বইপাড়ার একাধিক প্রকাশনা সংস্থা অনুবাদের কাজ করছে, বিদেশি সাহিত্যের। যেমন ‘সম্পর্ক পাবলিশিং হাউস’। সম্প্রতি তিনটি অনুবাদ গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেছে তারা। যথাক্রমে ‘আয়ারল্যান্ডের গল্প সংগ্রহ’, ‘ফিনল্যান্ডের গল্প সংগ্রহ’ এবং ‘ওয়েলসের গল্প সংগ্রহ’। তিনটিরই অনুবাদক সুনন্দন রায়চৌধুরী। যে কোনও ভিনদেশি কাহিনিপাঠে ‘বোনাস’ আনন্দ থাকে। সেই বোনাস হল এক্কেবারে অজানা জীবনে ট্রেক। ইউরোপের তিনটি দেশের গল্প পড়তে পড়তে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা সেখানকার ভূপ্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। এমনকী, মেলে ইতিহাসের টুকরো ঝলক। সেই মতো গল্পের চরিত্রদের মানসিক গঠনেরও মিল ও অমিল চোখে পড়ে।
প্রতিবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হতেই অশিক্ষিত মনে হয় নিজেকে! এই যেমন, ২০২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পেলেন নরওয়ের নাট্যকার জন ফস। নোবেল অ্যাকাডেমির সার্টিফিকেট বলছে, অননুকরণীয় গদ্য ভাষায় না বলা কথাকে কণ্ঠ দিয়েছেন ফস তাঁর নাটকে। নরওয়ের ভাষা হল নিনর্স্কে। সেই ভাষাতে নাটক, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, এমনকী অনুবাদের কাজও করেছেন ফস। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেল, যেসব নাট্যকারদের নাটক এখন পাশ্চাত্যে সবচেয়ে বেশি অভিনীত হয়, তাঁদের অন্যতম হলেন ফস। পাশাপাশি তাঁর গদ্যও বিপুল জনপ্রিয়। এই কৃতি লেখক এক বিশেষ লিখন শৈলীর জনক। যার পোশাকি নাম ‘ফস মিনিমালিজম’। এখন প্রশ্ন হল, ঠিক কতজন বাঙালি পাঠক জন ফসকে পড়েছেন? মাফ করবেন, আমার পরের প্রশ্ন– কর গুনে বলুন, ঠিক কতজন বাঙালি লেখক ফস ও তাঁর ‘ফস মিনিমালিজম’ সম্পর্কে অবগত?
উত্তর খুব আশাপ্রদ হবে না। এর মধ্যে অন্যায়ও নেই। আর ঠিক এখানেই ভূমিকা রয়েছে অনুবাদ সাহিত্যের। বইপাড়ার একাধিক প্রকাশনা সংস্থা সাধ্য মতো সেই কাজ করছেও। যেমন ‘সম্পর্ক পাবলিশিং হাউস’। সম্প্রতি তিনটি অনুবাদ গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেছে তারা। যথাক্রমে ‘আয়ারল্যান্ডের গল্প সংগ্রহ’, ‘ফিনল্যান্ডের গল্প সংগ্রহ’ এবং ‘ওয়েলসের গল্প সংগ্রহ’। তিনটিরই অনুবাদক সুনন্দন রায়চৌধুরী। ‘আয়ারল্যান্ডের গল্প সংগ্রহ’-র সংকলক ব্রায়ান ও কঙ্কুভার। এখানে রয়েছে আয়ারল্যান্ডের সাত জন গল্পকারের সাতটি গল্প। ‘ফিনল্যান্ডের গল্প সংগ্রহ’-র সংকলক সুনা ওন্দার। এক্ষেত্রে রয়েছে দশ গল্পকারের দশটি গল্প। ‘ওয়েলসের গল্প সংগ্রহ’-এ লেখকের সংখ্যা দশ, গল্পও দশটি। অনুবাদক সুনন্দন এই গ্রন্থের সংকলকও বটে। এসবই আনন্দের কথা কৌতূহলী বাঙালি পাঠকের জন্য। যে কোনও ভিনদেশি কাহিনিপাঠে ‘বোনাস’ আনন্দ থাকে। সেই বোনাস হল এক্কেবারে অজানা জীবনে ট্রেক। ইউরোপের তিনটি দেশের গল্প পড়তে পড়তে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা সেখানকার ভূপ্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। এমনকী, মেলে ইতিহাসের টুকরো ঝলক। সেই মতো গল্পের চরিত্রদের মানসিক গঠনেরও মিল ও অমিল চোখে পড়ে।
ওয়েলসের গল্প সংগ্রহে রয়েছে লেখক ডোবরা কে. ডেভিসের ‘চুম্বন বাসনা’ নামের একটি গল্প। প্রধান চরিত্র গ্রেস নামের এক বালক। যে দশ বছর ছয় মাস বয়সে প্রথমবার প্রেমে পড়ে। এর পর থেকেই চুম্বনের ‘অনুশীলন’ শুরু করে। প্রথমে মাথার বালিশের সঙ্গে, পরে সহপাঠী নিনার সঙ্গে। কাহিনির শেষদিকে কিট নামের এক যুবকের প্রবেশ ঘটে। এই গল্পে প্রেম, শরীর, সমকাম, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি টান গুলিয়ে যায় গ্রেসের, পাঠকেরও। আয়ারল্যান্ডের গল্প সংগ্রহে রয়েছে গ্যাব্রিয়েল রোসেনস্টকের ‘কাডিস’ নামের একটি গল্প। বোর্ডিং স্কুলের প্রাক্তনীদের পুনর্মিলনের এই গল্প চূড়ান্ত বিমর্ষতা ও বাস্তবতার নয়া পাঠ। একজন বাঙালি পাঠকের জন্য ফিনল্যান্ডের গল্প সংগ্রহের প্রথম গল্প ‘শীতের আস্তানা’ এক কঠিন অভিজ্ঞতা। পেট্রি টাম্মিনেন লিখিত এই গল্পকে বুঝতে হল সে দেশের নারকীয় শীত সম্পর্কে খানিক ধারণা থাকা জরুরি। হিমাঙ্কের নিচে নামা ভয়ংকর ঠান্ডা আর ধূসর তুষারপাতের দুনিয়ায় ‘শীতের আস্তানা’ও কাহিনির চরিত্র হয়ে ওঠে।
সুদূর ইউরোপের এহেন যাপনের অনুবাদ রীতিমতো শক্ত কাজ। আগেই বলেছি ‘সংস্কৃতিক মানচিত্র’-এর বিপুল পার্থক্যের কথা। এক্ষেত্রে তিন গল্প সংগ্রহের অনুবাদক সুনন্দন একইসঙ্গে সফল এবং ব্যর্থ। গল্পগুলি পড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বটে, কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই স্বাদগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জটিল বাক্যগঠন। মূল লেখকের বয়ানকে হুবহু রাখার চেষ্টাতেই কি ভাষান্তর এতখানি খটমট? সারি মিক্কোনেনে রচিত ফিনল্যান্ডের গল্প ‘রাতজাগা পুরুষ’ শুরু হয়– ‘কদাচিৎ একটা রাত যেত, যখন আমি ওর দিকে মন দিতে পারতাম, জানি ও ক্ষুণ্ণ হবে, তবু অন্যথা করার চেষ্টা করতাম না।’ এই ‘কদাচিৎ একটা রাত যেত’ কিংবা ‘অন্যথা করার চেষ্টা করতাম না’-র মতো বাংলা তিনটি বইতে রয়েছে। আরও এক অভাবের কথা বলতেই হচ্ছে, তিন গ্রন্থে দূরদেশের অচেনা লেখকদের পরিচিতিও নেই। জন্মসালেরও উল্লেখ নেই। এর ফলে পাঠকের জখম বেড়েছে। কাহিনির স্থান-কাল-পাত্র বিষয়ে অন্তহীন কল্পনাই একমাত্র পথ।
অনুবাদ যে সহজ কাজ না, তা সবার জানা। বড় উদাহরণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। নোবেল পাওয়ার পরেও কবিকৃত আপন কাব্যের অনুবাদ নিয়ে সংশয়ে বাঙালি পাঠক। যদিও সংস্কৃত সাহিত্যের পাশাপাশি ইউরোপীয় সাহিত্যেরও অনুবাদ করছিলেন ‘বিশ্বকবি’। তার মধ্যে রয়েছে ভিক্টর উগো, শেলি, হাইনে, গ্যেটে প্রমুখ। শিশুপাঠ্য গুচ্ছ অনুবাদ করেছিলেন সুকুমার রায়। পরবর্তীকালে বুদ্ধদেব বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অন্নদাশংকর রায়, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফাদার দ্যতিয়েন, অরুণ মিত্র, ক্ষেত্র গুপ্ত এবং আরও অনেকেই ।
বলা বাহুল্য, প্রত্যেকেই কঠিন চ্যালঞ্জের মুখে পড়েছেন। বাংলা ‘ছাব্বিশ পরগনা’, ‘ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুর’, ‘লোটা-কম্বল’-এর অনুবাদ যেমন সম্ভব না, বিদেশি অনুষঙ্গের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সমকালীন বঙ্গ সাহিত্যের অন্যতম প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, অগ্রগণ্য ফরাসিবিদ চিন্ময় গুহ ‘বাংলা অনুবাদের সমস্যা’ শিরোনামের লেখায় বলেছিলেন, ‘একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ অনুবাদের যে কী যন্ত্রণা সেটা সৎ অনুবাদক মাত্রই জানেন। একটি রচনাকে এক ভাষাপদ্ধতি থেকে অন্য ভাষাপদ্ধতিতে, একটি সাংস্কৃতিক মানচিত্র থেকে অন্য একটি সাংস্কৃতিক মানচিত্রে, একটি semantic network থেকে অন্য একটিতে, যার অন্য একটি সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ইতিহাস আছে, পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে যন্ত্রণাকে স্নায়ুতে বহন করতে হয়, তার প্রস্তুতি সবসময় আমাদের থাকে না।’ এই প্রসঙ্গে চিন্ময় শ্লেগেলের উক্তি ধার করেন– ‘অনুবাদকের সঙ্গে লেখকের এ এক রক্তক্ষয়ী খণ্ডযুদ্ধ– a deadly dule, যেখানে কোনও একজনের মৃত্যু হবে, হয় লেখক বা অনুবাদকের। এই হত্যা এড়াতে অনুবাদককে এক ভারসাম্য আনার চেষ্টা করতে হয়।’ এই ভারসাম্য যত সূক্ষ্ম হবে, তত সুখের হবে অনুবাদ সাহিত্য পাঠ।
আয়ারল্যান্ডের গল্প সংগ্রহ
ফিনল্যান্ডের গল্প সংগ্রহ
ওয়েলসের গল্প সংগ্রহ
অনুবাদক সুনন্দন রায়চৌধুরী
সম্পর্ক পাবলিশিং হাউস। প্রতিটি ১৪০ টাকা