চাকরি থাকুক চাকরির জায়গায়। কিন্তু এই পরিবারে সত্যেন্দ্রকেও হতে হবে দেবেন্দ্রনাথের সমস্ত আজ্ঞা ও নিষেধের দাস। কোনও প্রতিবাদের কণ্ঠ তিনি সহ্য করতে পারেন না। সারদা দেবেন্দ্রর মনের ভাব বোঝেন। সুতরাং তিনিও ছেলের এই সাফল্যে তেমন মন খুলে সাড়া দিতে পারছেন না। তৈরি করেছেন ঠান্ডা দূরত্ব, মনের কান্না চেপে রেখে। তিনি যেন আভাস পেয়েছেন, সত্যেন্দ্রর এই আইসিএস হয়ে বাড়ি ফেরা সুখের হবে না সংসারের পক্ষে। অশান্তি দেখা দেবেই।
১১.
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে সাজ সাজ রব। যেন উৎসবের বাড়ি। এবং সেই উৎসবের নায়ক সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিলেত থেকে আইসিএস হয়ে বাড়ি ফিরছেন। শুধু তো আইসিএস হয়ে বাড়ি ফেরা নয়। তিনিই প্রথম ভারতীয় আইসিএস! এ-পর্যন্ত ভারতের সমস্ত সিভিল সার্ভেন্টই রাঙা বর্ণের ব্রিটিশ, যেমন তাঁদের চাকরির ক্ষমতা ও দাপট, তেমনই তাঁদের বিদেশি আভিজাত্য। সুতরাং, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিলেত থেকে আইসিএস হয়ে জোড়াসাঁকোতে ফেরাটা ঐতিহাসিক ঘটনা তো বটেই! তাছাড়া বরাবর ছাত্র হিসেবে ব্রিলিয়ান্ট সত্যেন্দ্র আইসিএস পরীক্ষায় ষষ্ঠ হয়েছেন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সব ব্রিটিশ পরীক্ষার্থীর মধ্যে এমন রেজাল্ট করা তো চাট্টিখানি কথা নয়! এই ব্যাপারে সত্যেন্দ্রনাথ একটি বর্ণময় ও অমূল্য স্বীকারোক্তি রেখে গেছেন।
পড়ুন আগের পর্ব: অসুস্থ হলেই এই ঠাকুরবাড়িতে নিজেকে একা লাগে জ্ঞানদানন্দিনীর
১৮৫১ সালে ন’বছর বয়সে সত্যেন্দ্রনাথের উপনয়ন হল। এরপর বাবামশায় দেবেন্দ্রনাথের আদেশে শুরু হল তার সংস্কৃতচর্চা। ন’বছরের সত্যেন্দ্র সংস্কৃত ব্যাকরণে ডুব দিল বাণেশ্বর বিদ্যালংকারের প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের সাহচর্যে। দেবেন্দ্রনাথ নিজের খরচে চারজন বাঙালি পণ্ডিতকে কাশীতে পাঠিয়েছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণ চর্চার জন্য। বাণেশ্বর বিদ্যালংকার এই চার সংস্কৃত পণ্ডিতের অন্যতম। এবার আসা যাক সত্যেন্দ্রর স্বীকারোক্তিতে: বাণেশ্বর বিদ্যালংকারের শিক্ষাগুণে যে সংস্কৃতশাস্ত্রে আমার বিশেষ ব্যুৎপত্তি জন্মেছিল তা বলতে পারি না। তবে বিদ্যালংকার মহাশয়ের নিকট সংস্কৃত সাহিত্যে আমার যা কিছু জ্ঞানলাভ হয়, ‘সিবিল সার্বিস’ পরীক্ষায় সেই বিদ্যাটুকু আমার বিলক্ষণ কাজে এসেছিল। আমার সময়ে সংস্কৃত ও আরব্য ভাষায় ৫০০ মার্ক পূর্ণমাত্রা নির্ধারিত ছিল। এই ৫০০ মার্কের মধ্যে আমি সংস্কৃতে ৩৫০-এরও উপরে পেয়েছিলুম।’ এরপর সত্যেন্দ্রর অনন্য হিউমার: ‘আমার পরীক্ষক ছিলেন ভট্ট মোক্ষমূলর।’ জানি না, একালের ক’জন পাঠক বুঝবেন, সত্যেন্দ্রর ‘ভট্ট মোক্ষমূলর’টি হলেন সংস্কৃত সাহিত্য ও ভাষায় প্রবল প্রজ্ঞাবান, ভারত-বিশারদ, ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক এবং ব্রিটেনবাসী জার্মান অধ্যাপক ফ্রিডরিখ ম্যাক্স মুলার! তাঁর কাছে সংস্কৃতে ৫০০-র মধ্যে ৩৫০-র বেশি পাওয়া বাড়িতে চিঠি লিখে জানানোর মতো ঘটনা তো অবশ্যই! এখানে অন্য একটি সংখ্যারও হিসেবে যাওয়া যেতে পারে। না-গেলে কেউ আবার আমার ভ্রান্তিবিলাসে চিমটি কাটতে পারে। বারবার বলছি বটে, সত্যেন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান এবং সেই সুবাদে জ্ঞানদানন্দিনী মেজবউঠাকরুণ, আসলে কিন্তু সত্যেন্দ্র সারদা ও দেবেন্দ্রর তৃতীয় সন্তান। যাঁকে আমরা দেবেন্দ্র-সারদার প্রথম সন্তান রূপে চিহ্নিত করেছি, সেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরই এই দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান! কারণ দ্বিজেন্দ্রর জন্মের আগেই তাঁর একটি দিদির জন্ম দিয়েছেন দেবেন্দ্র ও সারদাসুন্দরী। তবে সেই কন্যার আয়ু এতই ক্ষুদ্র এক বিন্দু, তাকে কেউ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি, খাতা না খুলেই সে বিদেয় নিয়েছে ঠাকুরবাড়ির বিপুল মজলিশ থেকে। কিন্তু তাকে নামহীন হিসেবে ধরলে, মহর্ষি দেবেন্দ্র ষোলোটি সন্তানের বাবামশায়! বোঝা যায়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবারে কেন এই পুরুষটির এমন দাপট এবং শাসন। তবে ক্রমশ ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি এই উপন্যাসের নায়িকা, দেবেন্দ্রর মেজবউমা, জ্ঞানদানন্দিনী!
এখন কিন্তু আমরা ফিরে যাচ্ছি সত্যেন্দ্রর আইসিএস হয়ে বাড়ি ফেরার খবরে যে সাজ সাজ রব উঠেছে, যে উৎসবের ভাবটি জাগ্রত হয়েছে, তার মধ্যে। সেই আনন্দে দেবেন্দ্র কিন্তু গরহাজির। তিনি হিমালয়ের পাদদেশে কোথাও নির্জন ব্রহ্মচর্চায় রত। তিনি যে এই উৎসবের কেউ নন, এই পার্থিব আনন্দে তিনি জড়াতেই চান না, এই দূরত্ব তিনি বজায় রেখেছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, সত্যেন্দ্র চাকরির দৌলতে যে ক্ষমতার আসনে বসতে চলেছে, তা যেন এই পরিবারে কোনওরকম চড়া সুরে কথা বলার অধিকার সত্যেন্দ্রকে না দেয়। সত্যেন্দ্রকেও তাঁর অন্যান্য সন্তানের মতোই তাঁর হুকুম মেনে চলতে হবে। চাকরি থাকুক চাকরির জায়গায়। কিন্তু এই পরিবারে সত্যেন্দ্রকেও হতে হবে তাঁর সমস্ত আজ্ঞা ও নিষেধের দাস। কোনও প্রতিবাদের কণ্ঠ তিনি সহ্য করতে পারেন না। সারদা দেবেন্দ্রর মনের ভাব বোঝেন। সুতরাং তিনিও ছেলের এই সাফল্যে তেমন মন খুলে সাড়া দিতে পারছেন না। তৈরি করেছেন ঠান্ডা দূরত্ব, মনের কান্না চেপে রেখে। তিনি যেন আভাস পেয়েছেন, সত্যেন্দ্রর এই আইসিএস হয়ে বাড়ি ফেরা সুখের হবে না সংসারের পক্ষে। অশান্তি দেখা দেবেই। সত্যেন্দ্রর স্বভাবের মধ্যে অবাধ্য হওয়ার বেপরোয়া ভাবটা মা সারদার অজানা নয়। তারপর সাহেবদের দেশে গিয়ে সাহেবদের চাকরি নিয়ে ফিরেছে– এই ছেলে কি বাপের শাসন মাথা নীচু করে মেনে নেবে? সারদার মনে ভয়। সেই ভয় যে এত তাড়াতাড়ি সত্যি হয়ে উঠবে, সারদাসুন্দরী ভাবতে পারেননি।
দুই বন্ধু একসঙ্গে ইংল্যান্ড যাত্রা করেছিলেন। সত্যেন্দ্র বিলেত গেলেন আইসিএস হতে। প্রথম ভারতীয় আইসিএস। আর মনোমোহন ঘোষ ব্যারিস্টারি পড়তে। তবে মনোমোহন প্রথম ভেবেছিলেন আইসিএস-ই হবেন। কিন্তু প্রথম পরীক্ষাতেই নিরাশ হয়ে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরলেন বন্ধু সত্যেন্দ্রর সঙ্গেই।
মনোমোহন একদিন বললেন, সত্যেন, তোর বউয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিবি না?
সত্যেন্দ্র কী করে বন্ধুকে বলবেন, মনোমোহন, তুই বাইরের পুরুষ। বাড়ির ভিতরে তোকে নিয়ে গিয়ে বউয়ের সঙ্গে কী করে আলাপ করাই বল তো? সত্যেন্দ্র বাবামশায়ের শাসনের কথা মনোমোহনকে বলতে না পেরে বললেন, ‘একটু ধৈর্য ধর, আলাপ করিয়ে দেব।’ মনোমোহন ধৈর্য ধরার পাত্র নয়। বললেন, ‘তুই মন থেকে চাস আমার সঙ্গে তোর সুন্দরী বউয়ের আলাপ হোক?’
–চাই না মানে? নিশ্চয়ই চাই! এবং আজ রাত্তিরেই। আমরা একসঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ঢুকব। রাজি?
মনোমোহন বেশ অবাক। ঢোক গিলে বললেন, ‘রাজি।’ সেই সময়ে স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। তা সত্ত্বেও বন্ধুকে কথা দিলেন সত্যেন্দ্র, ‘আজ রাত্তিরেই তোর সঙ্গে জ্ঞানদার আলাপ হবে!’
বেশ রাত করেই বন্ধু মনোমোহনকে সঙ্গে করে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ঢুকলেন সত্যেন্দ্র। তারপর মনোমোহনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘শোন, আমার পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে পা ফেলবি। যেন মনে হয়, দু’জন নয়, একজন হাঁটছে। সবাই ভাববে আমি বাড়ি ফিরছি, একা। এইভাবে অন্দরমহলে ঢুকে সোজা আমি আমার ঘরে ঢুকে যাব। কেমন আইডিয়া বল মনো?’
–সে কী রে? ধরা পড়লে তো প্রাণ যাবে!
–তা যাক গে যাক। আমার বউ যা সুন্দরী, তোর মনে হবে মনো, মরণ সার্থক হল।
মনোমোহন এই অ্যাডভেঞ্চারে বেশ আনন্দ পেলেন। পা মিলিয়ে হাঁটতে লাগলেন সত্যেন্দ্রর সঙ্গে। এবং হাতে প্রাণ নিয়ে পৌঁছে গেলেন সত্যেন্দ্রর ঘরের দরজায়। দরজা ভেজানো। ঠেলতেই খুলে গেল। সত্যেন্দ্র উঁকি মেরে দেখলেন, জ্ঞানদা মশারির মধ্যে তাঁর জন্যই অপেক্ষা করছে। বললেন, ‘মনো, আমি যাব না। তুই যা। সোজা ঢুকে যা মশারির মধ্যে। গিয়ে বল, আমি সত্যেনের ব্যারিস্টার বন্ধু মনোমোহন। আলাপ করতে এলাম।’
–অসম্ভব! এ হয় না কি? তুইও চল আমার সঙ্গে।
–আমি গেলে মজাটাই নষ্ট হবে।
–তোর বউ কী ভাববে বলতে?
–তোর কথা আমার মুখে সারাক্ষণ শুনছে। জ্ঞানুও তোর সঙ্গে আলাপ করতে আগ্রহী– অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।
–বি প্র্যাকটিকাল সত্যেন, বাড়াবাড়ি করিসনি।
–বউয়ের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করব না তো কার সঙ্গে করব? সোজা গিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে পড় মনো। আমাকেও তো বুঝতে হবে জ্ঞানু আমার বউ হওয়ার যোগ্য কি না?
–আমার কিন্তু ভীষণ নার্ভাস লাগছে সত্যেন।
–মশারির মধ্যে একবার ঢুকে যা। কিন্তু-কিন্তু না করে আলাপটা জমিয়ে ফেল। আমি ততক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু হাওয়া খাই।
মনোমোহন যেন নিজের ঘরে ঢুকছে, সেইভাবে পা ফেলে সত্যেনের শোবার ঘরে।
তথ্যসূত্র: পুরাতনী। জ্ঞানদানন্দিনী