই প্রশংসা প্রাপ্য মান্দাস প্রকাশনের, যারা এই কাজটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিকল্প ইতিহাস নির্মাণের পথটাকে আরও প্রশস্ত করেছে।
ছবি: সুশীলকুমার বর্মনের ‘অব্রাহ্মণ পুরোহিত’ বই থেকে সংগৃহীত
অব্রাহ্মণ পুরোহিত
সুশীলকুমার বর্মন
মান্দাস
৩৩০টাকা