স্মৃতিভ্রষ্টতায় ভুগছেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস । ভুলে যাচ্ছেন ভাষা। হারিয়ে ফেলছেন অতীত ও মনকেমন। জীবনের কত অভিজ্ঞতা, কত চোরাস্রোত, কত কঠিন বা সুরম্য বাঁক– সব হয়ে যাচ্ছে আবছা। নেমে আসছে অনিবার্ষ আড়াল। তবু স্মৃতিভ্রষ্ট কর্ণের মতো মার্কেজ তুলে নিচ্ছেন তাঁর অন্তিম আয়ুধ শেষ প্রহরণের অব্যর্থ প্রচেষ্টায়: ‘Until August was the fruit of one last effort to carry on creating against all odds.’ লিখছেন মার্কেজের দুই পুত্র। এই উপন্যাসের সবথেকে বড় গুণ উড়ানের অবিশ্বাস্য গতি। রুদ্ধশ্বাস পাঠে আমাদের যা আটকে ফেলে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সমরেশ মজুমদার– একালের চার বিখ্যাত বাঙালি ঔপন্যাসিক। এঁরা লিখছেন বা লিখেছেন এমন এক সময়ে যখন বাঙালি মেয়ে একলা বারে বসে মদ খায়। সেই ছবিটা কেউ এইভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি, যেমন পেরেছেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর সদ্য প্রকাশিত লস্ট নভেল ‘আনটিল অগাস্ট’-এ:
‘Ana Magdalena Bach ordered a gin with ice and soda, the only alcohol that agreed with her. The world changed with her first sip. She felt mischivous, joyful, capable of anything and beautified by the sacred mixture of music and gin.’
পানশালায় একা অ্যানা।
‘আনটিল অগাস্ট’-এর শুরুতেই প্রায় এই দৃশ্য।
এমন একটি দৃশ্যের বর্ণনায় প্রায় প্রান্তিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ।
স্মৃতিভ্রষ্টতায় ভুগছেন তিনি। ভুলে যাচ্ছেন ভাষা। হারিয়ে ফেলছেন অতীত ও মনকেমন। জীবনের কত অভিজ্ঞতা, কত চোরাস্রোত, কত কঠিন বা সুরম্য বাঁক– সব হয়ে যাচ্ছে আবছা। নেমে আসছে অনিবার্য আড়াল। তবু স্মৃতিভ্রষ্ট কর্ণের মতো মার্কেজ তুলে নিচ্ছেন তাঁর অন্তিম আয়ুধ শেষ প্রহরণের অব্যর্থ প্রচেষ্টায়: ‘Until August was the fruit of one last effort to carry on creating against all odds.’ উপন্যাসটির ভূমিকায় লিখেছেন মার্কেজের দুই পুত্র! ছায়াচ্ছন্ন, ক্রমশ হতাশ, বিষাদময় মার্কেজ আমাদের মনে কর্ণকেই জাগিয়ে তোলেন। মার্কেজের এই উক্তিটি যেন সত্যিই মহাকাব্যের ভ্রষ্ট তবু প্রবাদপ্রতিম নায়কের: ‘This book doesn’t work. It must be destroyed.’– কিন্তু বললেই কি ধ্বংস করা যায়, যদি লেখক হন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ?
স্মৃতিভ্রষ্ট কর্ণ যখন অর্জুনের সামনে এবং জানেন তাঁর মৃত্যু অনিবার্য, তখন কি এই বোধ তাঁর ছিল, এখনও তিনি অর্জুনের মাপে-মাপে সমকক্ষ। হয়তো বা শ্রেয়? স্মৃতিভ্রষ্ট মার্কেজ সম্বন্ধেও সেই প্রশ্ন এই উপন্যাসের ভূমিকায়: ‘The fading faculties that kept him from finishing the book also kept him from realizing how good it was.’
অ্যানা ম্যাগডালেন বাখ্ মদ খাওয়ার পরে কী করে? শুনুন সেই গল্প, অন্তত কিছুটা, বাংলা অনুবাদে। মনে রাখবেন এই লেখা মার্কেজ লিখছেন তাঁর স্মৃতিভ্রষ্টতার চূড়ান্ত পর্যায়ে– কিছুই আর মনে রাখতে পারছেন না তিনি। তাঁর মনের দেউটি একে একে নিভে যেতে যেতে তাঁর সামনে নিরেট-নিটোল অন্ধকার। এই শেষ আলো। দেখুন সেই শেষ আলোর কী সাবলীল বিকিরণ:
অ্যানা একা পানশালায়। তার মনে কেমন যেন সলজ্জ অস্বস্তি, কিন্তু-কিন্তু ভাব। এমন সময় সে দেখল ঠিক তার সামনের টেবিলে এক একলা পুরুষ। পুরুষটির সামনে এক বোতল ব্র্যান্ডি। আর গ্লাসের ব্র্যান্ডি আদ্দেক ফুরিয়েছে। পুরুষটি তার দিকে তাকিয়ে। অ্যানা তার চোখে চোখ রাখল। পুরুষটি লজ্জা পেয়ে রাঙা হল! এবং গ্লাস ভর্তি করল। এবং অ্যানার দিকে সরাসরি তাকাল। অ্যানা হাসল। এবং পুরুষটি মাথা নেড়ে যেন হাসির সাড়া দিল। তারপর বলল, মে আই অফার ইউ আ ড্রিঙ্ক? আর অ্যানা উত্তরে বলল, দ্যাট উড্ বি আ প্লেজার।
পুরুষটি চলে আসে অ্যানার টেবিলে। এবং তারপর এক মনছুট, মননব্যহত, স্মৃতিহারানো লেখকের এই সংক্ষিপ্ত ডিটেলিং: হি মুভড্ টু হার টেবল্ অ্যান্ড ভেরি স্টাইলিশলি পোর্ড হার আ শট। ‘চিয়ার্স’ হি সেড। শি পার্কড্ আপ অ্যান্ড দে নকড্ ব্যাক দেয়ার ড্রিঙ্কস্ ইন ওয়ান্।
এবার পুরুষটির অবস্থা দেখুন: তার তো দম বন্ধ হয়ে গেল অতটা জিন মেশানো ব্র্যান্ডি একসঙ্গে গিলে। ‘হি চোকড্। তারপর দমকা কাশি। সমস্ত শরীর কাশির দমকে কাঁপছে। তারপর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। চোখের জল গড়িয়ে নামছে গাল দিয়ে। পুরুষটি গাল মুছল রুমাল দিয়ে। রুমাল ছড়াল ল্যাভেন্ডারের গন্ধ। একটু পরে পুরুষটি ফিরে পেল কণ্ঠস্বর।’
অ্যান কথায়-কথ্যায় বলল, সে এখন স্টোকারের ড্র্যাকুলা পড়ছে। পুরুষটি বলল, স্কুলে পড়ার সময় সে এ-বই পড়েছিল। একটা দৃশ্য সে ভুলতে পারেনি। কাউন্ট লন্ডনে নেমে দেখছে সমস্ত শহরটা কুকুরে রূপান্তরিত। অ্যানা বলল, কেন যে ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা তাঁর অবিস্মরণীয় ফিল্মে এই দৃশ্যটার পরিবর্তন করেছেন, বুঝতে পারিনি!
এটা কি কোনও স্মৃতিভ্রষ্ট লেখকের লেখা? স্মৃতিশূন্য মনের শেষ আলো!
‘আনটিল অগাস্ট’ উপন্যাসের সবচেয়ে বড় গুণ তার উড়ানের অবিশ্বাস্য গতি। রুদ্ধশ্বাস পাঠে আমাদের আটকে ফেলে ভাষা ও গল্পের দুর্বার দ্রুতি:
অ্যানা পুরুষটিকে বলে: আমরা কি ওপরে যাব?
পুরুষটির উত্তর: আমি তো এই হোটেলে নেই।
অ্যানা বলে: আমি আছি। দরজায় শব্দ করার দরকার নেই। ঠেললেই খুলে যাবে।
অ্যানা চলে যায়। তাড়াতাড়ি শরীরটাকে পোশাক মুক্ত করে। সে দুই সন্তানের মা। এখনও স্তন দু’টি বেশ নিটোল। এবং নুয়ে পড়েনি। সে বাথরুমে গিয়ে দুই উরুর মাঝখানটা ধোয়। বগলে জল দেয়। মুখটা ভাল করে ধোয়। দাঁত মাজার সময় নেই। সামান্য মাজন রেখে দেয় জিভের তলায়। ব্যাস ঘর অন্ধকার। বাথরুমের দরজার চিলতে ফাঁক দিয়ে টুকরো সবুজ আলো। ওই যথেষ্ট।
লোকটা ঘরে ঢোকে। অ্যানা লোকটার শরীর থেকে যত দ্রুত সম্ভব পোশাক ছাড়িয়ে নেয়। সম্পূর্ণ নগ্ন পুরুষটাকে সে তার নীচে রেখে ওপরে চাপে। মনে মনে মেপে নেয় তার পুরুষাঙ্গের সাইজ। স্বামীরটার মতো তাগড়া নয়, মনে হয় অ্যানার। কিন্তু কাজ চলে যাবে। সে চেপে বসে। পুরুষ ঘামছে। তার দম প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। পুরুষটি হঠাৎ বলে, আমি সম্মানিত।
অ্যানা বলে, সম্মানিত? আনন্দ পেলে না? আরও একবার অ্যানা পুরুষটাকে জাগায়। তারপর তৃতীয়বার জাগাতে গিয়ে দেখে, পুরুষটি ঘুমের ভান করছে। অ্যানা তখন নিজেই নিজেকে জুড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে ঘুম ভাঙতে সে দেখল, পুরুষ কেটে পড়েছে। কিন্তু তার বইয়ের পেজমার্কের জায়গায় রেখে গেছে কুড়ি-ডলারের নোট!
ঘৃণায় ভরে যায় অ্যানার মন। পুরুষটিকে কাছে পেলে সে পুড়িয়ে মারত!
অ্যানার মনে এক আকস্মিক প্রশ্ন। লোকটার নাম পর্যন্ত জানা হয়নি। আর ওই কুড়ি ডলার, যা সে রেখে গেছে। ইশ! কী ছোটলোক! কিন্তু ডলারটাকে তো ছিঁড়ে ফেলতে পারছে না অ্যানা। আবার খরচ করতেও ঘেন্না করবে তার চিরকাল। ওই বিশ ডলার থেকে মুক্তি? কীভাবে? এরপর?
একটা নেশায় পেল অ্যানাকে।
কেমন নেশা?
না-ই বা বললাম। জানতে এই অবিস্মরণীয় উপন্যাস পড়তেই হবে।
মার্কেজ-এর শেষ আলো বলে কথা! চেনায় নারীকে। দেয় তার শরীর, মন, প্রেম ও চাহিদার খোঁজ।
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।