নীড় ছোট, ক্ষতি নেই। গোঁজাগুজি ঠাসাঠাসি করে আমাদের দিব্যি কেটে যাচ্ছে। একটা বালিশ, আর একটা খবরে কাগজের বালিশে আমাদের নালিশ নেই। তড়কা, পনিরে রাত কেটে যায়। যদিও প্রথমবার এখান থেকে ফিরেই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, আর পনির খাবে না। এ ব্যাপারে আজও সে পিতামহ ভীষ্ম। দোষের মধ্যে, কোনও একদিন পনিরের সঙ্গে ঝোলের তেমন বনিবনা হয়নি বলে তরকারি হয়ে উঠেছিল এক দুরূহ অভিযান।
১৫.
বেকারি বিস্কুটে মিষ্টি, বেকার-ই জীবনে অনাসৃষ্টি।
ব্রাইট স্টুডেন্ট এ পরমলগনে জীবনের ইট খেয়ে চিনতে শিখছে অপমান। অভিভাবকরা মুহ্যমান! নতুন সময়। নতুন চাকরির সম্ভাবনা অঢেল। দস্তুর ছিল যা কিছু, কে যেন তাতে সিঁদ কেটে ভাগলবা। ডট কমের বাজারেও নকরি কি তবে কম পড়িয়াছে? প্রশ্নটা যে উঠতে পারে, তাই-ই অভিভাবকের ভাবনার বাইরে। বাবা বিশ্বায়ন তাহলে তেমন জাগ্রত নন! নইলে সেই গত দশকের বেকারত্বের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে কী করে! যেন এই গোলোকায়নের বিশ্বে সমস্ত স্বপ্নঘোষণার শেষে ‘শর্তাবলি প্রযোজ্য’ বলে দ্রুতস্বরে কিছু আওড়ানো হয়েছিল। তা তাঁরা ঠিক ঠাহর করতে পারেননি। আঁতে ঘা, দাঁতের মর্মের মতো বেকারের ধর্মও তাই বঙ্গজীবনের রঙ্গ হয়ে লেগেই থাকল। তিনের যোগসূত্র নিয়ে সেদিন মাথা ঘামানোর মতো মাথা ছিল না। বোঝা না-বোঝায় মেশা আমরা নতুন যৌবনের বেকার কয়েকজন শুধু নামলাম ফাজিল জীবনের সঙ্গে রসিক মোলাকাতে।
মেসের দশে মিলি করি কাজ গুণেই কি-না কে জানে, আমরা দু’জন এক ঘরের বন্ধু চাকরির বাজারে একঘরে। সঙ্গে জুটে গেল এদিক-ওদিকের আরও কয়েকজন। এ-মেস ও-মেস, এ-কলেজ ও-কলেজ। বেকারত্ব আসলে তৃতীয় বন্ধনী। অনেকদূর ছড়িয়ে থাকে, অনেককে কাছে টেনে নেয় দু’বাহু বাড়ায়ে। সবাই মিলেমিশে তাই একটা দল। ঘটনাচক্রে তারা হয়ে দাঁড়াল আলোয় আলো উজ্জ্বল সমারোহের সমাজে নতুন দলিত। ফেলাও যায় না, তাদের স্পর্শও করা যায় না। এর আগে পর্যন্ত চাকরি না-পাওয়ার জন্য ব্যক্তি দোষের ভাগী বড় একটা হত না। যে মাধববাবু আমাদের রসায়ন পড়াচ্ছেন, তিনি তো স্কুলে-কলেজে সর্বত্রই পড়াচ্ছেন। তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। সরকার সেই যোগ্য মানুষটিকে জায়গা দিতে পারছে না। বাহাদুর সরকার পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না বলেই যোগ্য মানুষ অযোগ্য সাব্যস্ত হতে পারে না– এই ছিল মোটামুটি ধারণা। ব্যাচে ব্যাচে পড়িয়ে জীবনের ম্যাচ জিতে যাওয়ার নমুনা কম কিছু ছিল না। তবে, নতুন কালের এই যারা বেকার তারা সে ভোলানাথ নয় রে সে ভোলানাথ নয়! তাদের সম্পর্কে নির্দ্বিধায় যোগ্য-অযোগ্যের পুরনো ধারণার চাল আর ভাতে বাড়ে না। নতুন মূল্যায়নে অতএব– তুমি যে সফল হতে পারছ না, সে তোমারই দোষ। নইলে তোমার পাশের বাড়ি, তার পাশের পাড়ি, তার পাশের বাড়ি সফল হচ্ছে কী করে! কোথাও একটা গভীর খামতি নিশ্চিতই তোমার অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে; কিন্তু ব্লাড টেস্টে তুমি তা খুঁজে পাবে না কখনও। সময় যদি নিলাম করে তোমার দর বাড়ায় তো তবে তুমি বাইশ ক্যারাট গোল্ড, অন্যথায় আনসোল্ড।
……………………………………………………
এদিকে বেকারের নেই বাটপারের ভয়। অতএব আমরা ঘুরে বেড়াই। মেস যেন এই সময়ে একটু একটু করে আড়ে-বহরে বাড়তে থাকে। যেখানে ছাই দেখবে, সেখানেই উড়িয়ে দেখতে হবে। অতএব ‘ছাই চাই’ হেঁকে এর ওর সঙ্গে যোগাযোগ। কেউ বলে, সিভি ঠিক করে বানাতে হবে। কভার লেটার বেটার না হলে গোড়াতেই কাঁচি। এদিকে ইন-করা-শার্ট যদি উলুরঝুলুর হয়ে প্যাংলা চেহারাকে তেমন আধুনিক সভ্যতার জন্য বলিপ্রদত্ত-সুলভ করে তুলতে না পারে, তাহলে নম্বর কাটা। এক্সটেম্পোয় ক’বার তুতলে ফেললে গুণতে থাকো। আর ইংরেজিতে চোস্ত না হলে চাকরি কী করে হবে দোস্ত! যত পরামর্শ, তত আলাপ।
…………………………………………………….
এ বেশ মজারই খেলা সন্দেহ নেই। ব্যক্তির সঙ্গে রাজা-র, কিন্তু এ-রাজা সরকার নয়। নাগরিক সহৃদয় হয়ে সরকারের ঘাড় থেকে বন্দুক নামিয়ে রেখেছে। মোদ্দা কথা, সামাজিক কাঠামোয় এই বেকার দলের এমন একটা জায়গা নির্ধারিত হয়, যাতে মনে হতে পারে, এই পৃথিবীর উন্নতিপ্রকল্পে কর্পোরেট পুঁজির যে মহানব্রত, তাতে যেন এদের অধিকার নেই। ঈশ্বর বিরূপ! সম্ভবত এদের জন্য অন্য কোনও কাজই চতুর্বর্ণ ঘোষণার সময় কুরুক্ষেত্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণঠাকুর ঘোষণা করে গিয়েছেন। তাঁকে জল দাও, নকুলদানা দাও। তিনি সময় পেলে ভেবে দেখবেন নাহয়। বেকারজীবনের সঙ্গে বাঙালির যে আলগা একটা ভাবের ঘর, এদের ক্ষেত্রে সেখানেও চুরি। কেননা জেনারেলের বদলে বাছা হয়েছিল পড়াশোনার স্পেশাল লাইন। ফলে গ্লানির পর্দা বেশ চড়া। ব্যক্তির কৃতিত্ব আর ব্যর্থতা ভাগাভাগি করে অবশেষে হাতে এসেছে শূন্য। প্রাপ্তির ভিতর যেমন ব্যক্তির আলগা আহ্লাদ মেশানো, না-পাওয়ার ফুটনোটেও তেমন ব্যক্তি একা। মনোযোগী কারও চোখে পড়লে ভালো, নইলে সোসাইটির কাছে ভাইটি বা বোনটির কোনও দাম নেই। বিচ্ছিন্নতা এতখানি গাঢ় যে, এমনকী এক বন্ধু চাকরি পেয়েও দারুণ মনোকষ্টে ভুগল বেশ কিছুদিন। কারণ কোম্পানি ডাক পাঠাতে দেরি করছে। আর আশপাশের লোকে ভাবছে, চাকরি সত্যি নাকি গল্প? ফেক নিউজ নয়তো! দিনকতক সে ঘরের বাইরে বেরনোই বন্ধ করে দিয়েছিল।
এদিকে বেকারের নেই বাটপারের ভয়। অতএব আমরা ঘুরে বেড়াই। মেস যেন এই সময়ে একটু একটু করে আড়ে-বহরে বাড়তে থাকে। যেখানে ছাই দেখবে, সেখানেই উড়িয়ে দেখতে হবে। অতএব ‘ছাই চাই’ হেঁকে এর ওর সঙ্গে যোগাযোগ। কেউ বলে, সিভি ঠিক করে বানাতে হবে। কভার লেটার বেটার না হলে গোড়াতেই কাঁচি। এদিকে ইন-করা-শার্ট যদি উলুরঝুলুর হয়ে প্যাংলা চেহারাকে তেমন আধুনিক সভ্যতার জন্য বলিপ্রদত্ত-সুলভ করে তুলতে না পারে, তাহলে নম্বর কাটা। এক্সটেম্পোয় ক’বার তুতলে ফেললে গুণতে থাকো। আর ইংরেজিতে চোস্ত না হলে চাকরি কী করে হবে দোস্ত! যত পরামর্শ, তত আলাপ।
ইতিমধ্যে বেকারজীবনের মহৎ পেশাটির দিকে এগিয়ে দিয়েছে আমার বন্ধু শ্রাবণী। সে অবিশ্যি বেকারও নয়, মেসবাসিন্দাও নয়। তবে মেসের সুখে-দুঃখে গোড়া থেকে জড়িয়ে। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো। পরীক্ষায় নম্বরের বিচারে একেবারে উপরের সারিতে। কিন্তু কে না জানে উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে। সেই সূত্রেই কী করে যেন হাম সাথ সাথ হ্যায় হয়ে মেসের সঙ্গে সঙ্গেই তার চলা শুরু হয়েছিল। দুর্বোধ্য অঙ্ক ইত্যাদি খুব সহজেই বুঝিয়ে দেয়। বিশেষত পরীক্ষার আগে আগে এমন প্রাঞ্জল করে আমাদের দু’-একটা চ্যাপ্টার পড়িয়ে দিত যে, আমরা তার ক্লাস করে মার্কশিটের সম্মান রক্ষা করতাম। চাকরির বাজারে আমাদের মতো ক্যাবলাদের গ্রুমিং করানোর দায়িত্বও নিয়েছিল। যাই হোক, মেসের অপূর্ব এক উপযোগিতা সে উদ্ভাবন করেছিল। যাকে বলা যায়, ‘অস্থায়ী ব্যাঙ্ক’। বিনা কারণেই সে অনেকগুলো টিউশনি করত। কাকিমা, অর্থাৎ শ্রাবণীর মা জানতেন না। সম্ভবত ভাবতেন, মেসে বা অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। সেই টিউশনির টাকা সে গচ্ছিত রাখত আমাদের মেসে। আমার বইয়ের তাকে একখানা পুরনো গ্রামার বই তার জন্য বরাদ্দ ছিল। সেখানে সে টাকা রাখত, দরকারমতো আবার বের করে নিয়ে খরচ করত। কখনও জরুরি প্রয়োজন পড়লে ফোনে নির্দেশ দিত, ‘ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে ওটা কিনে রাখিস তো’ ইত্যাদি। আমাদের আর এক বন্ধু শুভঙ্কর সে প্রায় মেসের বাসিন্দাই। সেই একেবারে ফ্রেশার্সের দিন সল্টলেকের বৃষ্টিতে আমরা দু’জনই ভিজেছিলাম। ভেজা জামা আর আজীবন শুকোইনি। যাই হোক, শুভঙ্কর বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবতীয় স্বপ্ন লালন করে মেসেই। তার গিটার বাজে, সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখা হয়, ছেঁড়াও হয়। আমাদের হিসাবখাতা তাকে মেসের মানুষ হিসাবেই চিনত। সে-ও এক পর্বে টিউশন শুরু করে দিল, যদিও চাকরি পেতে বেগ পেতে হয়নি তাকে। তাহলে আর বাকি থাকি কেন! নাম লিখিয়ে ফেললাম সেই খাতায়। সে এক দারুণ ব্যাপার! নিজে বেকার, অথচ সামনে বসা পড়ুয়াকে বোঝাতে হবে, রেজাল্ট ভালো যার, তার হবে বড় ‘কার’। এমতাবস্থায়, ক্লাস সিক্সের ঘাড়গোঁজ যে-মেয়েটি কিছুতেই অঙ্ক করবে না পণ করেছিল, তাকে দোষই বা দিই কী করে! ক্লাস নাইনের যে কিশোর জানত পড়ার থেকে নাচে সে বেশি স্বচ্ছন্দ, তাকে নিরুৎসাহ করি কী করে! গোটা বইকে কেটেছেঁটে এডিট করে তার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলাম, এটুকু আয়ত্ত কর, বাকি সময়টা নাচের। খুশি হয়ে সে চমৎকার রেজাল্ট করে মা-বাবাকে চমকে বুঝিয়ে দিল নাচতে জানলে উঠোন নিয়ে কেউ দোষারপ করে না।
এই সময় আমাদের সাইবার ক্যাফেতে আনাগোনা বাড়ে। নানারকম হালহদিশ দরকার। তাছাড়া ‘লাইনের বাইরে’ অন্যান্য পরীক্ষাতেও নিয়মিত ফর্ম ফিলাপ। দেখা যাচ্ছে, বেকারের দরজাই সেই জায়গা, বিশ্ব এসে যেথায় মেশে। অসংখ্য কর্মের মাঝে হে মঙ্গলময়, কোথাও একটা জুতে দিলে ভালো হয়, এই আশায় আমরা ভোটার কার্ড দেখিয়ে কম্পিউটর লগ ইন করতাম। জাবদা খাতায় লিখে রাখছি কে এসেছি, কখন এসেছি। আধ ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার বেশি সচরাচর কেউ কাটায় না। কাজের কাজ শেষ হলে শেষ দশ-পনেরো মিনিটে একটু অর্কুটে উঁকিঝুকি। নতুন একটা দুনিয়া সেখানে তৈরি হয়েছে। বেকার কি সাকার তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। অনেকটা যেন মেসেরই মতো। অনেকগুলো অপরিচিত মানুষের জুড়ে জুড়ে যাওয়া। যেন একটা আড্ডা দেওয়ার অন্য কফি হাউস, যেখানে সমাজের কে কোথায় দাঁড়িয়ে, তা নিয়ে হীনমন্যতার অবকাশ নেই। এরই গায়ে গায়ে প্রায় এসে যাবে ফেসবুক। পাড়া, ক্লাব তখন বঙ্গসন্তানের বুকপকেট থেকে প্রায় ফসকে গিয়েছে। কেননা পড়া হোক বা চাকরি, পাড়া ছাড়তেই হচ্ছে। তার উপর আবার জমছে নানাবিধ গ্লানির কিস্সা। এদিকে রাজনীতির বাতাসে ঘূর্ণিপাক। এইট বি-র রেলিং-এ বসার আগে সবাই যেন সবাইকে জিজ্ঞেস করতে চাইছে, তুমি কোন দলে। আর কিছুদিন পরে একদিন মহল্লায় মহল্লায় পরিবর্তনে বেজে উঠবে রবীন্দ্রসংগীত। তবে ঠিক তার আগের পর্বে বাতাস এমন উথালপাতাল যে খানিকটা আড়াল যেন জরুরি হয়ে পড়ছিল সবদিক থেকেই। বাস্তবের কোনও এসকেপ রুট নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাও পাসওয়ার্ড ভুললে নতুন পাওয়া যায়। এই বিকল্পের দিকেই তখন ঝুঁকে গেল জীবনপ্রকল্প।
মোবাইলের স্ক্রিনও রং পেল। সবথেকে বড় কথা, টপ-আপের দেখা মিলল, যা দিয়ে ফোনেও নেট করা যায়। ব্যক্তিগত ওয়াইফাইহীন সময়ে সে হল হাতে স্বর্গ। ডেটা কেবিল দিয়ে কম্পিউটরের সঙ্গে জুড়ে দিলে দিব্যি ডেস্কটপে গোটা বিশ্ব। মেস অতএব একদিন ছুঁয়ে ফেলল বাংলাদেশ। আমি বন্ধু পেয়ে গেলাম, যে কিনা আমার থেকে বয়সে মোটে এক দিনের বড়। আগের রাতে তার জন্মদিনে আমি শুভেচ্ছা জানাই, পরের রাতে সে। এখনও। সেই মেসের দিনে সে তার দেশে বসে শুনত আমার বেকার জীবনের হেঁটে হেঁটে বেড়ানো ধুলোবালি। আমি যাদবপুরে দাঁড়িয়ে শুনতাম তার বাড়ি ছেড়ে ইউনিভার্সিটিতে আসা বিকেলবেলার গল্প। মনে হত, দূরত্ব যেন আবছা কুয়াশা। রোদ উঠলেই কেটে যায়। পূর্ববঙ্গ নিয়ে আমার কোনও স্মৃতির উত্তরাধিকার নেই। দেশ সূত্রে যে স্মৃতি-ভাঁড়ারের আমি অংশীদার সেই হিসাবেই বাংলাদেশ চেনা। সে চেনা দূরের। অনেকদিন পর মালদায় সীমান্তের সামনে এনে আর এক বন্ধু বলল, ‘এই দেখ বাংলাদেশ।’ দেখি কাঁটাতার। দেখি দূরের দেশ। এই সেই মাটি, কাছের তবু বহু দূরের। বাঁটোয়ারা স্মৃতি নিয়ে কত মানুষ এখনও জরাসন্ধ হয়ে আছেন এ-দেশে, ও-দেশে। মাঝখানে খেলা করে রাজনীতি-জল। কখনও গড়ায়, কখনও ফুঁসে ওঠে। সীমান্তের সেই বিন্দুর আরও কাছে টেনে নিয়ে যায় বন্ধু, ‘আয় না, অসুবিধা নেই।’ আমার অসুবিধা হয়, যতদূর চোখ যায় কোথাও আমি আমার বন্ধুকে খুঁজে পাই না।
বন্ধুর মাঝেই আমি তার দেশকে খুঁজে পেতাম। যেদিন তাকে শিয়ালদা থেকে নিয়ে এলাম, মেসে, মনেই হল না অপরিচিতের নাম উচ্চারিত হল। যেন তার এখানেই থাকার কথা ছিল। নীড় ছোট, ক্ষতি নেই। গোঁজাগুজি ঠাসাঠাসি করে আমাদের দিব্যি কেটে যাচ্ছে। একটা বালিশ, আর একটা খবরে কাগজের বালিশে আমাদের নালিশ নেই। তড়কা, পনিরে রাত কেটে যায়। যদিও প্রথমবার এখান থেকে ফিরেই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, আর পনির খাবে না। এ ব্যাপারে আজও সে পিতামহ ভীষ্ম। দোষের মধ্যে, কোনও একদিন পনিরের সঙ্গে ঝোলের তেমন বনিবনা হয়নি বলে তরকারি হয়ে উঠেছিল এক দুরূহ অভিযান। সেই সবকিছুই সে লিখে নিয়েছে মনে, পরে লিখেছে খাতায়। পালবাজার রূপকথা হয়ে ওঠে। আমরা একই লেখা একসঙ্গে পড়ি। তা নিয়ে গল্প করি। আর সে আমাকে ভরসা দেয় যে, জীবনের ধুলোবালি কুড়িয়ে আমি চলতে পারি। যেন ভয় না পাই। আমার জন্য তুলে রাখে জীবানন্দের সমগ্র কবিতা।
এই বাংলাদেশ-এর মাত্রা বদলে গেল পরবর্তী সময়ে। বিশেষত সংবাদের পৃথিবীতে এসে দেখলাম, এর নানা রূপ। বন্ধুতা ছাড়া আমাদের কোনও ধর্ম ছিল না, তবে সংবাদের ধর্মে ইতিহাস নিয়ে অনেক টানাপোড়েন সর্বদা মিশে মিশে থাকে। জল কখনও গড়ায়, কখনও গড়ায় না। উল্টোদিকেও তার ব্যতিক্রম নেই। যেহেতু বন্ধুও পরে চলে এল সংবাদে। সেই খবরাখবর ব্যতিরেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদ মূলত কাব্য। সেখানে ঢুকে পড়ে আমাদের প্রেম, প্রেম-ভাঙা, চাকরি পাওয়া, আর একটা লেখা লিখে পড়িয়ে ফেলার আনন্দ। শীত এলে এখানে সেমিনার হয়। অনেক রকম মত ভাসে বাতাসে, অমতেও তা শুনি। প্রত্যেক মানুষের চোখ আলাদা দেখে। অনেক দেখা মিলে মিলে দৃষ্টি, তাকে মিলেমিশে থাকা বললে মিশে থাকা, নইলে নয়। সেসব নিয়ে গল্প হয় বন্ধুর সঙ্গে। কিছু তার ক্ষোভ, কিছু আমার। ঘটমান বর্তমান সবসময়ই হোঁচট খাওয়ায়। তবে তাতে আমাদের বন্ধুতার যুক্তফ্রন্টে পতনের শব্দ শোনা যায় না। বোধহয় আমরা কেউই কারুর পতাকার দিকে তাকাইনি, তাকিয়েছি মুখের দিকে। বন্ধুর চোখের দিকে। ইতিহাস যে-মোড়ের সামনে এনেই দাঁড় করাক না কেন, বদলের ইতিবৃত্ত যতবার ভাগের মুখে ফেলুক দেশকে, পৃথিবীর হিসাবনিকাশের বাইরে শুভ্রনীলই আমার কাছে নিজস্ব একান্ত বাংলাদেশ। ভাগাভাগি করে নেওয়া এক জীবনের রোদ্দুর তো আর মিলিয়ে যেতে পারে না। আমাদের মেসটাও তো তার ভিতর দিয়েই ছড়িয়ে আছে অনেকটা দূরে।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………
অথচ বিষ। অথচ বিদ্বেষ। অথচ সাহিত্যের ছদ্মবেশে পুজো নেশনতন্ত্রের। রাজনীতি বন্ধুত্বের বিরতি তেমন মানে না। রাষ্ট্রও যেন ছাড়া হাত-পা, যখন মানুষের কল্পনা ঢুকে পড়ে তারই বানানো ছকে। দেখি, এইসব উত্যক্ত দিনে কত সবাক জল বেবাক হিসাব কষে গড়িয়ে যায়। আর আলোচাতক কতিপয় মূক মানুষেরা এ-পৃথিবীর মার্জিনে কোণঠাসা হয়ে ক্রমশ মৃত হয়ে বেঁচে থাকে। হান কাং-এর উপন্যাসে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে লাশ হয়ে যাওয়া যুবকের মতো তারা শুধু থেকে থেকে ভাবে, ‘If I could hide in dreams. Or perhaps in memories.’
…পড়ুন মেসবালক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৩। মেস আমাদের শিখিয়েছে, দেশ অনেক রকম
পর্ব ১২। মেসবাসীর হিসাবশাস্ত্র এমন কুটিল যে স্বয়ং কৌটিল্যও তল পান না
পর্ব ১১। ছেড়ে যাওয়া ঘরে মেরা কুছ সামান থেকেই যায়
পর্ব ১০। বই বন্ধ করলেও, বন্ধ হয় না কিছু কিছু বই
পর্ব ৯। বোবার শত্রু নেই, বন্ধু তো আছে
পর্ব ৮। মেস কি কোনও নারীচরিত্রবর্জিত একাঙ্ক নাটক!
পর্ব ৭। যে ভাতের হোটেলে মাছকে ‘তেরা ক্যায়া হোগা কালিয়া’ বলতে হবে না, সেখানেই রোজের বেঞ্চি বুক করতাম
পর্ব ৬। মেসের বাড়ি না থাকলে দেশের বাড়িকে ঠিক চেনা যায় না
পর্ব ৫। মেসে থাকতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিছানা আর বেডের মধ্যে বিস্তর তফাত
পর্ব ৪। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কখনও মেসে থাকেননি
পর্ব ৩। মেস আসলে জীবনের ক্রিকেট-সংস্করণ
পর্ব ২। আদরের ঘরের দুলালদের সদর চেনাল মেস
পর্ব ১। মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না