কৃষ্ণের অষ্টশত নামের মতো সাংবাদিকদের অগণিত ‘বিট’ থাকে। ক্রীড়া সাংবাদিকদেরও। তাতে কাজ ভাগাভাগি করতে সুবিধে হয়। আমার তখন এ পেশায় বছর চারেক হয়েছে। গৌতমদা (তৎকালীন আনন্দবাজার-এর ক্রীড়া সম্পাদক গৌতম ভট্টাচার্য) ডেকে পরিষ্কার বলেছিলেন, রাজর্ষি তোমার ‘বিট’ সিএবি ও বাংলা ক্রিকেট। খবর মিস হলে দায় এক এবং একমাত্র তোমার।
আলাপন সাহাকে আমি এককালে ঘোর অপছন্দ করতাম। আলাপন তখনও আমার ভাই হয়ে ওঠেনি।
সে অনেক বছর আগের কথা। ২০১১ কিংবা ২০১২। ঠিক মনে পড়ে না আজ। কৃষ্ণের অষ্টশত নামের মতো সাংবাদিকদের অগণিত ‘বিট’ থাকে। ক্রীড়া সাংবাদিকদেরও। তাতে কাজ ভাগাভাগি করতে সুবিধে হয়। আমার তখন এ পেশায় বছর চারেক হয়েছে। গৌতমদা (তৎকালীন আনন্দবাজার-এর ক্রীড়া সম্পাদক গৌতম ভট্টাচার্য) ডেকে পরিষ্কার বলেছিলেন, রাজর্ষি তোমার ‘বিট’ সিএবি ও বাংলা ক্রিকেট। খবর মিস হলে দায় এক এবং একমাত্র তোমার। দুপুর-দুপুর বেরিয়ে, এ মাঠ-সে মাঠ ঘুরে, ময়দানের লোকজনের সঙ্গে যথেচ্ছ হ্যা-হ্যা-হি-হি করে বিকেলের দিকে সিএবি ঢুকে পড়াই তখন ছিল আমার নিত্যকর্ম পদ্ধতি। সেই সময় সিএবির হর্তাকর্তা ছিলেন বিশ্বরূপ দে। বর্তমানে ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ভদ্রলোক অত্যন্ত স্নেহ করতেন আমায়, প্রচুর খবর দিতেন। তা, এক বিকেলে বিশ্বরূপদা’র ঘরে বসে ঠ্যাং দুলিয়ে রাজা-উজির মারার ফাঁকেই আমার আলাপন-আবিষ্কার!
প্রথম দর্শনে মন্দ লাগেনি। ফিনফিনে, লিকলিকে, এক তালপাতার সেপাই। বাচ্চাদের মতো মুখ। ব্রহ্মতালুর ডগা বেয়ে আবার একখানা চুল তেজস্বী শিখার মতো আকাশপানে চেয়ে আছে! চোখাচোখি হতে ফিচেল হাসি দিয়ে বলল, “আমার নাম আলাপন। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ জয়েন করেছি। তুমিই রাজর্ষিদা?”
এত পর্যন্ত ঠিক ছিল। গোলযোগ বাঁধল পরে। এ ছোকরার সামনে বিশ্বরূপদাকে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না বুঝে ‘আসছি’ বলে বেরিয়ে গেলাম। ঢুকলাম আর এক কর্তা সুবীর (বাবলু) গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘরে। দেখলাম, পিছু-পিছু আলাপন হাজির! বাবলুদার ঘর থেকে বেরিয়ে বুবুদা’র (চিত্রক মিত্র) ঘরের দিকে এগোতে গেলাম। ও হরি, দেখি ব্যাটাচ্ছেলে আবার পিছু-পিছু আসে! মিনমিনে চোখমুখ নিয়ে। দ্রুত বুঝে গেলাম, এ অলপ্পেয়ে হল ‘মার্কার’! যেখানে-যেখানে আমি যাব, এঁটুলির মতো গায়ে সেঁটে থাকবে! সবে পেশায় এসেছে। ‘সোর্স’ এখনও তৈরি হয়নি। কিন্তু খবর মিস করলে ওরও চলবে না। তাই সর্বক্ষণ ‘ছায়াসঙ্গী’ হয়ে ঘুরবে আমার। ভাবতেই মেজাজ-মন বিগড়ে গেল!
মন! মনের চেয়ে বড় মায়া, মনের চেয়ে বড় আকর্ষণ বোধহয় এ পৃথিবীতে আর দু’টি নেই। যার কাছে পাঁচ গোল খায় ঈর্ষা। দশ উইকেটে হারে পেশাগত বিরোধ। মিথ্যে বলব না। তারপরেও আলাপনকে সজ্ঞানে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছি। কারণ, ও জন্মগত সাংবাদিক। খবরের পিছনে দৌড়নো ওর নেশা। মজ্জায় খবর করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জন্মায় যারা, প্রথম প্রথম তারা গোল বাঁচানোর চেষ্টা করে। তারপর ধাতস্থ হয়ে গোল করতে বেরোয়। আলাপন অবিকল তাই। সাম্প্রতিক সময়ে ওর সেরা খবর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বায়োপিক। দিনের পর দিন, মাসের পর মাসের পর মাস, রোদ-ঝড়-জল উপেক্ষা করে বেহালায় পড়ে না থাকলে যা হত না। ভেবে দেখেছিলাম, এ হেন ‘বডিগার্ড’-এর সঙ্গে জেতার একমাত্র রাস্তা হল যুদ্ধ-সন্ধি। তাই পরে আগাম ডেকে ওকে বলে দিতাম, ‘শোন আলা অমুক খবরটা আমি পেয়েছি। তুই করবি না। আর তুই যেটা পাবি, আমি করব না।’
আলাপন ছোঁয়ওনি। খেলা কভার করতে গিয়ে বহুবার দু’জন দুই কাগজের প্রতিনিধি হয়ে এক ঘরে থেকেছি। ওর লেখা দেখে দিয়েছি। খবর সংক্রান্ত কথাবার্তা ওর সামনে বলেছি। কিন্তু পারস্পরিক বিশ্বাসের সেতু আলাপন কখনও ভাঙেনি। তা ছাড়া যে ছেলে নিজের জীবন, নিজের কাজ ফেলে পেশাগত দাদার (আমার কথাই বলছি) বাড়ির কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে রাত্তির একটায় এসে উপস্থিত হয়, তার সঙ্গে আর যা-ই হোক, খবর নিয়ে রেষারেষি চলে না। মানবিকতার পাশে ক্ষুদ্র জাগতিক মোহ আর কতটুকু? এমনিতে ব্যাটা পাজির পা-ঝাড়া। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে তিনশো ষাট দিন গণ্ডা-গণ্ডা মিথ্যে বলে টো-টো করে বেড়ায়। একদিন কাজ করলে, বুট নাচিয়ে বলে দেয় ‘কাল থেকে পনেরো দিন কাজ করব না।’ কিন্তু তারপরেও ওর সাতখুন মাফ, দিন শেষে আলাপনকে জিতিয়ে দেয় ওর মানস সরোবরের মতো নিষ্কলঙ্ক মন।
যেমন দেয় ‘আজকাল’-এর অগ্নিদাকে (অগ্নি পাণ্ডে)। যেমন দেয় ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’-এর অরিন্দমদাকে (অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়)। কিংবা বর্তমানে ‘স্টার স্পোর্টস’-এ কর্মরত বৈদূর্য বোসকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মজ্জায় খবর করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জন্মায় যারা, প্রথম প্রথম তারা গোল বাঁচানোর চেষ্টা করে। তারপর ধাতস্থ হয়ে গোল করতে বেরোয়। আলাপন অবিকল তাই। সাম্প্রতিক সময়ে ওর সেরা খবর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বায়োপিক। দিনের পর দিন, মাসের পর মাসের পর মাস, রোদ-ঝড়-জল উপেক্ষা করে বেহালায় পড়ে না থাকলে যা হত না। ভেবে দেখেছিলাম, এ হেন ‘বডিগার্ড’-এর সঙ্গে জেতার একমাত্র রাস্তা হল যুদ্ধ-সন্ধি। তাই পরে আগাম ডেকে ওকে বলে দিতাম, ‘শোন আলা অমুক খবরটা আমি পেয়েছি। তুই করবি না। আর তুই যেটা পাবি, আমি করব না।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সাংবাদিক পরিচয় বাদ দিলে অগ্নিদা, আলাপন, রাতুলের (বৈদূর্যর ডাকনাম, যে নামে আমাদের কাছে ও পরিচিত, এক সময় ভয়ানক রিপোর্টার ছিল) মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল ময়দানি খিস্তিতে! সময়-সময় মনে হয়, খিস্তি যদি শিল্প হত, এ তিনজন তার টাটা-বিড়লা-আম্বানি না হয়ে যেত না (অরিন্দমদা অতটা পারত না, বড়জোর কুটিরশিল্প গড়ত)! আহা, কী শ্রুতিমধুর সব শব্দ, কী অনিন্দ্যসুন্দর সুরে তা ভেসে বেড়ায়! মিঁয়া তানসেনও বোধহয় তার সামনে হার মানবেন! খিস্তি-খেউড় আমিও করি। কিন্তু এরা এক-একজন প্রাতঃস্মরণীয় প্রতিভা! আমার বিয়ের সময় গাড়িতে বসে রাস্তার জ্যামের বর্ণনা রাতুল যে ‘সুললিত’ গদ্যে দিয়েছিল, তা শুনে একই গাড়িতে বসা আমার পরিবারের দু’জনকে ভারি মন দিয়ে জানালার বাইরে আকাশ-বাতাস দেখতে দেখেছি! অগ্নিদা আবার গোলাগুলি বর্ষণের আগে বিপক্ষকে একবার বজ্রদৃষ্টিতে দেখে নেয়! আজ থাক। পরে একদিন বিশদে লেখা যাবে। কিন্তু এদের প্রত্যেকের শ্রেষ্ঠ সম্পদ একটাই জিনিস।
মন। মনুষ্যত্ব।
বাংলাদেশে আমার প্রথম বিদেশ সফরের সময় ভারতীয় টিমের প্রেস কনফারেন্স বাদ দিয়ে মাঠের বাইরে আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল অগ্নিদা। কী না, যদি আমার চিনতে অসুবিধা হয়! দেশে-বিদেশে খেলা কভার করতে গেলে মাঠ থেকে আমার জন্য হোটেলে খাবার বলে রাখে অগ্নিদা। লেখার চাপে আমার যদি খাওয়া না হয়। আজকালকার যুগে কে করে এমন? করার দরকারও বা কী? না করলে কিছু বলারও থাকত না। আমরা পেশাগত মিত্র মাত্র। এক কাগজের সতীর্থ নই। অথচ আজও আমাদের সুরার শ্রেষ্ঠ আসর বসে অগ্নিদার বাড়িতে। রাত বাড়লে অগ্নিদা গান ধরে। ভোর পাঁচটায় ভাত চাপায়। খেয়াল হলে তখন কখনও ‘ভাই’ বলে ডাকে। কখনও ‘সেন্ট অগাস্টিন’! কিন্তু খালি পেটে কিছুতেই থাকতে দেয় না। গোটা রাত না ঘুমিয়ে সকালে ড্রাইভ করে বাড়ি ছেড়ে আসে। রাতুল আবার সাত দিনের ছুটি এসেছিল আমার বিয়েতে। এসে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব একা হাতে করে গিয়েছে। দেখুন দেখি, কথায়-কথায় অরিন্দমদা’র কথাই লেখা হল না। বিশ্বাস করুন, অমন নির্বিবাদী মানুষ আমি দুটো দেখিনি। যার ক্রোধ নেই। ঘৃণা নেই। চাহিদা নেই। মোহ নেই। অহং নেই। যাকে মন খুলে সব বলা যায়। যাকে দেখলে মনে হয়, সাংবাদিকের বদলে সাধক হতে পারত। অরিন্দমদা আদতে রান্নায় নুনের মতো। যাকে ছাড়া আমাদের যে কোনও আড্ডা অসম্পূর্ণ।
এদের বাইরেও আছে অনেকে। আমার জীবনে প্রভাবে। সখ্যতায়। কেউ বড়। কেউ সমবয়সী। কেউ ছোট। কেউ সাংবাদিক, কেউ আজ আর সাংবাদিক নয়। আমার সহধর্মিনী প্রিয়দর্শিনী (রক্ষিত), অফিস সতীর্থ দেবাঞ্জন নন্দী, ‘আনন্দবাজার’-এর ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত, ‘এই সময়’-এর রূপক বসু, ‘নিউজ ১৮’-এর ঈরন রায়বর্মন। কিন্তু আমার মাঠের পরিবার এই জনা চার। আলাপন-অগ্নিদা-অরিন্দমদা-রাতুলই আমার বৃহত্তর পরিবার।
নাহ্, এদের কারও সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি জানি প্রয়োজন হলে, এই চার-ই আমায় সর্বপ্রথম রক্ত দেবে!
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৭: অহং-কে আমল না দেওয়া এক ‘গোল’ন্দাজ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে