সুকন্যা দত্ত বলেন, তিনি কল্পবিজ্ঞানকে বেছে নেননি, কল্পবিজ্ঞানই বেছে নিয়েছে তাঁকে। এবং, সদাসর্বদাই চূড়ান্ত দুর্ভাবনার মুহূর্তে কল্পবিজ্ঞান লেখা হয় তাঁর। কোনও না কোনও দুর্যোগ যেন গল্পগুলোর জন্ম দেয় মাথার মধ্যে। দুঃসময়ের ট্রিগারই তাঁর লেখার জন্য জরুরি, এমনটাই ভাবেন তিনি। তাঁর গল্প উপন্যাসের কেন্দ্রে থাকে বৈজ্ঞানিক সম্ভাব্যতা, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। তার সঙ্গে জুড়ে যায় আশার কথা, প্রকৃতিকে শ্রদ্ধার কথা। প্রকৃতিকে দুর্ব্যবহারের পর প্রকৃতির প্রতিশোধের কথা, আসে বারবার সমুদ্রের কথা।
১৩.
বাণী বসু অত্যন্ত কম সংখ্যক কল্পবিজ্ঞান গল্প লিখেছেন। কিন্তু তিনিও লীলা মজুমদারের মতো ইউটোপিয়া ফ্যান্টাসির আশ্রয় নেন। নারীর সমস্যা নিয়ে ২০০০ পরবর্তী ছোটগল্প ‘কাঁটাচুয়া’-তে বাণী বসু একটি স্মরণযোগ্য গল্প বলেছেন। রে ব্রাডবেরির সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘ওয়াট ইফ’ বা ‘যদি এমন হত’-র কল্পলোকে, ধর্ষিত হতে থাকা মেয়েদের মধ্যে একটি অভিযোজনের কাহিনি বুনেছেন তিনি। অভিযোজিত হয়ে প্রাকৃতিকভাবেই অনিচ্ছা সংগমে বা পুরুষের হাতে আক্রান্ত হলেই মেয়েদের শরীর থেকে সজারুর মতো কাঁটা বেরিয়ে আসছে। কল্পবিজ্ঞানের অন্য এক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, বিজ্ঞান কাজ করে পসিবিলিটি বা সম্ভাবনা নিয়ে। আর কল্পবিজ্ঞান করে প্লজিবিলিটি বা ‘হলেও হতে পারত’ নিয়ে। কাজেই ‘কাঁটাচুয়া’ গল্পের ভেতরে যাঁরা বৈজ্ঞানিক অসম্ভাব্যতা খুঁজে পেয়ে একে কল্পবিজ্ঞানের আওতা থেকে বের করে দিতে চান, তাঁদের বোঝা দরকার, সামাজিক চেতনা, ‘কী হতে পারত’-র কল্পনাপ্রবণ দরজা আর নিটোল গল্প বলা– এই সবকিছু মিলেই ‘কাঁটাচুয়া’ একটি সার্থক কল্পবিজ্ঞান। রহস্য গল্পের আদলে এই লেখা। ‘দ্বিতীয় পৃথিবী’ বাণী বসু-র লেখা আরেক ইউটোপিয়া কাহিনি।
আরেক অতি পরিচিত, অতি জনপ্রিয় লেখক সুচিত্রা ভট্টাচার্য। তাঁর লেখাতেও আছে বিজ্ঞানের ছোঁয়াচ লাগা, ফ্যান্টাসিপ্রবণ লেখা। মিতিন মাসি নামের এক গোয়েন্দার কাহিনিগুলির কয়েকটিতে তিনি এই কাজ করলেও, আলাদা করে হার্ডকোর কল্পবিজ্ঞান লেখেননি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিশিষ্ট আলোচকরা এ গল্পকে দেখেছেন এক রাজনীতির বাণী হিসেবে। ইকোক্রিটিসিজম তত্ত্বের ধারক হিসেবে। ইকোক্রিটিসিজম একটা বিস্তৃত দর্শন, যা সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রকে জুড়ে দেয় প্রকৃতির সচেতনতার সঙ্গে, ইকোলজি ও পরিবেশের সঙ্গে। এই পৃথিবীকে বা প্রকৃতিকে কেন্দ্রস্থলে রেখে নানা মাধ্যমের ভেতরে সংযোগ বা সঙ্গতি নিয়ে কাজ করে একটাই উদ্দেশে– যে যুক্তিবাদ মানুষকে পৃথিবীর কেন্দ্রে রেখে, সবকিছুকে মানুষের ছাঁচে ফেলে দেখায়, সেই ভ্রান্ত রাজনীতি (অ্যানথ্রোপোমরফিজম)-কে চুরমার করে দেওয়া।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এর পরবর্তী প্রজন্মের লেখক, নিজেই বিজ্ঞানী, বাঙালিনী সুকন্যা দত্ত ইংরেজিতে লেখেন হার্ডকোর বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প-উপন্যাস। সুকন্যা দত্তের জন্ম ১৯৬১ সালে। কলকাতায় প্রথমে ব্রেবোর্নে পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যচেলর ও মাস্টার্স করেছেন প্রাণীবিদ্যা নিয়ে। আশৈশব দেশের নানা অংশে, উত্তর পূর্বে বিশেষত, ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল বাবার চাকরিসূত্রে, ফলে নিজের দৃষ্টির প্রসার তাঁর সর্বভারতীয়। হয়তো ইংরেজি ভাষাকে নিজের লেখার মাধ্যম করা এরই ফলে ঘটেছে। সুকন্যার জীবনের প্রথম কাজটিই ছিল, জৈবপ্রযুক্তিকে জনমানসে পেশ করার জন্য নিবন্ধ লেখা। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে এই কাজ দিয়ে তাঁর লেখালেখিতে হাত পাকানো। দেশের নানা বড় সংবাদপত্রে জৈবপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রবন্ধনিবন্ধ লিখেতে থাকেন তিনি। ‘সায়েন্স রিপোর্টার’ পত্রিকার মতো কাগজে প্রকাশিত হত তাঁর লেখা। সিএসআইআর-এর বৈজ্ঞানিক পদে, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে এরপর কাজ করেছেন বহু বছর, বিজ্ঞানকে সহজ ভাষায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মূল দায়িত্ব নিয়ে। ডক্টর বাল ফোন্ডকে-র অধীনে কাজ করে সুকন্যা তৈরি করেছেন নিজেকে। বিরল সৌভাগ্য তাঁর এটি। প্রথম বই ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত জিনথেরাপি, এই ধরনের প্রবন্ধ সংগ্রহ। তখনও তিনি কল্পবিজ্ঞানের দরজায় এসে দাঁড়াননি।
এর পর যা ঘটে, সেটা প্রায় গল্পের মতো। পরিবারের এক মহাদুর্যোগ মুহূর্তে ২৪ ঘণ্টা তাঁকে কাটাতে হয় চূড়ান্ত অনিশ্চয়তায়, টেনশনে, আর সেইদিনই তাঁর মনের সমস্ত দুশ্চিন্তার ঘনঘটা থেকে হাতে এসে যায় একটি সাইফাই কাহিনি, চরিত্রদের নাম সমেত। লিখে ফেলেন তিনি। তার পরের কাহিনিরও প্রথম দিক অবধি যে স্বপ্নাদিষ্ট, থুড়ি, দুশ্চিন্তাদিষ্টের মতো লিখে ফেলেন একটানে।
সুকন্যা বলেন, তিনি কল্পবিজ্ঞানকে বেছে নেননি, কল্পবিজ্ঞানই বেছে নিয়েছে তাঁকে। এবং, সদাসর্বদাই চূড়ান্ত দুর্ভাবনার মুহূর্তে কল্পবিজ্ঞান লেখা হয় তাঁর। কোনও না কোনও দুর্যোগ যেন গল্পগুলোর জন্ম দেয় মাথার মধ্যে। দুঃসময়ের ট্রিগারই তাঁর লেখার জন্য জরুরি, এমনটাই ভাবেন তিনি।
তাঁর গল্প উপন্যাসের কেন্দ্রে থাকে বৈজ্ঞানিক সম্ভাব্যতা, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। তার সঙ্গে জুড়ে যায় আশার কথা, প্রকৃতিকে শ্রদ্ধার কথা। প্রকৃতিকে দুর্ব্যবহারের পর প্রকৃতির প্রতিশোধের কথা, আসে বারবার সমুদ্রের কথা। ‘Once Upon a Blue Moon’ ২০০৬ সালে, ‘Beyond the Blue’ ২০০৮ সালে, ‘Worlds Apart’ ২০১২ সালে লিখেছেন তিনি। ‘Other Skies’ ২০১৬ ও ‘Tomorrow Again’ ২০২৩-এ প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে কিছু গল্পের জন্য বহু আলোচিত সুকন্যা। ‘আজকের নীলকণ্ঠ’ নামের কাহিনি (modern neelkanths) একটি পরিবেশবাদী ডিসটোপিয়া (এনভায়রনমেন্টাল ডিস্টোপিয়া)। সূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক তথ্য ব্যবহার করে, কোথাও কোনও তথ্যবিচ্যুতি না ঘটিয়ে সুকন্যা হার্ড সাইফাই লিখেছেন। কাহিনির বিষয়টির কাল্পনিক উপদান কিন্তু গাছের ধর্মঘট, মানুষের বিরুদ্ধে।
বিশিষ্ট আলোচকরা এ গল্পকে দেখেছেন এক রাজনীতির বাণী হিসেবে। ইকোক্রিটিসিজম তত্ত্বের ধারক হিসেবে। ইকোক্রিটিসিজম একটা বিস্তৃত দর্শন, যা সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রকে জুড়ে দেয় প্রকৃতির সচেতনতার সঙ্গে, ইকোলজি ও পরিবেশের সঙ্গে। এই পৃথিবীকে বা প্রকৃতিকে কেন্দ্রস্থলে রেখে নানা মাধ্যমের ভেতরে সংযোগ বা সঙ্গতি নিয়ে কাজ করে একটাই উদ্দেশে– যে যুক্তিবাদ মানুষকে পৃথিবীর কেন্দ্রে রেখে, সবকিছুকে মানুষের ছাঁচে ফেলে দেখায়, সেই ভ্রান্ত রাজনীতি (অ্যানথ্রোপোমরফিজম)-কে চুরমার করে দেওয়া। সুকন্যার কাহিনি দেখায়, আধুনিক মানুষ কীভাবে নিজের বিশাল শিল্প-কর্পোরেশনগুলোর জয়ধ্বজা উড়িয়ে, গোটা পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট শুধু করেনি, সভ্যতার সর্বনাশ ডেকে এনেছে পরিবেশ ঔদাসীন্য দিয়ে। এই গ্রহের সঙ্গে তার যোগসূত্র নষ্ট করেছে। এই ধারণার বীজ এসেছে জেমস লাভলকের ‘গাইয়া হাইপোথিসিস’ থেকে।
‘গাছেরা রেগে গিয়েছে। আমার মুখের ওপর যেন দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে তারা। আর তারা আমার বন্ধু নয়। তীব্র তড়িৎ প্রবাহের মত তাদের রাগ আমাকে ছুঁচ্ছে’– এভাবেই লেখেন সুকন্যা বৃক্ষসমাজ কীভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষের থেকে, সে কথা।
‘যযাতীয় লালসায়…’ গল্পটিতে লেখেন, একজন বিখ্যাত নায়িকা পুড়ে গিয়ে বীভৎস ভাবে মারা গেছেন। গল্পের প্রথমেই পাঠক জেনে গিয়েছে সেই মৃত্যুর কারণ কে হতে পারে। গল্পের আসল উদ্দেশ্য হল বের করা ঠিক কীভাবে নায়িকা মারা গেছেন। সেই ‘কী’-এর র্যাবিট হোল এতই গভীর আর এতই প্যাঁচালো যে, গল্পটা শেষ করে মনে হচ্ছিল আমার জীবনে আরও বাংলা হার্ড সাইফাই দরকার।
যযাতি চেয়েছিলেন অনন্তযৌবন হতে। যে কোনও রুপোলি পর্দার নায়িকাও চাইবেন তাই-ই। আর সেখানেই গপ্পের চাবি। জৈবপ্রযুক্তিবিদ্যার পড়ুয়া সুকন্যার এই বিখ্যাত গল্পটি বাংলায় অনূদিত এবং ঠাইঁ পেয়েছে ‘কঙ্কাবতী কল্পবিজ্ঞান’ লেখেনি নামের সংকলনে।
(চলবে)
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই