আমি তো বলেছিলাম আমার অ্যালবামে ‘গান’ কথাটারই উল্লেখ না থাকলে ভালো হয়। সেখানে ‘জীবনমুখী’ শব্দটা এল কেন? আমি তো কোনও রকমে মেনে নেব না ‘জীবনমুখী’ শব্দটা। কিছু একটা করতে হবে, নইলে পোস্টার দেওয়ার দরকারই নেই। শেষে আমি, অফিসের বেয়ারা হারুদা– দু’জনে মিলে বসে পোস্টার থেকে ‘জীবনমুখী গান’ কাঁচি দিয়ে কাটতে শুরু করেছিলাম। ভাগ্য ভালো লাইনগুলো একদম নীচের দিকে ছিল, তাই রক্ষে। নইলে হয়তো আমাকে মেনে নিতে হত, আমি আমার গানকে ‘জীবনমুখী’ বলি।
১০.
শূন্য থেকেই তো শুরু হয়, আবার পৌঁছতে হয় শূন্যে। এই জীবনে শূন্য থেকে শূন্য, জিরো টু জিরো ফর্মুলাতেই চলছে দেখছি সব। কোথায় ছিলাম আমরা, আর যাবই বা কোথায়, শূন্য থেকে শূন্যে যাওয়ার জীবনের এই জার্নির মাঝেও আরও কত কিছুরই শূন্য থেকে শুরু হয়ে শূন্যে চলে যায়।
শুয়েছিলাম, হামাগুড়ি দিলাম, হাঁটলাম, ছুটলাম, দৌড়লাম। আবার দৌড় বন্ধ। হাঁটা শুরু, হামাগুড়ি, আবার শুয়ে পড়ব, তারপর মিলিয়ে যাব শূন্যে, মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা উল্টো শুরু হলে কীরকম হত। বার্ধক্য থেকে যদি শুরু হয়ে পৌঁছতাম শৈশবে।
আমার গানের শৈশব শুরু হয়েছিল যখন, তখন আমার যৌবন, জেদের বশে, রাগের চোটে। এবং নিজের সৃষ্টিগুলোকে হারানোর ভয় থেকে। সেই ভয় সাংঘাতিক, সন্তান হারানোর মতো সে উদ্বেগ। আর সে শুধু হারানোর গল্প নয়, চোখের সামনে নিজের সন্তানকে অন্য কারও সন্তান বলে পরিচিত হতে দেখলে যেমন মানসিক যন্ত্রণা, আমার লেখা, সুর করা গান যদি কেউ বলতে থাকে তার নিজের, সেটা প্রায় সেরকমই। সেই যন্ত্রণা থেকেই আমার মোটিভেশন। শেষে আমার প্রথম অ্যালবাম ‘ভূমিকা’ বেরল, শুরু হল আমার গায়ক জীবন। মনে আছে রিলিজের আগে পোস্টার ছেপে এসেছে, মিউজিক কোম্পানির অফিসে বসে হারুদা, আমি আর অনুপমদা। অনুপমদা, যার হাত ধরে আমার রেকর্ড করা। গানের পোস্টার এল, পোস্টার খুলেই চোখে পড়ল ‘জীবনমুখী’ শব্দটা।
পোস্টারে আমার একটা প্রোফাইল ছবি, এ ছবিরও এক মজার গল্প আছে। যাক গে। সেই ছবির সঙ্গে পোস্টারে অন্যান্য তথ্য ছাড়াও যেটা দেওয়া আছে, সেটা হল ‘‘শিলাজিতের ন’টি জীবনমুখী গান’’। এটা কী হল জানদা, আমি তো বলেছিলাম আমার অ্যালবামে ‘গান’ কথাটারই উল্লেখ না থাকলে ভালো হয়। সেখানে ‘জীবনমুখী’ শব্দটা এল কেন? জানদার কপালে ভাঁজ। এখন কী উপায়, আমি তো কোনও রকমে মেনে নেব না ‘জীবনমুখী’ শব্দটা। কিছু একটা করতে হবে, নইলে পোস্টার দেওয়ার দরকারই নেই। জানদার সংশয় অত টাকা দিয়ে অতগুলো পোস্টার জলে যাবে। আমি নাছড়বান্দা। শেষে আমি, অফিসের বেয়ারা হারুদা– দু’জনে মিলে বসে পোস্টার থেকে ‘জীবনমুখী গান’ কাঁচি দিয়ে কাটতে শুরু করেছিলাম। ভাগ্য ভালো লাইনগুলো একদম নীচের দিকে ছিল, তাই রক্ষে। নইলে হয়তো আমাকে মেনে নিতে হত, আমি আমার গানকে ‘জীবনমুখী’ বলি। কয়েক হাজার পোস্টার। সব কাটতে পারিনি, কিছু পোস্টারে নিশ্চয়ই সে লাইন থেকে গেছিল, থাকতে বাধ্য। এই দু’-হাজার তেইশ সালে এসেও অনেক ঘোষক দাবি করে ফেলেন, আমি জীবনমুখী গান গাই। সব কেটে ফেলা যায় না। বুঝেছি কিছু বাকি থেকে যায়। সব রং ক্যানভাসে পড়ে না, কিছু রং শুকিয়ে যায় প্যালেটে, শিল্পীকে ঘষে ঘষে তুলতে হয়। আবার কোনও সময় সে প্যালেটের রঙের ওপর রং চেপে কালশিটে পড়ে যায়।
সব মেঘেই তো বৃষ্টি হয় না। কোথায় যায় তারা। অন্য আকাশে চলে যায় নাকি কে জানে, হয়তো কিছু মেঘ থেকে যায় মেঘ হয়েই।
পড়ুন শিলালিপি-র আগের পর্ব: বারবার শূন্য থেকে শুরু করতে হলেও রাজি আছি
সে মেঘ থাকুক মেঘের মতো। আমি কিন্তু গায়ক ছিলাম না। আমি ক্রিকেট খেলতে চাইতাম। নাচতে ভালো বাসতাম। গায়ক হব ভাবিনি ’৮৪-’৮৫ সালের আগে। আর তার পরে গান লিখব, সুর করার একটা মজা থাকলেও, সে গান যে আমি গাইব, আমার ভেবে ওঠা হয়নি। ভেবেছিলাম অন্য কেউ গাইবে, মনে মনে ভাবতাম এই গানটা স্বপন বসু গাইবে, এটা উষাদি, এটা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, এটা অজয় চক্রবর্তী– কিন্তু কীভাবে পৌঁছব তাঁদের কাছে। আমার গানজানা বন্ধুদের একজনও আমার গান কাঁচা অবস্থায় শুনে দূরছাই করেনি, কিন্তু তাদের বিভিন্ন মকসদ ছিল। তাদের কাছে গান গাওয়া ছিল হবি, আসলে আমরা তখন সবাই পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করাটাকে হবিই ভাবতাম। আমিও তাই ভাবতাম, পেশাদার শিল্পী হওয়া আমাদের কাছে অন্য গ্রহের কাজ-কারবার বলেই মনে হত। নেহাৎ আমি অস্তিত্ব সংকটের বিপদে পড়লাম বলে অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য হয়েছিলাম। নইলে এতদিনে হয়তো কোনও মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বা মার্কেটিংয়ের দপ্তরে কাজ করতাম, বা হয়তো কোনও কোম্পানির সাবান বেচতাম, বা টিকিট বেচতাম বাসে। কিছু না কিছু করে শরীর বেচেই খেতাম, তবে যাই হতাম না কেন আমি জানতাম আমি জনপ্রিয় হব। ছোটবেলা থেকেই জনপ্রিয় হওয়াটা আমার অভ্যেসের মতো ছিল। আমি গুন্ডা হলেও জনপ্রিয় গুন্ডাই হতাম। সরকারি চাকরি বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার এসব হতে আমি পারতাম না নিশ্চিত, কিন্তু আমি গুন্ডা হলেও হয়ে যেতে পারতাম। মাঝেমধ্যে আমার মধ্যে একটা গুন্ডা গুন্ডা ভাব চলে আসে আমি দেখেছি। এ ডিজিটাল পত্রিকার সম্পাদক তো আমাকে বহুদিন আগে ‘বাংলা গানের গুন্ডা’ বলেই আখ্যা দিয়েছে। আমার জীবনের কিছু গুন্ডামির কথা বলব সময় হলে। কিন্তু আপাতত একটু জিরো টু জিরো দর্শন নিয়ে হালকা দার্শনিকগিরি করতে ইচ্ছে করছে।
জনপ্রিয় আমি ছিলাম, গায়ক হিসেবে পরিচিত হওয়ার পর তা বাড়ল হয়তো। স্কুলে, কলেজে, পাড়া, অফিসে, ছোট এলাকাতেও আমি জনপ্রিয় ছিলাম। কিন্তু গায়ক হওয়ার পর গোটা পশ্চিমবঙ্গে পপুলার হলাম, ফলে মাত্রাটা বেড়ে গেল, এই পর্যন্ত। অনেক বেশি মানুষ আমাকে চাইতে শুরু করল, আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম সেটা, কিন্তু আমার পরিচিত অনেকেই স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারল না। যেমন হয় আর কী! সব ক্ষেত্রে এবং সবার ক্ষেত্রেই আমাকেও নানা ব্যাঘাতের মুখোমুখি হতে হল। কিন্তু আমি গায়ক হয়ে গেলাম, ছিলাম বিজ্ঞাপনের বেচুবাবু, হয়ে গেলাম গানের ব্যাপারী।
পড়ুন শিলালিপি-র অন্য পর্ব: শিলাজিৎ মুম্বইতে কী হারাবে পাগলা, মুম্বই হারিয়ে ফেলতে পারে শিলাজিৎকে
শুরু হল শূন্য থেকেই। পশ্চিমবঙ্গের গানের বাজারের ঘাঁতঘোঁত আমার জানা ছিল না। জানতে শুরু করলাম, বুঝতে শুরু করলাম একটু একটু করে, চাকরি আর গান কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। গুলিয়ে যাচ্ছিল। বেসরকারি কোম্পানির কাজের চাপের থেকেও বেশি চাপ লাগছিল মিউজিক কোম্পানির ডিম্যান্ডে– বছরে একটা অ্যালবাম বের করতেই হবে। আমার না ছিল গুরু না গাইড। তার ওপর সময়াভাব। প্রথম অ্যালবামের সাংঘাতিক সাফল্যের পর, পরের দুটো অ্যালবামের উত্তোরত্তর ব্যবসা কমতে লাগল কোম্পানির। প্রথম অ্যালবামের ভাবনা এবং প্রস্তুতি শুরু আমার চুরাশিতে। দশ বছরে খান চল্লিশেক গান থেকে বাছাই করে ন’টা গানের অ্যালবাম করেছিলাম। যেগুলো বাতিল করেছিলাম, সেগুলোর একটা দুটো গান কাজের মনে হল, বাকি সব চলে গেল না-মনে থাকার লিস্টে। কিন্তু অ্যালবাম বের করতেই হবে। জোর করে কিছু সম্ভাবনা থাকা গানকে তাড়াতাড়ি রেকর্ড করতে গিয়ে আমার প্রোডাকশনের মান গেল পড়ে। তার ফল বোঝা গেল গানের বিক্রিবাট্টায়।
তিন বছরে তিনটে অ্যালবাম বেরনোর চুক্তি ছিল– ‘ভূমিকা’ ‘আমরাও বেঁচে আছি’, ‘ঠিক এখনই’। উত্তরোত্তর কমতে লাগল আমার গ্রাফ, শেষ অ্যালবামটা তো কোম্পানি ঘোষণাই করে দিল ‘ফ্লপ’ বলে। ওদের আগ্রহ কমে গেল, কমে গেল ওদের সঙ্গে ফোন কলের সংখ্যাও। তারপর একদিন বন্ধই হয়ে গেল যোগাযোগ। তখন কোম্পানির ফোকাস রিমেক গানে। সাতানব্বই, আটানব্বই, নিরানব্বই– এই তিনটে বছর কাগজ-পত্রিকাও বেশ খুশি হল, তাদের ভবিষ্যৎবাণী তো মিলেই গেল। শিলাজিৎ বেনো জল– তা প্রমাণ তো হয়েই গেল। আমিও প্রস্তুত ছিলাম। আমার প্রথম অ্যালবামের প্রথম গান ছিল ‘ভূমিকা’ আর তৃতীয় অ্যালবাম ‘ঠিক এখনই’-র শেষ গানের নাম দিয়েছিলাম ‘উপসংহার’। সে গানের শেষ লাইনগুলো ছিল–
‘সস্তা এ গান হালকা ভীষণ থাকবে না চিরকাল
এ গানে নেই ডিলান কিম্বা কালীদাসের কঙ্কাল
কে থাকে কে না থাকে বেঁচে থাকুক অন্য গান
আর এ গান থাকছে না, দেখতে আপনি তো থাকছেন?’
জিরো টু জিরো পৌঁছে গেছিলাম, কিন্তু অনেকের মতোই আমারও খেয়াল ছিল না ‘গোকুল’ বলে একটা শব্দ আছে আমাদের অভিধানে, সেখানে বাড়তে থাকে কিছু।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। ১৯১০-এ লক্ষ্মীনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঁহী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির নিজত্বকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছিলেন।