একটা ছোটগল্প সম্পাদকের দরবারে পেশ করেছিলাম, সেটা তাঁর পছন্দ হয়নি। মানে, প্রথম দিকটা হয়েছিল, কিন্তু শেষের দিকটা হয়নি। গল্পটা নিয়ে আমার মনটাও বেশ খুঁতখুঁত করছিল। এমনটাও ভেবেছিলাম যে, এই অবস্থায় গল্পটা বেরিয়ে গেলে বিষয়টা মাটি হয়ে যাবে! বিষয়টা খুব অদ্ভুত। একটা আত্মহত্যা। এক পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার আত্মহত্যা করেছেন প্রচলিত উপায়ে নয়। না খেয়েছেন ঘুমের ওষুধ, না দিয়েছেন গলায় ফাঁস। ‘অন্তর্ঘাত’ নামের দ্বিতীয় উপন্যাস লিখলাম, এই সব বাস্তব ঘটনা, আমার দেখাশোনা, আর আত্মহননকারী ইঞ্জিনিয়ারটিকে ঘিরে। ঘটনাচক্রে চলনটা হল ডিটেকটিভ উপন্যাসের মতো, যেটা আবার আমি একেবারেই লিখতে পারি না। সেই সঙ্গে সময়কে আগে-পিছে করে একটা নতুন ছক তৈরি হল ন্যারেটিভের।
কোনও মানবী যখন প্রথন সন্তান গর্ভে ধারণ করে, সচরাচর সেটা হয়ে থাকে তালেগোলে। দ্বিতীয় জনের বেলায় কিন্তু সেটা সাধারণত হয় না। তখন থাকে সচেতন ইচ্ছা, কিছু অন্তত পরিকল্পনা, বেশ কিছুটা প্রস্তুতি। আমার উপন্যাসের বেলাতেও অনেকটা এমনই ঘটেছিল। আর কে না জানে, শিল্প জিনিসটা স্রষ্টার সন্তানের মতোই, মানসভূমির। এই উপমাটা আরও দূর পর্যন্ত টানা যায়। নারী নাকি তার প্রজনন ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়, লেখকও একরকম তাই। কখন তার বীজ ভ্রূণে পরিণত হবে, সেটা অন্য কতকগুলো ঘটনার ওপর নির্ভর করে।
প্রথম যে উপন্যাস লিখলাম, অর্থাৎ, ‘জন্মভূমি মাতৃভূমি’, তা আসলে চটজলদি লেখা হয়েছিল, অপ্রত্যাশিত একটা ফরমায়েশের ফলে। অভিজ্ঞতা ছিল না, আত্মবিশ্বাস ছিল না, ইচ্ছাও ছিল না। এই লেখক তখন ছোটগল্পে নিবেদিত, অন্য কোনও দিকে চোখ তুলে তাকান না! আর উপন্যাসের অবস্থান ছোটগল্পের ঠিক উল্টোদিকে– এ কথা তো সবাই জানে। সে লেখাটি বৃষ্টির জলে কাগজের নৌকা ভাসানোর মতো, মনের আনন্দে ভাসিয়ে তো দেওয়া হল, কোথাও পৌঁছবে কি না, কে জানে! তা সে যখন সম্পাদক ও পাঠকচিত্তে পৌঁছে গেল তখন মন বলল, তবে তো এ পথে এগোনোই যায়! তখন শুরু হল প্ল্যান, প্রস্তুতি ইত্যাদি।
হয়েছিল কী, একটা ছোটগল্প সম্পাদকের দরবারে পেশ করেছিলাম, সেটা তাঁর পছন্দ হয়নি। মানে, প্রথম দিকটা হয়েছিল, কিন্তু শেষের দিকটা হয়নি। গল্পটা নিয়ে আমার মনটাও বেশ খুঁতখুঁত করছিল। এমনটাও ভেবেছিলাম যে, এই অবস্থায় গল্পটা বেরিয়ে গেলে বিষয়টা মাটি হয়ে যাবে! বিষয়টা খুব অদ্ভুত। একটা আত্মহত্যা।
মানুষটি আত্মহত্যা করেছেন প্রচলিত উপায়ে নয়। না খেয়েছেন ঘুমের ওষুধ, না দিয়েছেন গলায় ফাঁস। এমনকী, কবজির ওপর ব্লেডের ব্যবহারও করেননি। তিনি সুইচ বোর্ডের কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসেছেন আসনপিঁড়ি হয়ে, আর বোর্ড থেকে বের করে নিয়েছেন জ্যান্ত তার, সেটা দিয়ে নিজের শরীরটাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধেছেন, তার পরে দিয়েছেন সুইচটা অন করে! শরীরটা একেবারে সাদা হয়ে গেছে।
আমার এক কলিগের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনলাম। সে নিজে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল, আমিও খেলাম ফোর ফর্টি ভোল্টের এক মহা-শক! পরে বাড়ি এসে আর ভুলতে পারি না। আমি তো গোয়েন্দা নই, বুঝতে চেষ্টা করি, কী ঘটলে একজন পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার মানুষ এভাবে নিজেকে মারতে পারেন। একটা শকই তো যথেষ্ট, সেখানে নিজেকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তারে বাঁধা। কেন? একজন আত্মীয়-ডাক্তারের কাছে গেলাম, জিজ্ঞেস করি, এভাবে নিজেকে তারে বাঁধলে কী হতে পারে! তিনি বললেন, ‘মুহূর্তে সারা শরীরের রক্ত জমে যাবে।’
–মৃত্যু তো তৎক্ষণাৎ, না কি? কষ্ট কি কম?
–মে বি অ্যান ইন্সট্যান্ট, ব্যাট দ্যাট ইন্সট্যান্ট ইজ অ্যান ইটারনিটি। আমি ডাক্তারকাকুর কথা অবিকল উদ্ধার করছি।
ভাবি, সবচেয়ে সহজ সমাধান– প্রেম। তিনি হয় তো কোনও অগম্যার প্রেমে পড়েছিলেন। কাজিন, হয় তো বোন, হয় তো বউদি! কিন্তু, একজন পূর্ণবয়স্ক যুবক, যিনি বেশ কয়েক বছর চাকরি করে চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদে পৌঁছে গেছেন, তিনি এমনটা করবেন? এর মধ্যে একটা টিনএজার মন লুকিয়ে আছে না? এই ধরনের প্রেম হয় মানুষকে উদভ্রান্ত করে দেবে, নয় তো করে দেবে বেপরোয়া। সেই মন নিয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদে পৌঁছনোর উপযুক্ত পড়াশোনা করে তৈরি হওয়াটা সোজা নয়। উপরন্তু ঘটনাটা ঠিক প্রচণ্ড কষ্টের নয়, বরং একটা প্রচণ্ড আত্মগ্লানির, নিজেকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার গল্প বলছে। নিজের কিছুটা অজান্তে কেউ যদি প্রচণ্ড অন্যায় করে বসে, তা হলে হয়তো বিবেকীজন এভাবে নিজেকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবলেও ভাবতে পারে।
প্রথমে ওই অসম্ভব প্রেম নিয়েই গল্পটা এগোই, কিন্তু আগেই বলেছি, সেটা আমার মনঃপূত হয়নি। অতএব পড়ে রইল গল্প। পড়ে আছে, পড়ে আছে, এবার তার ওপরে বিস্মরণের বালি জমতে থাকে। কিন্তু ভুলে থাকা সে তো সত্যিই ভোলা নয়। তলায় তলায় পড়তে থাকে স্মৃতির পলি, সেইসব স্মৃতি যারা দুঃসহ, বৃহত্তর জীবনে, অন্তরঙ্গ জীবনেও। নাতিদূর অতীত, বড় বড় অক্ষরে সেখানে জেগে উঠেছে নকশাল বিদ্রোহ। আমার এক দাদার সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার কাহিনি, আমাদের পাড়ায় উত্তর কলকাতার রাস্তায় খুন হওয়া পাড়ার ছেলে, পুলিশের অত্যাচারে বীভৎস ভাবে পঙ্গু সব নিপীড়িত যুবক-যুবতী। এদের মধ্যে কতজন একেবারে বরবাদ হয়ে গেল, কতজন আবার ওপরমহলে চেনাশোনার ফলে বিদেশে পালিয়ে গেল। সেখানে অন্যরকম জীবন, কেরিয়ার, আবার জীবনের স্বাদ, তখন হয়তো ফোকাস সরে গেছে, স্মৃতি আবছা, নিজের করা অতীত কর্মগুলির ব্যাপারে নিজের সঙ্গে নিজের একটা সমঝোতা হয়ে গেছে। এইসব যুবক বেশিরভাগই মেধাবী, রক্ত গরম বয়সে চলতি ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ভেবেছিল, সমাজবদলের আন্দোলনে কারিগর হবে, তাই হাতে তুলে নিয়েছিল বন্দুক, মগজে গেরিলা যুদ্ধের নকশা। বছর দশ যদি বিদেশে নির্বিঘ্নে কেটে গিয়ে থাকে, তাহলে জীবনটাকে স্বাভাবিক ভাবতে তো অসুবিধে নেই। বুদ্বুদ উঠেছিল, বুদ্বুদ মিলিয়ে গেছে!
বুদ্বুদ কিন্তু মিলিয়ে যায় না। নিজের সহ্যশক্তির অভাবে সে যদি কারও গোপন কথা বলে দিয়ে থাকে, আমার মতে, তাকে দোষ দেওয়া যায় না, দোষ দিতে হলে দিতে হয়, তার ওই আত্মসমীক্ষার অভাবটাকে। আর দোষ দিতে হয় আন্দোলনের গুরুদের, যাঁরা তাঁদের রিক্রুটদের পড়তে পারেননি, বা পড়বার চেষ্টাই করেননি। সব মানুষ তো বীরপুরুষ হয়ে জন্মায় না। আরও বহু রকমের মানুষ আছে, সমাজে তাদের প্রয়োজনও আছে। তারা কেউ ফেলনা নয়।
‘অন্তর্ঘাত’ নামের এই দ্বিতীয় উপন্যাস লিখলাম, এই সব বাস্তব ঘটনা, আমার দেখাশোনা, আর ওই আত্মহননকারী ইঞ্জিনিয়ারটিকে ঘিরে। ঘটনাচক্রে চলনটা হল ডিটেকটিভ উপন্যাসের মতো, যেটা আবার আমি একেবারেই লিখতে পারি না। সেই সঙ্গে সময়কে আগে-পিছে করে একটা নতুন ছক তৈরি হল ন্যারেটিভের।
সুমন্ত/অন্তু নামের ওই ইঞ্জিনিয়ার এককালে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ সময় বিদেশে নাম যশ কামিয়ে তিনি এখন ফিরে আসছেন স্বদেশের প্রতি অমোঘ টানে। তিনি ভেবেছেন সে সব দিন অতীতের গর্ভে, কেউ অত খুঁটিনাঁটি মনে রাখেনি। তবুও সাবধান মানুষ বড় কোনও শহরে, নামজাদা কোনও কোম্পানিতে যোগ দেননি। চাকরি নিয়েছেন মফস্সলের এক মাঝারি মাপের মিলে। তবু আসবার দিনেই তাঁর চোখে পড়ে যায় এক রিকশাবাহিনী নারী, যাঁকে তিনি বিলক্ষণ চেনেন। তিনি জানেন না, ওই মিলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে আরও জনাকয়েক, তাদের উপলক্ষ করেই আবির্ভাব ঘটবে আরও কয়েকজনের, যাদের সবাইকে তিনি চেনেন, এখন কেউ আর কাউকে অতীতের পরিচয় দিতে চান না।
এখানেই ঘটে সেই শোকাবহ, অদ্ভুত আত্মহত্যা, যার জট ছাড়াতে গিয়ে জেগে ওঠে এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি, ঘটে এক আত্মঘাত, যা আসলে এক হত্যা কি না, এমন সন্দেহ ঘুরতে থাকে চারদিকে, তা অতীতের কোনও অন্তর্ঘাতের প্রতিশোধ হতে পারে, নাকি তা পুরনো কোনও পাপের প্রায়শ্চিত্ত?
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….
এই উপন্যাসটি নানা প্রতিক্রিয়া জাগায়। প্রাক্তন নকশালরা বিরক্ত হন। আত্মহত্যার ঘটনাটি কষ্টকল্পনা মনে হয় কোনও কোনও লেখক-সমালোচকের। আমি শুনে হাসি। একেই বলে ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’। অনেক সম্পাদক ভাবতে থাকেন এক নতুন গোয়েন্দা উপন্যাসের লেখক পাওয়া গেছে, আর কে না জানে, গোয়েন্দা কাহিনি মানেই পত্রিকার টিআরপি তুঙ্গে! পাঠকরা যখন তুমুল অভিনন্দন জানান, এই লেখক তখন বিমর্ষ চিত্তে ভাবতে বসেন, এ কি ওই গোয়েন্দাকাহিনির গন্ধের জন্য, না উপন্যাসে তোলা ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কিত অমোঘ প্রশ্নগুলির জন্য, নাকি ন্যারেটিভের চলনের নতুনত্বের জন্য?
উত্তর আজও মেলেনি।
… দ্বিতীয় বই-এর অন্যান্য লেখা …
তিলোত্তমা মজুমদার-এর লেখা: ‘মানুষশাবকের কথা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে আগ্রহী, হঠাৎ পোস্টকার্ড এসেছিল বাদল বসুর
সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: আমার জীবনের দ্বিতীয় বই-ই লেখক হিসেবে আমার প্রথম বই
স্বাগতা দাশগুপ্ত-র লেখা: আমার দ্বিতীয় বই বিক্রি করলেন না প্রকাশক, লিটল ম্যাগাজিনের টেবিল থেকেও ফিরে এল
রাণা রায়চৌধুরী-র লেখা: ‘শরীরে সন্দীপন নেই’ হল আমার তারুণ্যের অপমান ও ব্যথার সৌন্দর্য-দাগ
মৃদুল দাশগুপ্ত-র লেখা: জুতোর বাক্সে কবিতা জমাতাম, ভাবতাম, চাকরি পেলে একদিন বই হবে
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: আমায় ডিরেক্টর বানিয়েছে আমার আদরের দ্বিতীয়
স্বপ্নময় চক্রবর্তী-র লেখা: হলদে গোলাপ নয়, নবম পর্ব-ই তোমার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, বলেছিলেন বুদ্ধদেব গুহ
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: আমার সমস্ত ভয়েরিজম নিয়েই দ্বিতীয় বইতে নিজের প্রেমপত্রটি রেখেছি
মন্দাক্রান্তা সেন-এর লেখা: অবাধ্য হৃদয়ের কথা অন্যভাবে বলতে চেয়েছিলাম আমার দ্বিতীয় বইয়ে
অনিতা অগ্নিহোত্রী-র লেখা: পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ শুধু নয়, বহু অনাগত উপন্যাসের সম্ভাবনাও ছিল ‘বৃষ্টি আসবে’ বইটিতে