সেবন্তী ঘোষের গল্প ‘শ্লোক’-এ নতুন হল, প্রজননক্ষমতা হ্রাস পাওয়াটাকে তিনি পরিবেশ নষ্ট হওয়ার একটা ফল হিসেবে দেখানো। উল্টোদিকে সমাজ রাজনীতির নিয়মকানুনে জনসংখ্যা রোধে একটির বেশি সন্তান নেওয়া যাবে না, এই কনস্ট্রাক্টকেও সফলভাবে ব্যবহার করেন। এবার একটি নারী এর ভেতরেই ভাবছে একটি সন্তান নেওয়ার কথা। একটি সন্তান, যে আর্টফিশিয়াল বা অজৈবিক বা আনবায়োলজিকাল ভাবে জন্ম নিচ্ছে এক ভবিষ্যতের পৃথিবীতে। মার্গারেট অ্যাটউড বলেছিলেন, ‘দ্য ডেভিল ইজ ইন দ্য ডিটেইল’। কথাটি হাড়েহাড়ে টের পাওয়া যায় স্পেকুফিক লেখার সময়ে। প্রায় প্রতিটি বিমূর্ত আইডিয়াকে রূপ দিতে হয় বাস্তবের মতো করে।
১৭.
নারী, নারীশরীর, প্রজনন– এই সবগুলো বিষয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ২০০০ পরবর্তী নারী কল্পবিজ্ঞান লেখকদের কাছে। কারণ, এই বিষয়ে স্পেকুলেটিভ ফিকশন লিখতে গেলে, বর্তমান সময়ের এক্সটেনশন হিসেবেই তাকে দেখছি আমরা। আমাদের এই সময়ে দ্রুত ঘটে যাওয়া সামাজিক পরিবর্তনগুলো ছাপ ফেলছে গল্পে। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, রাশি রাশি ধর্ষণ-খুনের ঘটনা, আইন করেও না থামাতে পারা কন্যাভ্রূণ হত্যার ঘটনা, বিবাহসংক্রান্ত জটিলতা, মেয়েদের গর্ভধারণের ক্ষেত্রে ‘আমার শরীর আমার অধিকার’-এর ভাবনাগুলোর ছায়া পড়ছে এই কল্পিত ফ্যান্টাসি জগতের ওপর। ভবিষ্যৎপৃথিবীর গল্প লিখতে গেলেই এক ঊষর, জলহীন, ছায়াহীন কঠিন পৃথিবীর কথা লিখছি সবাই, পরিবেশবাদী বৈজ্ঞানিকদের প্রতিটি ভবিষ্যৎবাণী সত্যি করে যেখানে বাস্তব পরিবেশই হয়ে উঠছে সেই ডিস্টোপিয়াধর্মী ভবিষ্যতের মতো।
‘‘গন্ধযুক্ত ফুল সেই কবেই মানুষেরা শেষ করে দিয়েছে। এখন শুধু উজ্জ্বল বর্ণের দীর্ঘ পাপড়ি বিশিষ্ট ফুল চারদিকে। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টে সিঁড়ি বা স্কাইওয়াকের পথে এসব ফুলগাছ না রাখলে বাড়ি বানাতে দেওয়া হয় না। টের পেলে বাড়ি সিল করে দেওয়া হয়। নব দেখে সিঁড়ির দু’পাশে আজ অ্যাজেলিয়ার টব সাজানো মানে দিবা বাড়ি চলে এসেছে। অ্যাপার্টমেন্টের সবাইকে পালা করে ফুলের টব সাজাতে হয়। দিবা এবারে শুধু অ্যাজেলিয়াই লাগিয়েছে। নব কাঁধে ঝুলিয়ে রাখার ছোট্ট অক্সিজেন সিলিন্ডার পিছনে ঠেলতে ঠেলতে সিঁড়ি ভাঙে।’’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘ডিম ফোটার চারদিন পর ভ্রূণ চলে চলে এলো গোলাকার থলির মতো শোয়ার ঘরে। চতুর্থ সপ্তাহে ফুটে উঠল মাথার বৈশিষ্ট্য ও মস্তিষ্ক হৃদপিণ্ড ও ফুসফুস। ক্লিনিক বলেছিল, পূর্ণাঙ্গ অবয়ব পেয়ে গেলে ম্যাচিওরিটির সময়টা দ্বিগুণ করে দেবে। কিন্তু তার আগে গোল বাঁধল অঙ্গ পছন্দের সময়। ঠোঁট পছন্দ করতে হবে। স্ক্রিন জুড়ে অপশন বাটন থেকে নানা ধরনের ঠোঁট নেমে এল।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এইভাবে শুরু হচ্ছে সেবন্তী ঘোষের গল্প ‘শ্লোক’। এই একই ধরনের ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং প্রায় সব স্পেকুলেটিভ ফিকশনের পথেই চলেছে। এখানে সেবন্তীর কলমে নতুন যা, তা হল, প্রজননক্ষমতা হ্রাস পাওয়াটাকে তিনি পরিবেশ নষ্ট হওয়ার একটা ফল হিসেবে দেখান। উল্টোদিকে সমাজ রাজনীতির নিয়মকানুনে জনসংখ্যা রোধে একটির বেশি সন্তান নেওয়া যাবে না, এই কনস্ট্রাক্টকেও সফলভাবে ব্যবহার করেন। এবার একটি নারী এর ভেতরেই ভাবছে একটি সন্তান নেওয়ার কথা। একটি সন্তান, যে আর্টফিশিয়াল বা অজৈবিক বা আনবায়োলজিকাল ভাবে জন্ম নিচ্ছে এক ভবিষ্যতের পৃথিবীতে। এক নারী লেখকের চোখ এখানেই এসে জোটে লেখার ভেতর। নিজের শরীরী অভিজ্ঞতার ঝলক শুধু না, নারীকে মাতৃত্বে এসেনশিয়ালাইজ করার দুর্মদ সামাজিক প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আঁচও এসে জোটে। আর সেজন্যেই নারীর লিখিত কল্পবিজ্ঞান ভাঁজ খুলে পড়ে নেওয়া এত জরুরি।
‘সন্তান অবশ্যই আনন্দের, কিন্তু তখনই ,যখন সে মায়ের ইচ্ছায় আসছে। গর্ভভাড়া আমরা প্রথম থেকেই বিবেচনায় রাখিনি। ওই এক বছর ধরে বাচ্চা বহন করা আর তারপর টাকা দিয়ে কেনাবেচায় মাতৃত্বের অধিকার ও ইচ্ছাকে খুন করা হয়। একটা সময় মেয়েরা সমাজের চাপে সন্তান ধারণ করত, অকারণে মাতৃত্বকে মর্যাদার, গৌরবের মনে করত। ওসব প্রিমিটিভ ধারণা যে কোথাও নেই তা নয়। তবে ভারতে এসব চলে না। তুই তোর ইচ্ছে মতো বাচ্চা চাইবি, আমি বলার কে?’
মার্গারেট অ্যাটউড বলেছিলেন, ‘দ্য ডেভিল ইজ ইন দ্য ডিটেইল’। কথাটি হাড়েহাড়ে টের পাওয়া যায় স্পেকুফিক লেখার সময়ে। প্রায় প্রতিটি বিমূর্ত আইডিয়াকে রূপ দিতে হয় বাস্তবের মতো করে। এক বিকল্প বাস্তব তৈরি করতে হয়। সেবন্তী সফলভাবে আমাদের বর্তমানের মেনু ড্রিভেন জীবনের সমান্তরালে বানিয়েছেন এই কৃত্রিম সন্তান তৈরির প্রক্রিয়াটি।
‘ডিম ফোটার চারদিন পর ভ্রূণ চলে চলে এলো গোলাকার থলির মতো শোয়ার ঘরে। চতুর্থ সপ্তাহে ফুটে উঠল মাথার বৈশিষ্ট্য ও মস্তিষ্ক হৃদপিণ্ড ও ফুসফুস। ক্লিনিক বলেছিল, পূর্ণাঙ্গ অবয়ব পেয়ে গেলে ম্যাচিওরিটির সময়টা দ্বিগুণ করে দেবে। কিন্তু তার আগে গোল বাঁধল অঙ্গ পছন্দের সময়। ঠোঁট পছন্দ করতে হবে। স্ক্রিন জুড়ে অপশন বাটন থেকে নানা ধরনের ঠোঁট নেমে এল। উল্টানো, কাঁদুনে, পাতলা এমনকী, ছুরির মতো তীক্ষ্ণ। দিবা সরু ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াতেই নব তার হাত সরিয়ে ঈষৎ ভারী ঠোঁটে হাত রাখল। বলল, তোর মতো পাতলা ঠোঁট চলবে না, ঝগড়ুটে হবে !’
এই গল্পের পরিণতিতে, প্যাকেজ দিয়ে কেনা কৃত্রিমভাবে তৈরি শিশু, যার সব জিনগত সিলেকশনও প্যাকেজের রেট অনুযায়ী করা যায়, তাকে দেখে তার মায়ের প্রতিক্রিয়া এই কাব্যিকভাবে প্রেজেন্ট করেন লেখক:
‘‘ঘুমের মাঝে উসখুস করে বাচ্চাটা। ঠোঁটদু’টি একত্র করে চোখ বুজে খাবার খোঁজে। দিবার আঙ্গুল টেনে মুখের মধ্যে নেওয়ার চেষ্টায় শরীরটা প্রি-হিস্টরিক ধনুকের মতো বাঁকায়। দিবা অনুভব করে তার স্তনের উপর যেন অসহ্য চাপ তৈরি হচ্ছে। ভারী ও স্তব্ধ ঝঞ্ঝার প্রাক মুহূর্তে পৃথিবী যেমন অপেক্ষা করে সে আঘাত বেদনাকে ধারণ করার জন্য, তেমনি ভাবে কোষগুলি যেন ফেটে ফুলে উঠেছে।’’
উল্টোদিকে, ‘পাল্টা’ নামের একটি গল্পে, অনুরাধা কুন্ডা লেখেন এক পৃথিবীর গল্প, যেখান থেকে ভ্রূণহত্যা ও বিশেষভাবে তৈরি পুরুষভ্রূণের দিকে ঝোঁক দেওয়ার ফলে একটা গোটা সমাজ নারীহীন হয়ে গিয়েছে।
‘একটা বিশেষ রকমের কাচের জার। গোলাকৃতি। লম্বাটে গলা। অর্ধেক এক ধরনের প্রিজার্ভেটিভ ফ্লুয়িডে ভরতি। হালকা সবুজ। ঠাহর করে দেখলে বোঝা যায়, সব ক-টি কাচের জারের মধ্যে রয়েছে একটি করে ভ্রূণ। কোনওটিই মৃত নয়। তরলের মধ্যে ভাসমান ওই হালকা সবুজ রঙের একটি করে ডিম্বাশয়। ভ্রূণগুলি ওই কৃত্রিম ডিম্বাশয়ের মধ্যে চমৎকার বেড়ে উঠছে। তাপমাত্রা অবিকল মানবদেহের এবং অন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলিও। তাই ভ্রূণগুলির কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। অনেকের নাক-চোখ বোঝা যাচ্ছে। ল্যাবরেটরিতে সারি সারি ভ্রূণের দিকে তাকিয়ে খুব পরিতৃপ্তির হাসি হাসলেন ড. মিত্র।
এরা সবাই পুরুষ ভ্রূণ।
তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী এ দেশে প্রতি ছয় মাস অন্তর দুশো পুং ভ্রূণ জন্মগ্রহণ করে। সব পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণাধীন।
এ দেশে কোনও নারী নেই। এই প্রজন্মের পুরুষরা নারী চোখেও দেখেনি। ডাক্তার ও তাঁর সমসাময়িকদের মনে ক্ষীণ নারী-স্মৃতি আছে বটে, কিন্তু তাঁরা কাজে, সাফল্যে, বৈভবে এবং আনন্দে এত বেশি মগ্ন ও মত্ত যে সেই স্মৃতি অচিরেই মুছে যাবে।’
এই সমাজ আর্টিফিশিয়াল ডিম্বাশয় দিয়ে কাজ চালায়। গবেষক গবেষণা করে, কীভাবে জরায়ু ছাড়াই সন্তানের জন্ম হতে পারে।
‘ড. মিত্র খুব ভালো মুডে আছেন। গবেষণার এমন একটা ধাপ এসে গেছে যখন আর ভ্রূণ রক্ষা করার জন্য জরায়ুর প্রয়োজন হবে না।’
এই নারীহীন সমাজে বিপুল শ্লেষ নিয়ে নেমে আসে অনুরাধা কুন্ডার কলম। একটা চড় মারার জন্য হাত নিশপিশ করছে গল্পের নায়কের। কিন্তু রোবটদের ২০টির বেশি চড় মারা অনুমোদিত নয়। কাজেই সে খুঁজছে, শরীরী হিংসা কার ওপরে করা যেতে পারে… ভেতরের উদগ্র হিংস্রতাকে কোন পথে বের করে দেওয়া যায়। বিপরীত লিঙ্গের অভাবে হিংসাকে বের করে না দিতে পারার ফলে ছেলেটি ছটফট করে। সে গল্পে পড়েছে, আলুসেদ্ধতে নুন কম দেওয়ার জন্য একজন তার স্ত্রীকে চড় মেরেছিল। সেই থেকে তার ভেতরে কাজ করছে চড় মারার অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছা, দুর্মদ কামনা।
শরীরী হিংসা, যৌনহিংসা বিহীন এক সমাজ, আজ অবধি নেই। অনুরাধা চমৎকারভাবে গল্পটি শেষ করেন।
‘পেছনে কার পায়ের শব্দ? তাঁকে ফলো করছে কেউ? পেছন ফেরার আগে কে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপর। নিমেষে টেনে নিয়ে গেল ঝোপে। কিল। চড়। লাথি। মুখ বেঁধে ফেলেছে তাঁর। পোশাক ছিঁড়ছে হিংস্র হাতে। জ্ঞান হারাতে হারাতে পুলকেশের প্রতিহিংসা-মাখা মুখটা দেখতে পেলেন ড. মিত্র।
জেলে ধর্ষক ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এক ধর্ষিত বাবা। দুজনেই চুপ।
অনেকক্ষণ পর নিষাদ কথা বলল।
বলল, আমি বুঝতে পেরেছি, বাবা। আমি শুধু ডমিনেট করতে চেয়েছিলাম।
উপরোক্ত দু’টি গল্প পড়া যাবে সম্প্রতি প্রকাশিত দু’টি সংকলনে। বই দু’টি নারীকল্পবিজ্ঞানের। একটির নাম ‘প্রমীলাকলমে কল্পবিজ্ঞান’, অন্যটি ‘কঙ্কাবতী কল্পবিজ্ঞান লেখেনি’।
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৬। অজানা জগৎ ঘিরে যে মুগ্ধতা, বন্দনা সিংয়ের কল্পবিজ্ঞানের সেটাই চালিকাশক্তি
পর্ব ১৫। মানুষ খুন না করেও যুদ্ধে জেতা সম্ভব, দেখিয়েছে এলিজাবেথ বেয়ারের কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই