১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবর। এক ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হল ভারত! ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। বাড়ির টেলিফোনে নির্দেশ এল, তাড়াতাড়ি অফিস পৌঁছে যেতে হবে। বিবিসি রেডিও খবর দিলেও রাষ্ট্র তখনও ঘোষণা করেনি। গেলাম অফিস একেবারে হালকা রঙের শাড়ি পরে। গোলযোগের আশঙ্কায় বাইরের বড় গেটে তালা পড়ল। চারিদিকে থমথমে ভাব। নির্ধারিত সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। স্টুডিওতে ঢোকার মুখে নিউজ রুমের দিকে তাকিয়ে দেখি শেষ মুহূর্তের তৎপরতা চলছে, একটু পরেই যে শোকের সংবাদ দিতে হবে পশ্চিমবঙ্গবাসীকে, তারই প্রস্তুতি।
১১.
১৯৮৩-র ৬ জুন কলকাতা দূরদর্শন রঙিন হল। সে এক উৎসব! কলকাতার শিশির মঞ্চ থেকে লাইভ টেলিকাস্ট হবে, আমার আর শাশ্বতীর দু’জনেরই ডিউটি সেখানে। আগের দিন শাশ্বতী ওর বাড়ি নিয়ে গেল, ওয়ারড্রোব থেকে বের করল দু’-তিনটে কাঞ্জিভরম শাড়ি। ‘নে, কোনটা পরবি দ্যাখ’, আমি ভালোমানুষের মতো বলি, ‘তুমি আগে কোনটা পরবে বলো তারপরে আমি নিচ্ছি’, ‘তুই আগে বেছে নে’, আহ্লাদী নির্দেশ যেন ! বাছলাম, হলুদ রঙের কাঞ্জিভরম তাতে মেজেন্টা পাড়। শাশ্বতী বোধহয় সবুজ কাঞ্জিভরম পরেছিল। পরদিন মঞ্চে দু’জন দু’পাশে দাঁড়িয়ে, শুরু করলাম প্রথম কালার ট্রান্সমিশন। অভিজিৎদা-র (দাশগুপ্ত) নেতৃত্বে তাঁর পুরো টিম কাজটি সম্পন্ন করল।
শিশির মঞ্চ থেকে অফিসে ফিরে দেখি, আমাদের কনফারেন্স হল একেবারে ভর্তি, সেখানে টিভি সেট লাগানো হয়েছে, ছোট-বড় অনেক মানুষ একসঙ্গে বসে সেখানে দেখছেন রঙিন সম্প্রচার। এখনকার দিনের মানুষকে আমাদের তখনকার উত্তেজনা বোঝানো সম্ভব নয় জানি, তবু লিখতে ইচ্ছে করলো সাদা কালো থেকে রঙিন হয়ে ওঠার সেই মুহূর্তগুলির কথা।
১৯৮৪-তে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ঘটনাটা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে, তাও কথাবার্তা যেহেতু হয়েছিল দূরদর্শনের মেকআপ রুমে, তাই উল্লেখ করাই যায়। শাশ্বতী গিয়েছিল সম্ভবত: শিলং বেড়াতে, ফিরে এসে টের পায় যে ও কনসিভ করেছে, সেই কথাটা আমাদের ওই একফালি মেক আপ রুমে চুপি চুপি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি অবাক হয়ে বলি, ‘সে কী, আমিও তো!’ আমি গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গ বেড়াতে, ফিরে এসে…। সে বছরের হাইট অফ কোইনসিডেন্স এটাই। সেই জুলাই মাসে মাত্র ৮ দিনের তফাতে দু’জনেরই পুত্রসন্তান হল, দু’জনেরই দ্বিতীয় সন্তান।
১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবর। এক ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী হল ভারত! ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হলেন। বাড়ির টেলিফোনে নির্দেশ এল, তাড়াতাড়ি অফিস পৌঁছে যেতে হবে। বিবিসি রেডিও খবর দিলেও রাষ্ট্র তখনও ঘোষণা করেনি। গেলাম অফিস একেবারে হালকা রঙের শাড়ি পরে। গোলযোগের আশঙ্কায় বাইরের বড় গেটে তালা পড়ল। চারিদিকে থমথমে ভাব। নির্ধারিত সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। স্টুডিওতে ঢোকার মুখে নিউজ রুমের দিকে তাকিয়ে দেখি শেষ মুহূর্তের তৎপরতা চলছে, একটু পরেই যে শোকের সংবাদ দিতে হবে পশ্চিমবঙ্গবাসীকে, তারই প্রস্তুতি। যথাসম্ভব নো মেকআপ লুক নিয়ে ফ্লোরে গিয়ে বসলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গায়। তরুণ চক্রবর্তী ঢুকল। অন্যান্য দিন কুশল বিনিময় হয়, আজ কেবল স্তব্ধতা। শুরু করলাম অধিবেশন, চিরাচরিত হাসিটি আজ মুখে নেই। তারপরেই তরুণের মুখে উচ্চারিত হল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার সংবাদ। ঘোষিত হল রাষ্ট্রীয় শোক।
এ বছরের শেষেই দর্শকের দরবারের ফরম্যাট বদলাল, পঙ্কজদা অনেক দিনের জন্য বিবিসিতে চলে যাওয়ার কারণে। পঙ্কজদা একাই দর্শকের দরবারের মুখ ছিলেন। এবার থেকে আমি আর শাশ্বতী প্রতি সপ্তাহে পালা করে দর্শকদের কাছ থেকে আসা চিঠি পড়তাম। উত্তর দিতেন বিভাসদা, বিভাস চক্রবর্তী। ১৯৮৭-তে বিভাসদা চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার আগে পর্যন্ত সেরকম ভাবেই চলেছিল। আমাদের রাশি রাশি চিঠির মধ্য থেকে নিজেদের চিঠি বাছাই করতে হত, সেসব চিঠির অনেকগুলিতেই জিজ্ঞাস্য থাকতো, ‘শাশ্বতী চৈতালি কি দুই বোন?’ বিভাসদা বলেছিলেন, ‘এই চিঠির উত্তর দেব না। এই কৌতূহল জারি থাকুক!’ অনেক কাল পরে, ইটিভির অনুষ্ঠান ‘এবং ঋতুপর্ণ’তে ভুল ধারণাটি ভাঙতে চেষ্টা করেছিল ঋতুপর্ণ। যদিও কিছু মানুষের মনে এই ধারণা চলছে চলবে।
আমাদের আরেকটি বিখ্যাত অনুষ্ঠান ‘নববর্ষের বৈঠক’। এই বৈঠকি ফরম্যাট পঙ্কজদা শুরু করেছিলেন প্রায় প্রথম থেকেই, কিন্তু সেটা হত সান্ধ্য অধিবেশনে। নববর্ষের বৈঠকের জন্য এবার শুরু হল বিশেষ প্রভাতী অধিবেশন ১৯৮৫-র ১ বৈশাখ। সেই সকালে আমাদের রাধা স্টুডিওর ফ্লোর গুণীজনে যেমন ভরে উঠেছে, তেমনই ফুলের সুঘ্রাণে। পবিত্র সরকার, অমিতাভ চৌধুরী, বুদ্ধদেব গুহ থেকে শুরু করে আরও কত নামী-দামী ব্যক্তিত্ব ! অভিজিৎদার প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি হবে, বেশ সাজো সাজো রব। আমাকে অধিবেশনের সূচনা করতে হবে এবং বৈঠকের মুখবন্ধ করতে হবে। সাদা লাল পাড় শাড়ি পরে, মুক্তোর গয়নায় সেজে আমি ফ্লোরে এসে দাঁড়ালাম। কী এক আনন্দের স্রোত আমার মনে !
সেই ভোরে শুরু করলাম অধিবেশন, ‘এই-যে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষটি আজ আকাশপ্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালো, কোথাও দরজাটি খোলবারও কোনো শব্দ পাওয়া গেল না, আকাশ-ভরা অন্ধকার একেবারে নিঃশব্দে অপসারিত হয়ে গেল, কুঁড়ি যেমন করে ফোটে আলোক তেমনি করে বিকশিত হয়ে উঠল–’ এমন করেই কথামুখ সাজালাম। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে আসার পর শিপ্রাদি ( অ্যাসিসট্যান্ট স্টেশন ডিরেক্টর শিপ্রা রায়) জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি উপনিষদ থেকে বলেছিলাম কি না, উত্তর দিয়েছিলাম ‘আমার কাছে উপনিষদই বটে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালা থেকে।’
আমাদের স্টুডিওতে ঢোকার মুখে বাঁদিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ, সেটি সংবাদ বিভাগ। প্রতীপ রায় দিল্লি দূরদর্শন থেকে এসে যোগ দিয়েছিল শুরুর সময়ই, সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, ভবেশ দাস, শিশির ভট্টাচার্যরা যেমন ছিলেন তেমন ছিল সুকুমার, উদয়ন, স্নেহাশিসরা। ছিলেন দেবাংশু ব্যানার্জী, দেবাংশুদা পরে ভয়েস অফ আমেরিকায় চলে যান।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………
সংবাদ বিভাগের উল্টো দিকেই ডিউটি রুম, ট্রান্সমিশন ডিউটিতে অনেকটা সময় এখানে কাটত আমাদের। অতীনদা, বিমলদা ছিলেন ডিউটি অফিসার, ছিল প্রণবেশ ঘোষ। প্রণবেশের মতো পরোপকারী মানুষ খুব কমই হয়।
এবার যেতে হবে নতুন বাড়িতে, তার আগে একটু পিছন ফিরে তাকাই। ১৯৮২ সালের ১৫ অগাস্ট রাত সাড়ে আটটা থেকে শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, আর তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ইংরেজি সংবাদ সম্প্রচারে। দর্শক বঞ্চিত হলেন খবর শেষে লীনা সেনের সেই মিষ্টি হাসি থেকে।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved