জয়-ভীরু তাও পারিশ্রমিকের জন্য এসেছিল এই কাজে, কিঞ্চিৎ সুপারি নিয়েই, বাহাদুর ভুলেছিল আদর্শেই। অর্থাৎ, গব্বর সিংদের সামনে আইনও প্রায় হাত তুলেই বসেছিল। তখন প্রয়োজন ছিল তাই বেপরোয়াদেরই। আর সেই জাসুসি কাহিনির দুর্ধর্ষ ডাকাতদের উত্তরসূরি হয়েই গব্বর এল বটে, কিন্তু ততদিনে সে আর ‘ডাকু’ নেই, তার চেহারা, উপস্থিতির ভেতর ‘ওয়েস্টার্ন’-এর ভিলেনের যাবতীয় রগরগে হিংস্রতা ও দয়াহীনতা; নির্মম ক্ষমাহীন লুটেরার মগজ তার।
১৫.
রাজস্থান মে ডাকু হ্যায় ইয়া নেহি হ্যায়-এর উত্তর যাই-ই হোক, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’-তে যে ট্রেনের পাশাপাশি ডাকাতিয়া ঘোড়ার মিছিল ছুটল, তার মধ্যে একটা মজা কিন্তু লুকনো ছিল। প্রথমত, এই বিপুল দক্ষযজ্ঞ ক্লাইম্যাক্সটি জটায়ুর গল্প নিয়ে নির্মায়মাণ হিন্দি সিনেমার দৃশ্য, যেখানে নায়ক প্রখর রুদ্র; আর যেখানে নায়ক খোদ ফেলুদা, সেখানে ক্লাইম্যাক্স কিন্তু অন্তর্গত। ট্রেনের কামরার ভেতর চলছে সেই অ্যাকশনহীন চাপা টেনশন, সেখানে খলনায়ক ডাকু নয়, বরং বোম্বাইয়ে সদ্য আমদানি হওয়া মাফিয়া-প্রোডিউসার, যাদের সিনেমায় দেখা যেতে শুরু করবে আরও দুই দশকেরও বেশি সময়ের পর থেকে, রামগোপাল ভার্মাদেরই হাত ধরে। অর্থাৎ, সত্যজিৎ দু’টি জিনিস বোঝাচ্ছিলেন। এক, এই ডাকাত বনাম ট্রেনের দৃশ্যর গল্পের বীজ জটায়ুর পাল্পেই মিলবে; দুই, বাণিজ্যনগরীর আসলি ভিলেন তখন এই মুখে কাপড় বাঁধা ডাকাতরা নয়, বরং সেইসব ছবিরই প্রযোজকরা। কিন্তু নিজের গল্পকে ওই বলিউডি কাণ্ডকারখানার থেকে বিযুক্ত করেও, ঠিক এই গল্প প্রকাশের পরের বছরেই মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-তে সঞ্জীব কুমার ও আমজাদ খানকে দিয়েই অভিনয় করিয়েছিলেন সত্যজিৎ, এবং সেখানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন। কাজেই ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত সত্যজিতের ফেলুদাকাহিনির ক্লাইম্যাক্স ও ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া ছবির মধ্যে ‘শোলে’-র প্রভাব কোথাও ঘাপটি মেরেই রইল। জটায়ু যতই ‘কোডোপাইরিন মার্কা ছবি’ বলে হেয় করুক, তার গল্পের গতি সেই বোম্বাইতেই হল, বোম্বেটেরা তার খলনায়ক হল বটে, কিন্তু ঠান্ডা মাথার প্রযোজক-ভিলেন রইল আড়ালেই, যতক্ষণ না ফেলুদা তার মুখোশ খোলে।
লুকমন বাবা হোশিয়ারনগরী-র ‘জালিম ডাকু’ যখন উর্দু সাহিত্যের আন্ডারগ্রাউন্ডে ঝিলিক মারছে, তখন, গত শতকের তিনের দশকের শেষ ভাগে আবার কোনান ডয়েল অনুবাদও হচ্ছে সেই উর্দুতেই। এর পরে পরেই বেরচ্ছে মুনশি মহম্মদ নাইমুল্লা রায়বরেলভি-র ‘বাহরি তুফান’, বা নাদিম মহম্মদ ইয়াকুব ফয়রেজপুরী-র ‘ডাকু শাহজাদা’। ইসলামিক ইতিহাসের সন্ধানী মার্কাস ড্যাশেল এইসব ‘ডাকু’ সাহিত্যের কিছু কিছুর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন পারসি প্রভাবের সূত্র। যাই হোক, উর্দু এইসব পাল্পের ডাকাতরা কখনও বা জলদস্যু, হার্মাদ, কখনও বা এদেরই তৈরি রবার-নির্মিত জলদৈত্য (তখন সদ্য উর্দুতে অনুবাদ হওয়া শার্লক হোমসের বিখ্যাত উপন্যাস ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস’-এর প্রভাব ছিল কি?)। মোদ্দায়, পাশ্চাত্যের গম্ভীর মস্তিষ্কব্যঞ্জক গোয়েন্দা নয়, আতশকাচ হাতে ঘুরে বেড়ানো ‘সুরাঘ্রাশন’ বা দুর্দম সব ডিটেকটিভরা ছিল অবিভক্ত ভারতের লাহোর ও মধ্য পাঞ্জাব থেকে প্রকাশিত এইসব ‘জাসুসি’ কাহিনির নায়ক, কিন্তু তাদের খলনায়করা ছিল জটায়ু-রচিত ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’-দের মতোই। বস্তুত, দুশমন যত দুর্ধর্ষ হবে, এইসব গোয়েন্দা গল্পের ততই আকর্ষণ বাড়বে, এমনটাই ছিল দস্তুর। সমুদ্রপথের রোমান্টিক রোমাঞ্চও এখানে নজরটানের বিষয়। ঔপনিবেশিক অভিযানের স্পৃহা হোক বা আমাদের আবহমানকালের বাণিজ্যভাবনা, সমুদ্রের যে অভূতপূর্ব ভূমিকা সেখানে, তা উর্দু এইসব সাহিত্যের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও কখনও কখনও অতিলৌকিক আশীর্বাদ বহন করে আনে।
এর চার দশক পর যখন ইন্দ্রজাল কমিকস-এ বাহাদুর আসছে, তখন আর জাসুসির চিহ্ন নেই কোথাও। পুলিশের হাতে খুন হওয়া ডাকাতের ছেলে বাহাদুরের প্রতিশোধেচ্ছা ভুলে পুলিশের সহায়ক ‘ভিজিল্যান্ট’ হয়ে ওঠার নেপথ্যে যেন ছিল ‘শোলে’-র শুরুতেই ‘ঠাকুরসাহাব’-রূপী সঞ্জীবকুমারের সেই সংলাপ, যা তিনি ছুড়ে দিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা পুলিশকর্তার উদ্দেশে, সহজ বাংলায় যা দাঁড়ায়, ‘একতরফে এদের (এখানে সিনেমার জয় ও ভীরু) ভেতর যেমন হারামিগিরি ডগমগ করছে, তেমনই এদের ভালমানুষিও আছে কিছু।’ তবে, সংশোধনের এক আশ্চর্য রাষ্ট্রীয় কল্যাণকামিতার পাশাপাশি আইনের আওতার বাইরের কাজ হাসিলও ছিল বাহাদুর বা জয়-ভীরুদের ব্যবহার করার উদ্দেশ্য। জয়-ভীরু তাও পারিশ্রমিকের জন্য এসেছিল এই কাজে, কিঞ্চিৎ সুপারি নিয়েই, বাহাদুর ভুলেছিল আদর্শেই। অর্থাৎ, গব্বর সিংদের সামনে আইনও প্রায় হাত তুলেই বসেছিল। তখন প্রয়োজন ছিল তাই বেপরোয়াদেরই। আর সেই জাসুসি কাহিনির দুর্ধর্ষ ডাকাতদের উত্তরসূরি হয়েই গব্বর এল বটে, কিন্তু ততদিনে সে আর ‘ডাকু’ নেই, তার চেহারা, উপস্থিতির ভেতর ‘ওয়েস্টার্ন’-এর ভিলেনের যাবতীয় রগরগে হিংস্রতা ও দয়াহীনতা; নির্মম ক্ষমাহীন লুটেরার মগজ তার। অন্যদিকে, জয়-ভীরুর মতো ছিঁচকে চোর প্রথমে নেহাতই কিছু রোজগারের আশায় এহেন খলচরিত্রর সঙ্গে লড়াইয়ে নামলেও, একটি বিন্দুর পর তাদেরও আদর্শবোধ জাগে, বাহাদুরের মতোই। আর উর্দু পাল্পের আন্তর্জাতিক স্তরের সমুদ্রপথের ভিলেন সেই ‘জালিম ডাকু’ গব্বরও ততদিনে একান্তভাবেই লোকাল, যেমন বাহাদুরের লড়াই ছিল দেশজ গ্রামজীবনের অন্দরমহলেই।
একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন ওয়েস্ট’, ‘দ্য গুড, ব্যাড অ্যান্ড আগলি’, ‘হাই প্লেনস ড্রিফটার’, ‘দ্য কাউবয়েজ’-এর মতো কাল্ট ওয়েস্টার্ন-এর যে দৃশ্যগত রুক্ষতা, তা পশ্চিম ভারত থেকে, আরাবল্লী থেকে চাইলেই মিলবে, অতএব, পরাধীন দেশের পাল্পের সেইসব সমুদ্রপথের রোমান্টিকতা অতীত হয়েছে। আবার এসব ছবির মতোই ভাড়াটে বাউন্টি হান্টার, বহিরাগত সৈনিকদেরও আমদানি করা যাচ্ছে, জরুরি অবস্থা-দীর্ণ, রাষ্ট্রবিপ্লবের নানাবিধ সম্ভাবনা-আকীর্ণ দেশে যারা অনেক বেশি ভরসাযোগ্য, উর্দিপরা রাষ্ট্রের প্রতিনিধির থেকে। তাই এই ছবির ক্লাইম্যাক্সে বুড়িছোঁয়া পুলিশের উপস্থিতি, ঠাকুরকে চরম প্রতিশোধ নেওয়া থেকে ঠেকাতে, তাও তা সেন্সরের নিতান্ত চাপেই। তার সঙ্গে জুড়ল গ্রামবাসীদের একত্রিত হওয়ার বোধ, যা ওয়েস্টার্ন-এও বিভিন্ন সময় ছিল। ভূখণ্ড বা জমির লড়াই, সঙ্গে আনাজের বখেরা, হোলি-জাতীয় উৎসবের গণ-উদযাপনে কার্নিভালের সমষ্টিগত বোধ, এই সবই জুড়ল ছবিটিকে ভারতীয় মাত্রা দিতে। ঠাকুর থেকে জয়, চাষবাসে মন দিয়ে শান্তি পেতে চেয়েছে সকলেই। একই সঙ্গে, এই ছবিতে প্রেমের মধ্যে যৌনতার যেটুকু ছোঁয়াচ (বাসন্তী-রূপী হেমা মালিনীকে ভীরু-রূপী ধর্মেন্দ্রর বন্দুক শেখানোর ছল, রাধা-রূপী জয়া বচ্চনের আঁচল সরে যাওয়া ইত্যাদি), তাও চটুল, গ্রাম্য অথবা সংযমী। রাধা নামের মধ্যেই জয়া বচ্চনের চরিত্রের পরিণতির আভাস দিয়ে দেওয়া ছিল কি? জয়ের মৃত্যু তাই তার জন্য নিয়ে এল অন্তহীন মাথুর পর্যায়? হারমোনিকা, বাঁশি নয় কিন্তু, যে সুরলহরী তুলল আর. ডি. বর্মনের মেলডি, ভানু গুপ্তর বাদন ও অমিতাভ বচ্চনের অভিনয়ে, বা ছবির শুরুতেই আর. ডি. বর্মনের রুক্ষ, পাহাড়ি ছন্দের সুরে যে মহাকাব্যিক দ্যোতনা ছিল, তাও একান্তই ভারতীয় হয়ে রইল বেদনায়, বিরহে বা উদ্দীপনায়।
ভারতীয় ছবির নববসন্তের হিল্লোল তখন আসতে শুরু করেছে, যা মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ সূচিত করেছিল। ‘অঙ্কুর’, ‘নিশান্ত’, একটু পরে ‘মন্থন’ (শ্যাম বেনেগালের যে ছবি নতুন করে কান চলচ্চিত্র উৎসবে আলোড়ন তুলছে) বা ‘আক্রোশ’, তারও পরে ‘মির্চ মশালা’ ইত্যাদিও কিন্তু গ্রামভারতের ছবি ছিল। কিন্তু দুই ইন্টারভালে ভাঙা ‘শোলে’-ই কীভাবে যেন হয়ে উঠল ভারতীয় সিনেমার একান্ত লোককথন, শহর-গ্রাম নির্বিশেষে যা বলিউডি জনপ্রিয় ছবির নতুন মাইলস্টোন হয়ে উঠল। বাণিজ্যিক নিরিখে এর ধারেকাছে না থেকেও, কাল্ট তকমার নিরিখে এই ছবির প্রায় পরবর্তী জনপ্রিয় মাইলফলক হয়ে ওঠা ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ কিন্তু শুরুতেই গ্রাম, জমি, শস্যের অধিকারকেই মূল চরিত্র হিসেবে খাড়া করল। ডাকাত ও অপরাধে পিছপা না হওয়া ভাগ্যান্বেষীর মধ্যে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব চলল চার দশক, যার মধ্যে পরাধীন ভারতের সেই প্রায় মিথ হয়ে ওঠা ডাকাত ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা হয়ে উঠল কখনও বেনিয়া, কখনও চোরাকারবারি মাফিয়া, কখনও রাজনীতিক। ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় অপরাধের এই বদলের আখ্যানের সূত্র যেন কোথাও নিহিত ছিল ১৯৭৫ সালের সন্ধিক্ষণে মুক্তি পাওয়া ওই ভারত-কাঁপানো ‘শোলে’-র মধ্যেও।
(চলবে)
ফ্লাশ কাট চলবে না। হুকুম। নীরেনদা বললেন, ‘প্রিন্টিং এরিয়া’ বলে একটা কথা আছে, ‘মার্জিন’ বলে একটা বস্তু আছে, সেটা তো মাথায় রাখো। ছোটদের পরীক্ষার খাতায় দেখো, যেখানে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া থাকে, মার্জিন রেখে সুন্দর হাতের লেখার জন্য বাড়তি দু’ নম্বর। উনি ছোটদের মাস্টারমশাই, প্রকৃত শিক্ষক। তাদের কোনওরকম অসুবিধা কিছুতেই সহ্য করতেন না।