Robbar

অজানা জগৎ ঘিরে যে মুগ্ধতা, বন্দনা সিংয়ের কল্পবিজ্ঞানের সেটাই চালিকাশক্তি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 29, 2024 5:29 pm
  • Updated:May 29, 2024 9:02 pm  

বন্দনার ইংরেজি মূল লেখাগুলি থেকে বোঝা যায়, কাব্য আর গদ্যের সূক্ষ্ম ভেদরেখা ভেঙে দিচ্ছেন তিনি। বোঝা যায়, কল্পনাকে দূর অব্দি টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁর, আবার বাস্তবের কঠোর কদর্য দিকগুলির সঙ্গেও তিনি যুক্ত। তাই ভারতের কয়লা খাদানের ভয়াবহ বিবরণ তাঁর কলমে অনায়াসে উঠে আসে, রূপকথা উপকথার ঢঙে রচিত অসংখ্য সম্পূর্ণ স্বকপোলকল্পিত চরিত্র আর উপাদানের পাশাপাশি। নিজে তিনি আধুনিক ‘লোককথা’ সৃষ্টি করতে থাকেন অনবরত, যেভাবে মাকড়শা শূন্য থেকে জাল বুনে তোলে, নিজের অন্তঃনিসৃত লালারস দিয়ে।

যশোধরা রায়চৌধুরী

১৬.

ভারতীয়, জীবিত ও জায়মান কল্পবিজ্ঞান তথা ফ্যান্টাসি ও স্পেকুলেটিভ ফিকশন লেখকদের মধ্যে ভারতীয় বন্দনা সিং এক উল্লেখযোগ্য নাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক বন্দনার ঝুলিতে অজস্র পুরস্কার, মেনশন, লংলিস্ট ও শর্টলিস্ট। নানা আন্তর্জাতিক সংকলনে তাঁর ছোটগল্প স্থান পায়। বিদেশের নানা পত্রিকা ও সংস্থার কল্পকাহিনির পুরস্কারের মঞ্চে বারবার তাঁর লেখা উল্লিখিত হয়, আলোচিত হয়। তাঁর অকপট কথোপকথন যদি শোনা যায়, তিনি বারবার বলেন কল্পনাশক্তির গুরুত্বের কথা। লিটারেচার উইথ ক্যাপিটাল এল (সেই বিখ্যাত সংবাদপত্রের উক্তি: ‘science fiction can’t be the literature, with capital L’) না হতে পারার দুঃখ, ফ্যান্টাসি ও স্পেকুফিক লেখকদের থেকেই যায়, বালখিল্য কার্যক্রম বলে তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হবে, এ কথাও বলা হয়। কিন্তু এই লার্জার দ্যান লাইফ বা বাস্তবের থেকে বড় করে অতিবাস্তবতা রচনা করার গুরুত্ব, এর পেছনে রয়েছে যে দর্শন, তা নিয়ে বারবার কথা বলেছেন বন্দনা। সেই কারণেই বন্দনার উপন্যাসের নামকরণ হয় ‘আকাশগঙ্গার মুলুকের তিনটি গল্প: তারার থেকে তারায় ঘুরে বেড়ানোর যুগের উপকথা’, বা ছোটগল্পের শীর্ষক হয়– ‘যে মেয়েটি নিজেকে গ্রহ ভেবেছিল’ বা ‘টেট্রাহেড্রন’, অথবা ‘ক্ষুধা’ বা ‘তৃষ্ণা’।

Vandana Singh's short stories imagine what seems impossible in an age of greed and climate change
বন্দনা সিং

বন্দনার ইংরেজি মূল লেখাগুলি থেকে বোঝা যায়, কাব্য আর গদ্যের সূক্ষ্ম ভেদরেখা ভেঙে দিচ্ছেন তিনি। বোঝা যায়, কল্পনাকে দূর অব্দি টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁর, আবার বাস্তবের কঠোর কদর্য দিকগুলির সঙ্গেও তিনি যুক্ত। তাই ভারতের কয়লা খাদানের ভয়াবহ বিবরণ তাঁর কলমে অনায়াসে উঠে আসে, রূপকথা উপকথার ঢঙে রচিত অসংখ্য সম্পূর্ণ স্বকপোলকল্পিত চরিত্র আর উপাদানের পাশাপাশি। নিজে তিনি আধুনিক ‘লোককথা’ সৃষ্টি করতে থাকেন অনবরত, যেভাবে মাকড়শা শূন্য থেকে জাল বুনে তোলে, নিজের অন্তঃনিসৃত লালারস দিয়ে।

দিল্লিতে বড় হয়েছেন বন্দনা। ব্যস্ত শিক্ষকতার চাকরির মাঝে নিজের ‘অনুপস্থিত ফাঁকা সময়ে’ লেখেন, এইরকম রসিকতা করতেই পারেন, ব্ল্যাকহোলকে কল্পনা করার ক্ষমতাসম্পন্ন এই পদার্থবিদ। নিউটোনিয়ান পদার্থবিদ্যাকে লেজারবুকের মত রসকষহীন, শুধুই গণিতে গাঁথা, বোরিং বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়, এ-কথা তিনি মানেন, কিন্তু এর থেকেও পলায়নের পথ তিনি নির্দেশ করতে পারেন। এর বাইরেও পদার্থবিদ্যার বিস্তৃত ক্ষেত্র আছে, যা বন্দনার আগ্রহের বিষয়। আর তারও বাইরে আছে এক সুবিশাল হাইপোথেসিসের পৃথিবী। যুক্তিগ্রাহ্যতার পৃথিবীর বাইরে যে সম্ভাবনার পৃথিবী তার পথেই তাঁর অভিযাত্রা।

Ambiguity Machines: and Other stories: Singh, Vandana: 9781618731432: Books - Amazon.ca
ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

তিনি অকপটে জানান, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন দুটিকেই ব্যবহার করেন তিনি তাঁর লেখায়। রসিকতা করে জানান, আমার নয়, আমি আমার মেয়ের স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নকেই গল্পে লাগিয়ে দিই। ওরগুলো আমার চেয়ে ভালো হয় যে!

বস্তুত, অবচেতন থেকে উঠে আসা অন্ধতাময় উপাদানকে ব্যবহার করেন তিনি তাঁর লেখায়, অকাতরেই। নিজের গল্প কোনদিকে যাবে তিনি নিজেই জানেন না, এবং নিজের কেন্দ্রীয় চরিত্রের পাশাপাশি লেখক তাই নিজেও অন্ধের মত হাতড়াতে হাতড়াতেই পথ চলেন। তিনি বলেন মনের গোপন ভাঁড়ারে, জীবন থেকে গৃহীত উপাদান যখন মদের মত ফেনিল হয়ে ওঠে, তখনই রিয়াল থেকে ফিকশনাল-এর দিকে তার যাত্রা ঘটে। আর সেটাই হল লেখার মুহূর্ত।

‘টেট্রাহেড্রন’ গল্পটি লেখা হয়েছে ব্যাখ্যাতীতকে নিয়ে। যা কিছু ব্যাখ্যার অতীত, তা স্পেকুফিকের গভীর উপাদান হিসেবেই তিনি গণ্য করেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবেও তাঁর বোধ এই-ই, যে মানুষ যতখানিই জেনে উঠতে পারছে, ততখানিই বুঝতে পারছে আরও অনেকখানি অজানা, অজ্ঞেয়। এই ক্ষুদ্রতাবোধ, অজ্ঞেয় জগতের দিকে বিস্ময়ে তাকানোর দৃষ্টি– বন্দনার কাছে এটাই চালিকাশক্তি।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

ব্যস্ত শিক্ষকতার চাকরির মাঝে নিজের ‘অনুপস্থিত ফাঁকা সময়ে’ লেখেন, এইরকম রসিকতা করতেই পারেন, ব্ল্যাকহোলকে কল্পনা করার ক্ষমতাসম্পন্ন এই পদার্থবিদ। নিউটোনিয়ান পদার্থবিদ্যাকে লেজারবুকের মত রসকষহীন, শুধুই গণিতে গাঁথা, বোরিং বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়, এ-কথা তিনি মানেন, কিন্তু এর থেকেও পলায়নের পথ তিনি নির্দেশ করতে পারেন। এর বাইরেও পদার্থবিদ্যার বিস্তৃত ক্ষেত্র আছে, যা বন্দনার আগ্রহের বিষয়।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

Woman who thought She was a Planet by Vandana Singh | Goodreads
ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

পড়া যাক তাঁর লেখা থেকে অল্প খানিক:

একদম গোড়ার দিকে, গাছেরা নড়তে-চড়তে আর কথা বলতে পারত। তারা মাটির থেকে তাদের বেঁটে, মোটা শিকড়গুলোকে টেনে তুলত আর রোজ সকালে হাঁটতে হাঁটতে নদীর দিকে যেত। নদীর জলে শিকড় ডুবিয়ে দিত আর প্রাণভরে জল খেত। তখন পাথররাও চলতে পারত, কথাও বলত। তারা গড়িয়ে গড়িয়ে এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যেত আর গাছেদের সঙ্গে, অন্য পাথরদের সঙ্গে গল্পগুজব করত।

গাছেদের ভাঙা-ভাঙা ফিসফিসানি আর পাথরদের নিচু, কর্কশ স্বরে পৃথিবী ভরে থাকত– সব কিছু ভালোই চলছিল।

মাঝে মাঝেই একটা গাছ একটা পাথরের প্রেমে পড়ত আর পাথরটাও গাছের– তারা তখন বিয়ে করত। তাদের ছানাপোনারা হত সবুজ রঙের, মোলায়েম চামড়ার, চার হাত-পাওয়ালা আর শিকড়ছাড়া। তাদের দেহে কচি, সবুজ অঙ্কুরের নমনীয়তা, ভেতরে পাথরের মতো কঠিন কাঠামো।

এইসব শিকড়ছাড়া, হালকা হাত-পা-র বাচ্চারা খুব তাড়াতাড়ি চলতে পারত। তারা খুব তাড়াতাড়িই চারপাশের পৃথিবীকে চিনতে বের হল। পাথররা তাদের জন্য যে জলের নালা তৈরি করে দিয়েছিল, সেখানে তারা স্নান করত আর গাছের থেকে ফল পেড়ে খেত।

প্রথমদিকের ছেলেপুলেদের মধ্যে আঙ্গুদ ছিল একজন, সে সবসময় অন্যদের থেকে আলাদা থাকত। সে যখন খুব ছোট ছিল, তখন তার এক দাদা তাকে ওপর থেকে ফেলে দিয়েছিল– তাই সে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। সে কেবল পাথর ও গাছের ধীরগতির সঙ্গেই তাল মেলাতে পারে। সে সারাদিন পাথর ও গাছেদের সঙ্গে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে বেড়াত, তাদের গল্প শোনাত, বাঁশি বাজিয়ে তাদের গানও শোনাত। এর বদলে তারা তাকে লুকিয়ে রাখত, অন্য বাচ্চাদের পেছনে লাগার হাত থেকে তাকে রক্ষা করত। বড় হয়ে ওঠার পরে, সে পাথর ও গাছ দুইয়ের সঙ্গেই মিলিত হয়েছিল, আর অধীর আগ্রহে নিজের সন্তানের জন্মের জন্য অপেক্ষা করছিল।

আঙ্গুদের সমসাময়িক অন্য বাচ্চারাও প্রায় এই একই সময়ে বড় হয়ে উঠল– এরা দেখল যে এরা গাছ-পাথরদের থেকে অনেক তাড়াতাড়ি চলাফেরা করতে পারে আর নতুন কিছু তৈরি করার জন্য বা কোনও কিছুকে আলাদা করার জন্য এরা নিজেদের হাত-পাগুলোকে ব্যবহার করতে পারে। এসব কারণে শীঘ্রই এরা খুব গর্বিত হয়ে উঠল– সব্বাই, শুধুমাত্র আঙ্গুদ ছাড়া।

একজন বাবা গাছ যখন তাঁর শিকড়ের সাহায্যে টলমলিয়ে হাঁটছে, তখন এরা ব্যঙ্গ করতে লাগল। একজন পাথর-মা গড়াতে গড়াতে খুব কাছে চলে এলে, এরা ভুরু কুঁচকে তাকাতে লাগল। আঙ্গুদ যখন বাবা-মা-দের হয়ে কথা বলতে এল, এরা আঙ্গুদকে মারধর করল, তার কাছ থেকে তার বাঁশি কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর এরা গাছপালা, পাথরদের চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হুকুম দিল।

প্রথমে গাছ ও পাথররা খুব রেগে গেল আর নিজেদের সন্তানদের খুব বকাবকি করল। কিন্তু সেই সন্তানরা মুখ ঘুরিয়ে নিল আর গাছ-পাথরদের থেকে দূরে চলে গেল। রয়ে গেল শুধু আঙ্গুদ। সে গাছ ও পাথরদের যতটা পারে শান্ত করতে চেষ্টা করল। কিন্তু দুঃখের ভারে তারা চলচ্ছক্তিহীন হয়ে দাঁড়িয়েই থাকল।…

আকাশগঙ্গার এই অংশটির কিছুটা পরে, লোককথাটির অন্তে এইভাবে বন্দনা মোকাবিলা করছেন:

আঙ্গুদের ভাই ও বোনেরা, সেইসব অকৃতজ্ঞ বাচ্চা, যারা দূরে চলে গিয়েছিল, তারা খুব তাড়াতাড়িই নিজেদের বাবা-মা’কে ভুলে গেল। তারা বেঁচে থাকল, নিজেদের মধ্যে মিলিত হল এবং তারা নিজেদের নতুন এক ভাষা তৈরি করে নিল। তারা গাছ-পাথর কেটে ঘর বানাল, তাদের গায়ের সবুজ আভা মিলিয়ে গেল– সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের উৎসও ভুলে গেল।

কিন্তু গাছ ও পাথরের সেসব কথা এখনও মনে আছে, এমনকী ঘুমের মধ্যেও তাদের সে কথা মনে পড়ে। তাদের স্মৃতি আগের মতো ততটা স্পষ্ট নয়, পুরোনো দুঃখের ধারও কমে গেছে। শুধু, যখন সেই অকৃতজ্ঞ সন্তানদের বংশধররা দড়ি, কুড়োল নিয়ে জঙ্গলে আসে, তখন তারা কখনও কখনও গাছেদের মধ্যে একটা মিষ্টি ও আবছা বাঁশির সুর শোনে। কাউকেই দেখতে পায় না তারা, এমনকী তাদের গল্পগাথার আঙ্গুদকা ভাইবোনদেরও না, তারা বিস্ময়ে, ভয়ে কাঁপতে থাকে।

(চলবে)

…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১৫। মানুষ খুন না করেও যুদ্ধে জেতা সম্ভব, দেখিয়েছে এলিজাবেথ বেয়ারের কল্পবিজ্ঞান

পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা

পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?

পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান

পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?

পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও

পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?

পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে

পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে

পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য

পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!

পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা

পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?

পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ

পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই