ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কে বিজ্ঞানের ইন্ধন জোগানোর যে কাজ সাই-ফাই করে, তা অনস্বীকার্য হলেও, প্রযুক্তি-বিজ্ঞানকে একপেশে ভাবে ‘টাকা রোজগার হবে, চাকরি পাব তাই পড়ি’ গোছের খোপে ফেলে দেওয়াও তো কম হয়নি। উল্টোদিকে সোশাল সায়েন্স বা হিউম্যানিটিজকে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে বিজ্ঞানের জাতপাতের শ্রেণিতে। যেখানে অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যাকে ‘ব্রাহ্মণ’ মানা হয়, আর উদাসীন থাকা হয় মনস্তত্ত্ব বা সমাজবিদ্যা সম্পর্কে।
১২.
সায়েন্স-ফিকশন যত না শেখায়, তার চেয়ে অনুপ্রেরিত করে। সায়েন্স-ফিকশনের মূল উপকারিতা হল এই অনুপ্রেরণারই জোগান দেওয়া। ভার্ন আর ওয়েলস-এর গল্প উপন্যাস পড়ে যে কত শত তরুণ-তরুণীর সামনে বিশ্বের বিস্ময় ভেসে উঠেছে এবং কত যুবক-যুবতী বিজ্ঞানকেই জীবিকা করে নিয়েছে, তার হিসেব কে রাখে? পৃথিবীর বহু খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক তাঁদের জীবনে স্বনামধন্য এই কাহিনিকারদের প্রভাব স্বীকার করেছেন। ঠিকমতো সমীক্ষা করলে দেখা যাবে, কাঁচা-বয়সিদের বৈজ্ঞানিক জীবিকা গ্রহণের মূলে বৃহত্তম ভূমিকা রয়েছে সায়েন্স-ফিকশনের। আর্থার সি ক্লার্ক একথাগুলো বলেছিলেন তাঁর এক পুরস্কার বক্তৃতায়।
ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্কে বিজ্ঞানের ইন্ধন জোগানোর যে কাজ সাই-ফাই করে, তা অনস্বীকার্য হলেও, প্রযুক্তি-বিজ্ঞানকে একপেশে ভাবে ‘টাকা রোজগার হবে, চাকরি পাব তাই পড়ি’ গোছের খোপে ফেলে দেওয়াও তো কম হয়নি। উল্টোদিকে সোশাল সায়েন্স বা হিউম্যানিটিজকে ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে বিজ্ঞানের জাতপাতের শ্রেণিতে। যেখানে অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যাকে ‘ব্রাহ্মণ’ মানা হয়, আর উদাসীন থাকা হয় মনস্তত্ত্ব বা সমাজবিদ্যা সম্পর্কে।
এই কাহিনিতে টুইস্ট তাই মেয়েদের কল্পবিজ্ঞান লেখায় ও পড়ায়। কারণ বহু যুগ ধরে মেয়েদের বিজ্ঞান ও অঙ্কের বাইরে রাখা হয়েছে, মেয়েরা অঙ্ক পারে না জাতীয় মিথ প্রচার করা হয়েছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছেলেদের জন্য উচ্চতর গণিত আর মেয়েদের জন্য হোমসায়েন্স– এই বিভেদ ১৯৬০-এর দশক অবধিও স্কুলে স্কুলে দিব্য চলত। এই স্টিরিওটাইপ ভেঙে অঙ্ককে মেয়েদের ‘কাছাকাছি’ নিয়ে যাওয়ার বা ডিমিস্টিফাই করার কাজ ক’জন অঙ্ক শিক্ষককে করতে দেখা গিয়েছে? কানমলা দিয়েই অনেকের অঙ্ক ক্লাসের দুর্বিষহ স্মৃতি শুরু। এইরকম পরিসরেও লীলা মজুমদার বা এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়রা কিন্তু লিখে উঠতে পারছিলেন তাঁদের মেধাবী লেখাগুলি। হৃদয়ের সংবেদনা দিয়ে উদ্ভট কল্পনাকে লীলা মজুমদার সহজেই বিশ্বাসযোগ্য কল্পবিজ্ঞান বানিয়ে তোলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গণিত বিষয় নিয়ে পাশ শুধু না, প্রথম স্থান নিয়ে ঈশান স্কলার শান্তিসুধা ঘোষ ১০০ বছরেরও আগে লিখেছিলেন, ‘গণিতশাস্ত্র অধিগত করবার মতো সূক্ষ্ম প্রতিভা তাদের আদৌ নেই, এই জাতীয় একটা অপবাদ নারীজাতি সম্পর্কে ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, সেটা আমার কোনোদিনই হজম করতে ইচ্ছে হয়নি। আজ আত্মপ্রত্যয় বশে আই এ পরীক্ষায় অঙ্কে ভালো করায় তার একটা হাতেকলমে পাল্টা প্রতিবাদ করার ইচ্ছে মনে জাগলো।’
এরপর তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশনের নতুন পাঠ্যতালিকায় জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ছেলেতে-মেয়েতে বিষয়ভিত্তিক পার্থক্য দেখেন, তাঁর মনে হয়, যে মেয়েদের বেলায় উচ্চশিক্ষা সংযোগের গূঢ় অর্থ কেবল এটাই হতে পারে, যে সমান শিক্ষা আর জ্ঞানলাভের অধিকারী হলে নারীর স্বাধীনতা খর্ব করার উপায় আর সমাজের হাতে থাকবে না।
ছেলেদের জন্য উচ্চতর গণিত আর মেয়েদের জন্য হোমসায়েন্স– এই বিভেদ ছয়ের দশক অবধিও স্কুলে স্কুলে দিব্য চলত। এই স্টিরিওটাইপ ভেঙে অঙ্ককে মেয়েদের ‘কাছাকাছি’ নিয়ে যাওয়ার বা ডিমিস্টিফাই করার কাজ ক’জন অঙ্ক শিক্ষককে করতে দেখা গিয়েছে? কানমলা দিয়েই অনেকের অঙ্ক ক্লাসের দুর্বিষহ স্মৃতি শুরু। এইরকম পরিসরেও লীলা মজুমদার বা এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়রা কিন্তু লিখে উঠতে পারছিলেন তাঁদের মেধাবী লেখাগুলি। হৃদয়ের সংবেদনা দিয়ে উদ্ভট কল্পনাকে লীলা মজুমদার সহজেই বিশ্বাসযোগ্য কল্পবিজ্ঞান বানিয়ে তোলেন।
‘তাজা বাতাসের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকলেও শুধু বড়ি খেতে খেতে যাওয়া। বড়িগুলোর একেক রকম স্বাদ, পেটও ভরে, কিন্তু ওকে কি কেউ খাওয়া বলে? দাঁতের ফাঁকে পর্যন্ত কিছু লেগে থাকে না। আর বাইরে কি অন্ধকার! তবে পর্দা টেনে টেলিভিশনে আশ্চর্য কি ছবি দেখাতে দেখাতে নিয়ে চললেন বড়কাকা। তাছাড়া বুধ-শুক্রের মতো দূরে তো আর নয়, দেখতে দেখতে পৌঁছেও গেল ওরা। নামল যখন ওরা তখন ঘুমিয়েছিল, এতটুকু ঝাঁকি দিল না, কিছু না। জেগে দেখে মনে হল বুঝি বিশাল একটা কিছুর ছাদে চেপে রয়েছে ওরা। আর রকেটের নিচে চোরা দরজা খুলে, সিড়ি দিয়ে সুটকেস হাতে বড়কাকা নেমে যাচ্ছেন। ওরাও নিজেদের বাক্স নিয়ে নেমে পড়ল। এই স্পেস-স্টেশনও নাকি বড়কাকাদের তৈরি।
ছাদের ওপর উকুনের মতো আটকে রইল রকেট, ওরা নেমে গেল।’
স্পেস স্টেশন তৈরিই হচ্ছে খাদ্য স্টেশন হিসেবে লীলা মজুমদারের ‘আকাশ-ঘাঁটি’ গল্পে। এখানে লক্ষ করব কল্পনার কী বিরাট ভূমিকা, এবং সরস আখ্যানের ভেতরে বাস্তবের স্পেস স্টেশনে একটা আবছা আদলকে পুরে দিলেও কোনও বিজ্ঞানের জটিলতা নেই।
এণাক্ষী সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কল্পবিজ্ঞানকে আগে গল্প হয়ে উঠতে হবে। ‘শুধু মেয়েদের মধ্যে কেন, ছেলেদের মধ্যেও যেসব লেখা হয়েছে তা বেশিরভাগই হল টেকনোলজিক্যাল কচকচি। তার বাইরে কিছু লেখা খুব ভালো। বাংলাতে আমি প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই ধরনের লেখাকে এগিয়ে রাখব। লেখার সাহিত্যমূল্য তখনই বাড়তে পারে যখন তুমি একটা আইডিয়া নিয়ে লিখছ যেখানে মানবিকতা একটা বড় ভূমিকা নেবে। বেশি টেকনিক্যাল হয়ে গেলে তার সাহিত্যমূল্য কমে যায়।’ এ যেন সেই কুটিকুটি করে সংখ্যা লেখা অঙ্ক বই-এর মতো। যা পাঠকপাঠিকা উভয়কেই খানিক দূরে ঠেলে দেয়।
এণাক্ষীর নিজের লেখা বাজপাখির ডানায়, শল্বসূত্র পড়া দাদু, নাতি শিবাজীকে ক্যালকুলেটর দিয়ে অঙ্ক না কষে নামতা শিখিয়ে দিচ্ছেন কবিতা পড়ার মতো করে। আবার আসিমভের একটি গল্প অনুবাদ করতে গিয়ে এণাক্ষী কত সহজে বাংলায় লিখলেন টেলিপোর্টেশন-নির্ভর ভবিষ্য-জীবনযাপনের এই অসামান্য গল্পটি।
‘জেলার ম্যাপটা খুললেন। দরজা প্রস্তুতকারক কোম্পানি ডোরস ইনকর্পোরেটেড এই ইম্যাপ সব গ্রাহককে বিনামূল্যে দিয়ে থাকে। এটা শুধু যাদের দরজার কোঅর্ডিনেট আছ, কেবল তাদের ডিরেক্টরি নয়– এতে প্রত্যেক বাড়ির অবস্থান দেখানো আছে। দেখতে দেখতে গর্বে মন ভরে গেল তাঁর। তাঁদের এই জেলা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। একমাত্র এখানে দরজাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সম্পূর্ণভাবে। এখানে কারখানার দরকার নেই, দোকান বাজারের দরকার নেই, রাস্তারও নয়। প্রত্যেকটি বাড়ি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দুর্গবিশেষ। প্রত্যেক বাড়ির দরজা দিয়ে পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় আনাগোনা করা যায়– তবে সেখানেও এই দরজা থাকতে হবে।’ (ঝলমলে সুন্দর দিন)
টেলিপোর্টেশন-এর থিওরিকে কাজে লাগিয়ে এক ভবিষ্য-পৃথিবীর কথা লেখেন আসিমভ। যে পৃথিবীতে সত্যিকারের দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় গেলে ধুলো কাদা-বৃষ্টি-ময়লা গায়ে লাগে। আর তাতেই ক্রমশ সুখ পায় এক শিশু। তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এণাক্ষী এমনভাবে তার বাংলা করেন, বোধ ও বুদ্ধির, হৃদয় ও মস্তিষ্কের সংবেদনায় কোথাও কোনও বাধা আসে না। একটা একান্ত মানবিক গল্পই হতে পারে সার্থক কল্পবিজ্ঞান।
(চলবে)
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই