এতগুলো প্রশ্ন হঠাৎ ধাক্কাধাক্কি করে সত্যেন্দ্রর মনে। মুহূর্তে এইসব সংশয় ও প্রশ্নের জাপ্টাজাপ্টি। তারপর সত্যেন্দ্র হ্যাটটা খুলে ছুড়ে দেয় ঘরের কোণে হ্যাট-ব্যাঙ্কের দিকে। হ্যাটটা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেয়াড়াভাবে ঝুলতে থাকে। সত্যেন্দ্র জ্ঞানদাকে জড়িয়ে ধরে, সামান্য নীচু হয়ে, দীর্ঘ এবং তীব্র চুমু খায় জ্ঞানদার ঠোঁটে, তার জিভ ঢুকে যায় জ্ঞানদার মুখের মধ্যে, জ্ঞানদা কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে, এমন মুখভরা চুমু কি সত্যেন্দ্র কখনও খেয়েছে তাকে? কোথায় শিখল?
১৬.
দরজা খুলব-খুলব করেও খুলল না জ্ঞানদা। মন বলল, আরও একবার এই ঠকঠক শব্দটা শোনা দরকার। ছোট্ট একটা খটকা। এবার আর দরজায় মৃদু আঙুলের শব্দ নয়। জুতোর ধাক্কা। এ ডাক ভালোবাসার নয়। অধিকারের।
মুহূর্তে তার সম্পূর্ণ নগ্ন শরীরে শেমিজের ঢাকনা ছড়াল জ্ঞানদা। এবং অবাক হয়ে দেখল, তার শরীরের সেই হিলহিলে সাপটা তার গর্তের মধ্যে পালিয়ে গেল। কোথায়, ঠিক কোথায় পালাল, জ্ঞানদা জানে।
জ্ঞানদা চোখে একরাশ ঘুম নিয়ে ছিটকিনি খুলে বলল, পদ্ম, কী হল রে, সাত সকালে তুই… এ কী, তুমি!
ঘরে ঢোকেন সত্যেন্দ্র। পরনে স্যুট, হ্যাট, হাতে রুপো দিয়ে বাঁধানো বেতের ছড়ি, পায়ে কালো পালিশ করা চিকন জুতো।
–সরি জ্ঞানু, দিবাস্বপ্ন ভাঙালাম নাকি?
পড়ুন মেজবউঠাকরুণ-এর আগের পর্ব: জ্ঞানদার কাছে ‘নতুন’ শব্দটা নতুন ঠাকুরপোর জন্যই পুরনো হবে না
সত্যেন্দ্রকে দুই বাহুর মধ্যে জড়িয়ে ধরে সামান্য যেন কষ্ট করে হাসে জ্ঞানদা। সেই হাসির মধ্যে কোথাও কি আছে এতদিন পরে পাওয়ার উথলে-ওঠা আনন্দ? না পাওয়ার অভিমান? সত্যিকারের অবাক আবেগ?
এতগুলো প্রশ্ন হঠাৎ ধাক্কাধাক্কি করে সত্যেন্দ্রর মনে। মুহূর্তে এইসব সংশয় ও প্রশ্নের জাপ্টাজাপ্টি। তারপর সত্যেন্দ্র হ্যাটটা খুলে ছুড়ে দেয় ঘরের কোণে হ্যাট-ব্যাঙ্কের দিকে। হ্যাটটা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেয়াড়াভাবে ঝুলতে থাকে। সত্যেন্দ্র জ্ঞানদাকে জড়িয়ে ধরে, সামান্য নীচু হয়ে, দীর্ঘ এবং তীব্র চুমু খায় জ্ঞানদার ঠোঁটে, তার জিভ ঢুকে যায় জ্ঞানদার মুখের মধ্যে, জ্ঞানদা কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে, এমন মুখভরা চুমু কি সত্যেন্দ্র কখনও খেয়েছে তাকে? কোথায় শিখল? চুমু শেষ করে সত্যেন্দ্র বললেন, ‘ডারলিং, মিস ইউ, মিস ইউ অল দ্য টাইম!’
‘অল দ্য টাইম!’ জ্ঞানদা জানে, ওটা বলতে হয় বলে বলা। স্রেফ বানানো বাহার!
সত্যেন এবার তাকায় জ্ঞানদার দিকে। জ্ঞানদার লজ্জা করে। সে হাত দু’টিকে বুকের ওপর জড়ো করে।
সত্যেন বলে, ঢাকলেই কি ঢাকা যায়? এখন তো দেখছি তোমার শরীরে ভরা বসন্ত।
–অসভ্য! জ্ঞানদা হাত ধরে নিয়ে যায় সত্যেন্দ্রকে পালঙ্কের ওপর। টাইয়ের নটটা খুলে দেয়। সত্যেন্দ্র মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে জ্ঞানদার শরীরের দিকে।
–কী দেখছ বলো তো অমন করে? চোখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে আদুরে উচ্চারণে জিজ্ঞেস করে জ্ঞানদা।
–দেখছি, তোমার শরীর কীভাবে ক’মাসে কতটা বদলে গেছে। আমার মা’র ভাষায়, তোমার শরীরের আড় ভাঙছে জ্ঞানু।
–ওরে বাবা, তুমি জানো এসব মেয়েলি ভাষা?
–মার কাছে বড় হয়েছি, আর মাতৃভাষা শিখব না?
সত্যেন্দ্রর কথায় হেসে ফেলে জ্ঞানদা।
ততক্ষণে কাঁধ থেকে দু’টি সাসপেন্ডার নামিয়ে সাহেবি পোশাক আলগা করে দিয়েছেন সত্যেন্দ্র।
–এ বাড়ির ছেলেমেয়েরা কেউ মা’র কাছে বড় হয় নাকি? বড় হয় তো ঝি-চাকরের কাছে। মা-র বুকের দুধ পর্যন্ত তারা পায় না। দুধ-মায়ের, দুধ খেয়ে তো তুমিও বড় হয়েছ।
–হ্যাঁ, তা ঠিক, অন্নপূর্ণা ছিল আমার দুধ-মা। আমি অন্নমা বলতুম।
–অন্য মা? না, অন্ন-মা?
–বাঃ, বেশ বললে তো জ্ঞানু।
–দুধ-মায়ের ইংরেজি কী গো? সত্যেন্দ্রর বুকের ওপর ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করে জ্ঞানদা।
–ওয়েট-নার্স। বলেন সত্যেন্দ্র। তারপর প্রশ্ন করেন, হঠাৎ দুধ-মায়ের ইংরেজি জানতে চাইলে?
–দুধ-মা ইজ রিডিকিউলাস। স্লাইটলি ভালগার মনে হয় আমার। ওয়েট-নার্স ইকুয়ালি হাস্যকর!
–কেন? বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন সত্যেন্দ্র। তিনি মুগ্ধ। জ্ঞানদা কী সুন্দর কথা বলতে শিখেছে! তার শরীরে একটা মনও ফুটেছে! এই মন ফোটাচ্ছে কে? কে পারে, নতুন ছাড়া? সত্যেন্দ্রর মনে দুলে ওঠে দোলাচল।
–ওয়েট-নার্স বেশ ফানি। একজন নার্স বাচ্চার ঘাড়ের কাছে সারাক্ষণ ওয়েট করছে দুধ খাওয়াবে বলে। ইশ! তার জীবনে আর কিছু নেই? শুধু বাচ্চাকে দুধ খাওযানেরা জন্য ওয়েটিং?
হো হো করে হেসে ওঠেন সত্যেন্দ্র!
–শব্দটা ‘Wait-nurse’ নয় জ্ঞানদা, শব্দটা ‘Wet-nurse’, ডাব্লু-ই-টি, ওয়েট, মানে ভিজে। যার বুকে দুধ এসেছে, বুক ভিজে আছে দুধে, বুঝেছ?
–তাই! বেশ তো! কিন্তু শব্দটার মধ্যে একটা ডিপ ট্রাজেডি? সত্যেন্দ্র ঠাওর করতে পারে না, কী বলতে চাইছে তার কিশোরী বউ।
–সাকলিং অ্যানাদার উওম্যানস চাইল্ড, ব্যাপারটা কতদূর ট্র্যাজিক বোঝো? কী বেদনা? কী অপমান? শুধু দারিদ্রের জন্য একটি মেয়ে মাথা পেতে মেনে নিচ্ছে তার মাতৃত্বের এই অবমাননা।
সত্যেন্দ্রর বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে! জ্ঞানদার মনটি এইভাবে তৈরি করছে এ-বাড়ির কোনও কারিগর? সেই একই কারিগর নিশ্চয় তৈরি করছে জ্ঞানদার মুখের ভাষা? তার ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, ফরাসি? এবং তার আঙুলে পিয়ানোর সুর?
হঠাৎ জ্ঞানদাকে টেক্কা দিতে সত্যেন্দ্র কিছুটা রূঢ় আধুনিকতায় বলে ফেলে, ওয়েট-নার্স কিন্তু একটি মহৎ কাজও করছে। বলতে পারো ট্র্যাজিক মাহাত্ম্য!
–কোন ট্র্যাজিক হাইটস্-এর কথা বলছ তুমি?
–বাবামশায় ঠাকুরবাড়িতে সারি সারি দুধ-মা পুষছেন কেন জানো?
‘দুধ-মা পুষছেন’– সত্যেন্দ্রর এই ভাষা কী কুৎসিত ছ্যাঁকা দেয় জ্ঞানদার কিশোরী মনে! সে কিন্তু কোনও রকম প্রতিবাদ করে না। সে গিয়ে ফেলে সত্যেন্দ্রর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা এই ভাষা!
–কেন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা তাদের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারে না? কেন বাবামশায়ের এই নিষেধ? আমাদের এই বাড়িতে আঁতুড় খালি যায় না। আর সারি সারি দুধ-মাও রাখা হয়েছে সদ্যজাতদের জন্য? কিন্তু কেন?
–সেইখানেই তো বাবামশায়ের মহত্ত্ব! এবং এই মহিমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুধ-মাদের বেদনাদায়ক কাজটির মহিমা!
–এনলাইটেন মি। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না সত্যেন! এই প্রথম স্বামী সত্যেন্দ্রকে ‘সত্যেন’ ডেকে ফেলল জ্ঞানদা।
সত্যেন্দ্র এতটুকু রেগে গেল না। বলল, ক্যারি অন ডারলিং। তুমি আমাকে আড়ালে ‘সত্যেন’ বলতেই পারো। সত্যেন্দ্র জানলেন না, জানবেন না, কোনও দিন, জ্ঞানদার মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, ‘কিচ্ছু বুঝতে পারছি না নতুন।’
একেবারে শেষ মুহূর্তে স্টিয়ারিংয়ে মোক্ষম মোচড় দিয়ে, অ্যাকসিডেন্ট বাঁচিয়েছে জ্ঞানদা!
–বাবামশায়ের বদ্ধমূল ধারণা, বাচ্চাদের দুধ খাওয়ালে মেয়েদের বুকের ডৌল নষ্ট হয়। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বুক যেন না অকালে ‘স্যাগ’ করে যায়, সেই মহৎ কারণেই দুধ-মায়েদের পুষছেন বাবামশায়।
ক্লিয়ার? সত্যেন্দ্র হাসে। এবং হাত রাখে আকস্মিক জ্ঞানদার বুকে। সত্যেন্দ্র চিৎ হয়ে শুয়ে। জ্ঞানদা সত্যেন্দ্রর বুকের উপর ঝুলে। সত্যেন্দ্র ঈষৎ মোচড় দেয় জ্ঞানদার স্তনে।
–জ্ঞানু, আমি তোমার মাতৃত্বকে কোনওভাবে অপমান করব না। নো-ওয়েটনার্স ফর ইউ। তুমি তোমার বাচ্চাকে নিজের বুকের দুধই খাওয়াবে।
–তার মানে আমার বুকের বারোটা বাজলে তোমার কিচ্ছু এসে যায় না, তাই তো? হাসে জ্ঞানদা।
–জ্ঞানু, তোমার বাংলার মাস্টারমশাইটি কে?
–আমার সমস্ত ভাষার মাস্টারমশাই একজনই। তুমি ঠিকই ভেবেছ, জ্ঞানদা নিজের বুকের দিকে তাকায়। তার বৃন্ত দু’টি থেকে ডাগর হয়ে ফুটে থাকার তাগিদ সত্যেন্দ্র ঘরে ঢোকার পর থেকেই মরে গেছে! শিরদাঁড়া দিয়ে হিলহিলে সাপটা নেমে গিয়ে কখন নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে গর্তের মধ্যে! কেন এমন হল? সত্যেন্দ্রই বা হঠাৎ বম্বে থেকে কলকাতায় কতদিনের জন্য?
(চলবে)