Robbar

একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 8, 2024 8:29 pm
  • Updated:January 8, 2024 8:29 pm  

লক্ষ্মী ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী তখন। কোনওভাবে জানতে পেরেছিলেন, চরম অর্থকষ্টে ভুগছেন ময়দানের মালিরা। খাওয়া জুটছে না। চাল-ডালের বন্দোবস্ত করতে হত। আরও কয়েকজনকে বলতে পারতেন। যৌথভাবে কিছু করতে পারতেন। একা সব করতে গেলেন কেন? পরিবার আছে আপনার। সন্তান আছে। স্মিত হাসিতে উত্তর এসেছিল, ‘স্মিতা (লক্ষ্মীর স্ত্রী, বড় সরকারি চাকরি করেন) আছে তো! কিন্তু,আমি ছাড়া মালিদের দেখবে কে?’

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

‘বুঝলে রাজু, সবার আগে দরকার, টান। টিমের প্রতি টান, বাংলার প্রতি টান। বলছি তো, আমার কোনও ভিনদেশি তারার দরকার নেই। ওরা তো খেলতে আসবে কেউ টাকার জন্য। কেউ ইন্ডিয়া খেলার জন্য। কেউ বাংলার জন্য খেলবে না। আমার চ্যাটার্জি, ব্যানার্জিই ঠিক আছে!’

এই দিন কয়েক আগে কথা হচ্ছিল। মিত্র-স্থানীয় এক ক্রিকেট সাংবাদিকের পিতার প্রয়াণের খবর পেয়ে, বাংলার প্র্যাকটিস শেষে ছুটে এসেছিলেন লক্ষ্মীরতন শুক্লা। বেঙ্গল কোচ। সন্তপ্তের খোঁজখবর, আন্তরিক সহমর্মিতা শেষে আলোচনাটা বাংলা ক্রিকেটের দিকে ঘুরে গিয়েছিল। তখনও রনজি ট্রফি শুরু হয়নি। শীতের দুপুরের শিরশিরানি, এক বিঘত বাড়িয়ে ঝাঁকে-ঝাঁকে প্রশ্নাবলি মনকে বিব্রত করছিল বরং।

Bengal coach Laxmi Ratan Shukla gestures after the win against Jharkhand | ESPNcricinfo.com
লক্ষ্মীরতন শুক্লা

অভিমন্যু ঈশ্বরণ দক্ষিণ আফ্রিকায়। পাওয়া যাবে না। মুকেশ কুমার, ভারতীয় দলে। নেই তিনিও। শাহবাজ আহমেদের চোট। তিনি কবে পারবেন, ঈশ্বর জানেন। বাংলা করবে কী? খেলবে কাদের নিয়ে?

‘কেন বাকিদের হাত-পা নেই? হাতে ব্যাট-বল নেই? গায়ে বাংলার জার্সি নেই?’ গরগরে গলায় ক্ষুণ্ণ উত্তর আসে।

বাংলা!

তিন অক্ষরের এক নাম। পূর্ব ভারতের এক রাজ্য। অথচ কী এক-পৃথিবী মায়া তার, কী দুর্নিবার তার টান-আকর্ষণ-ভালোবাসা। অধুনা বাংলা কোচের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, সখ্যতা, আজকের নয়। এক যুগের অধিক কেটে গেল। সময়-অসময়ে জিজ্ঞেসও করেছি প্রশ্নটা। ফাঁক পেলে। তিনটে আন্তর্জাতিক ম্যাচের বেশি খেলা তো হল না আপনার। সর্বগুণসম্পন্ন হয়েও দেশের জার্সিতে ক্রিকেট-আয়ু আপনার বাড়ল না। কারণ, ১৭ বছর বয়সে জাতীয় দলে ঢুকেছিলেন যখন, অধিনায়ক আজহারউদ্দিনের ভারত-সংজ্ঞায় বাংলা পড়ত না! অর্থকড়িও যে দারুণ করেছেন, খবর নেই। ঋষির একাগ্রতায়, প্রায় দু’দশক বাংলা ক্রিকেটের সেবা-শুশ্রূষা করেও বিদায়বেলায় অবহেলা জুটল। এত বাংলা, বাংলা করে তাহলে লাভ কী হল? পেলেন কী জীবনে?

Bengal stalwart Laxmi Ratan Shukla retires from Cricket - Odisha News Insight
‘লাভ? লাভ দেখলে, টাকা দেখলে তো আইসিএল চলে যেতাম কবে। কত ক্রিকেটার তো গিয়েছিল। বেঙ্গল থেকেও গিয়েছিল। আসলে কী জানো, বাংলার সঙ্গে লাভ-লোকসান চলে না। ভাবিই না। আমার মনে হয়, বাংলা আমাকে না দেখলে, আমি লক্ষ্মীরতন শুক্লা হতে পারতাম না। তাই আমার উচিত, সীমিত সাধ্য দিয়ে বাংলাকে দেখা। দরকারে, প্রাণ দিয়ে!’

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

তিনটে আন্তর্জাতিক ম্যাচের বেশি খেলা তো হল না আপনার। সর্বগুণসম্পন্ন হয়েও দেশের জার্সিতে ক্রিকেট-আয়ু আপনার বাড়ল না। কারণ, ১৭ বছর বয়সে জাতীয় দলে ঢুকেছিলেন যখন, অধিনায়ক আজহারউদ্দিনের ভারত-সংজ্ঞায় বাংলা পড়ত না! অর্থকড়িও যে দারুণ করেছেন, খবর নেই। ঋষির একাগ্রতায়, প্রায় দু’দশক বাংলা ক্রিকেটের সেবা-শুশ্রূষা করেও বিদায়বেলায় অবহেলা জুটল। এত বাংলা, বাংলা করে তা হলে লাভ কী হল? পেলেন কী জীবনে?

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………

ক্ষুদ্র মগজে, সীমিত বোধে এ সমস্ত বিশেষ বোধগম্য হয় না। তবে দুটো চোখ দেখে সব, দেখে বিস্ময়ে। দেখে, মধ্য চল্লিশের একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বাংলার, বাংলা ক্রিকেটের। দিনভর। রাতভোর।

Laxmi Shukla ODI photos and editorial news pictures from ESPNcricinfo Images

 

কাকভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। সাতটার মধ্যে মাঠ। টিমের প্লেয়ারদের নিত্য শ’পাঁচেক করে বল ছোড়েন। নেট বোলারের জোগাড়-যন্ত্র করেন। কাজ তো আর একটা নয়। ‘আপস শব্দটা আজও বুঝিনি যে। আমার বাংলায় কোনও আপস চলেও না,’ লক্ষ্মী বলেছিলেন একবার। হাওড়ায়, ক্রিকেট অ্যাকাডেমি চালান। এলআরএস ‘বাংলা’ অ্যাকাডেমি। বিনা অর্থে যে অ্যাকাডেমি চলে। অর্থ নিয়ে বললে রেগে যান। বলেন, ‘আমি বাংলার ক্রিকেটারদের থেকে টাকা নেব? তুমি আমায় এতদিনে এই চিনলে?’ মাঝে কোভিডের সময় টাকা তুলে-তুলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্মী ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী তখন। কোনওভাবে জানতে পেরেছিলেন, চরম অর্থকষ্টে ভুগছেন ময়দানের মালিরা। খাওয়া জুটছে না। চাল-ডালের বন্দোবস্ত করতে হত। আরও কয়েকজনকে বলতে পারতেন। যৌথভাবে কিছু করতে পারতেন। একা সব করতে গেলেন কেন? পরিবার আছে আপনার। সন্তান আছে। স্মিত হাসিতে উত্তর এসেছিল, ‘স্মিতা (লক্ষ্মীর স্ত্রী, বড় সরকারি চাকরি করেন) আছে তো! কিন্তু, আমি ছাড়া মালিদের দেখবে কে?’

দিতে পারিনি উত্তর। সংকীর্ণমনা হৃদয় কখনও দিতে পারে তা? আর লক্ষ্মীর ‘উগ্র’ বঙ্গ-বাদে কাজ যে হচ্ছে না, তা তো নয়। এই যেমন রনজিতে অন্ধ্রপ্রদেশের বিরুদ্ধে নতুন এক প্রতিভার জন্মগ্রহণ হল, যাঁর পদবী, পাল। এই পথেই হবে একদিন, আসবে হয়তো লক্ষ্মীর অধরা মাধুরী, তাঁর আকাঙ্ক্ষার ‘বিশ্বকাপ’। রনজি ট্রফি বলে, যাকে চেনে লোকে। আর যদি না-ও আসে, যদি না হয় কখনও জেতা, আসবে-যাবে কতটুকু? বাংলাকে, বাংলার ক্রিকেটকে যে শব্দ ধার দিয়েছেন তিনি, তার মূল্য তো, একটা রনজি ট্রফি ঠিক করতে পারে না।

ইংরেজিতে যার নাম ‘প্রাইড’। জার্মানে ‘স্টোলজ’।
বাংলায় জাত্যভিমান কিংবা এলআরএস!

…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’

খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে