প্রেসিডেন্সি, বারুইপুর, দমদম, মেদিনীপুর-সহ যে ক’টা জেলে মাওবাদীরা আছেন, খবর চাউর। আর সকালে নজর খবরের কাগজে, কুসুমডিহার খবর, কমরেড ব্রহ্মার খবর আছে নাকি। পুলিশ ব্রহ্মাকে ধরার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। কিন্তু বিষয় হল তাঁর কোনও ছবি বা তার সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই। এই সন্ধান বড়ই কঠিন।
১৪.
জেলে মাওবাদী বা নকশালপন্থীদের একটা আলাদা নিয়মকানুন আছে। অলিখিত শৃঙ্খলা। জেলের মধ্যে বিভিন্ন বিশেষ দিন পালন থেকে শুরু করে জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিক্ষোভ, তাঁরা একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেন। মূলত সেন্ট্রাল জেলগুলির সেল ওয়ার্ডে মাওবাদীরা থাকেন। কড়া নিরাপত্তায়। মাঝে মাঝে জেল ট্রান্সফার। তবে একাধিক কৌশলী পদ্ধতিতে সব জেলের মধ্যেই তাঁদের যোগাযোগ ব্যবস্থা কাজ করে। কোর্টের দিন অনেকের দেখাসাক্ষাৎ হয়। যাঁরা বাইরে আছেন, তাঁরা একটা কমিটি গড়ে রেখেছেন। প্রতি মাসে সব জেলে এই বন্দিদের জন্য টুথপেস্ট, সাবান, খাতাবই তাঁরা দিয়ে যান।
এই মাওবাদীদের মধ্যে আবার ভাগাভাগি আছে। যেমন কেউ শীর্ষস্থানীয় নেতা, সংগঠক; আবার কেউ এত বড় কিছু নয়, স্রেফ সঙ্গে থেকে ধরা পড়েছে। আবার অনেকে আছেন দীর্ঘ জঙ্গলজীবন ও কারাবাসের পর এখন ক্লান্ত, মূলস্রোতের সমাজে ফিরতে চান। উল্টোদিকে কেউ কেউ এখনও বিপ্লবের শপথে অটল। সবচেয়ে বড় ভাগাভাগি হল পথ নিয়ে। অনেকে জঙ্গলজীবন, হত্যার রাজনীতি, সশস্ত্র সংগ্রাম, শ্রেণিশত্রুর বিনাসে বিশ্বাসী। আরেকপক্ষ এখন সমাজের মধ্যে থেকেই জনসংযোগের তাগিদ অনুভব করছেন। এসব নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনাও হয়।
মাওবাদী বন্দিদের মধ্যে হতদরিদ্র কৃষক, শ্রমিক, খেতমজুর রয়েছেন। আবার রয়েছেন রসায়নের অধ্যাপক, পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, সরকারি চাকুরে ডাক্তার, গবেষক, শিক্ষক। জেল কর্তৃপক্ষকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হয় তাঁদের নিয়ে।
একটা চাপা রটনা আছে– কমরেড ব্রহ্মার বাবাও মাওবাদী; তিনি বন্দি আছেন। কিন্তু তিনি ঠিক কে, এটা একেবারে শীর্ষ দু’-তিনজন নেতা ছাড়া কেউ জানেন না। কেউ আলোচনাও করেন না।
কিন্তু এখন খবরের শীর্ষে কুসুমডিহায় মাওবাদী হামলা আর কমরেড ব্রহ্মা।
প্রেসিডেন্সির সেল ওয়ার্ডের উঠোনে বসেছিলেন প্রশান্ত। বিশাল ইন্টারভিউ, মানে সাপ্তাহিক দর্শনার্থীর সঙ্গে দেখা সেরে ফিরলেন। যাঁরা আসছেন, তাঁদের উপরেও কড়া পুলিশি নজর। তবে জেলের দু’-একজন অফিসার, কর্মী টুকটাক সাহায্য করে দেন মাওবাদীদের। যে সেপাই চাকরি করছে, সেও তো গরিব ঘর থেকে আসা। কেউ কেউ মাওবাদীদের সম্মান করতে শুরু করে, দু’-একটা খবর পাচার করে দেয়। ফোন নয়, যা হবে মুখে মুখে। ফোন এখন বিপজ্জনক।
বিকেলের আসরে কমরেড বিশাল বললেন, ‘কমরেড ব্রহ্মার নামটা বড় বেশি করে সামনে চলে এল। পুলিশ এখন পাগলের মতো খুঁজবে। চারটে রাজ্য ধরতে নামবে। আমি বলে পাঠালাম ব্রহ্মা যেন কোথাও কোনও ঝুঁকি না নেয়। কমরেড কিষাণজির মতো ভুল যেন না করে। কাউকে বিশ্বাস করতে হবে না। মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে না। নিজের মতো থাকুক আর কাজ করে যাক। সংগঠনের সকলকেও পরিচয় জানানোর দরকার নেই। এখন রণনীতি বদলাতে হবে।’
প্রেসিডেন্সি, বারুইপুর, দমদম, মেদিনীপুর-সহ যে ক’টা জেলে মাওবাদীরা আছেন, খবর চাউর। আর সকালে নজর খবরের কাগজে, কুসুমডিহার খবর, কমরেড ব্রহ্মার খবর আছে নাকি। পুলিশ ব্রহ্মাকে ধরার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। কিন্তু বিষয় হল তাঁর কোনও ছবি বা তার সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই। এই সন্ধান বড়ই কঠিন।
দমদম জেলে মাওবাদীদের জটলায় অধ্যাপক সমরেশ বললেন কারখানার শ্রমিক নরেনকে, ‘কী কমরেড, তোমরা তো জঙ্গলের ওই দিকটায় অনেকদিন ছিলে। ব্রহ্মাকে চেনো না কি? কোথাকার লোক? আসল নাম কী?’ নরেন অবাক হয়ে বলেছে, ‘‘নামই শুনিনি আগে। আর ছ’বছর হল, আমিই তো জেলে। এখানকার লোক না অন্ধ্র থেকে আসা, বুঝতেই পারছি না।’’ মাস্টারমশাই অমিয় সাউ ধরা পড়েছিলেন বর্ধমানে কাজ করতে গিয়ে। শহুরে মাওবাদী থেকে ক্রমশ সর্বত্রগামী মাওবাদীতে পরিণত হয়েছেন তাঁরা। অমিয় গলা নামিয়ে বললেন, ‘কমরেড বিশাল বা কমরেড রুদ্র নিশ্চয়ই জানবেন। আমাদের এসব নিয়ে বেশি আলোচনার দরকার নেই।’
ঠিক এই ধারণাটাই রয়েছে পুলিশমহলের, ওঁরা দু’জন জানবেনই। ওঁদের উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যাঁর যাঁর জেলের ওয়ার্ডে বিশ্বস্ত সেপাই, মেট দেওয়া হয়েছে। এমনকী, রুদ্রর ওয়ার্ডে একটা ‘ফালতু’ দেওয়া হয়েছে। জেলে ফালতু মানে একটি বন্দি, যে সহকারী হিসেবে কাজ করতে পারে। মেট আর রাইটারের সহকারী। মজা হল, এই ফালতু কিছু টাকার বিনিময়ে গোপনে বন্দিদের মোবাইল সাপ্লাই দেয়। এটা এখন ফাঁদ। এই বাপ্টু নামে ফালতু ছেলেটা জেলারের খাস। পুলিশ ওর মাধ্যমে সিম ঢুকিয়ে দেয়। ওর বাড়িতে কিছু সোর্স মানি পৌঁছে যায়। এসব গোপন। ছেলেটা বন্দিদের সঙ্গে মিশে থাকে। ওকে পানিশমেন্টের নাম করে সেল ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। রুদ্র যদি ওর কাছ থেকে ফোন নিয়ে কোনও গোপন ফোন করেন, পুলিশ শুনবে কী কথা হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হল, এই ফাঁদ কাজ করছে না। ফালতুর কাছ থেকে ফোন চাইছেন না রুদ্র। পুলিশ অন্য সব পথ দেখছে।
রাহুল ঠিক করল মাধাইয়ের উপর চাপ বাড়াবে। জেরায় জর্জরিত করে গ্রেপ্তারের মুখে নিয়ে যাবে। তাতে যদি সংগঠনের তিন বা চার নম্বর স্তরের আরও কিছু নাম পাওয়া যায়, সেইসব সূত্র ধরতে হবে।
তবে, রাহুলের কাছে এখন এটা পরিষ্কার যে, সাগরটিলার উপরের যে দু’-তিনজন থানায় দেখা করতে আসেনি, তারা নিখোঁজ। নির্ঘাত সুনেত্রা। কিন্তু যার ঘরে মহিলা উঠেছিল, সে তো এই সুনেত্রার নামও শোনেনি। এই আত্মীয়দের বাড়ি কোথায়, সে জানিয়েছে। রাহুল বাঁকুড়া জেলায় সেখানে লোক পাঠিয়ে দেখেছে, সেটা ধূ ধূ মাঠ। বছরদুয়েক আগে যে বন্যা হয়েছিল, তাতে নাকি ক’খানা ঘর পুরো ভেসে গিয়েছে।
তবে এক অদ্ভুত মহিলার সন্ধান পেয়েছে রাহুল। এই কুসুমডিহার একদম শেষপ্রান্তে।
( চলবে)
১৯২৫ সালের মে মাসে ফরিদপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণে চিত্তরঞ্জন দাশ ঘোষণা করলেন যে, সরকারের সঙ্গে সম্মানজনক সহযোগ করতে তিনি প্রস্তুত। নেতৃত্বের মোহ যখন মানুষকে আচ্ছন্ন করে তখন মহৎ মানুষের অবদান বা তাঁর থেকে দেশের আরও প্রাপ্তি আমরা বিস্মৃত হই না কি?