দারিদ্রপীড়িত পরিবারের সন্তান দ্রোণের (জন্ম ১৯৪৮) রক্তে ছিল দ্রোহ ও কবিতা। বাংলা কবিতার অনেক একনিষ্ঠ পাঠকই মনে করেছেন, তিনি বেঁচে থাকলে আমরা বাংলাভাষায় একজন পাবলো নেরুদা বা নাজ়িম হিকমতকে পেতাম। আর প্রেম! সত্যি কথা বলতে, প্রবল প্রেমিক দ্রোণের লক্ষণীয় মিল ছিল নিরবচ্ছিন্ন প্রেমিক ভ্লাদিমির মায়াকোভ্স্কির সঙ্গে। শুরু হল শুদ্ধব্রত দেব-এর কলাম ‘কবি ও বধ্যভূমি’। আজ প্রথম পর্ব।
কবি। বাংলার বোতল মেঝেতে আছড়ে, কাগজ কুটি কুটি করে ছিঁড়ে এক ফুঁ-এ উড়িয়ে চিৎকার করে বললেন– ‘আমি রাষ্ট্রের গাঁড় মারি, পেটো মেরে উড়িয়ে দিই পার্লামেন্ট, আমি সংবিধানের মা-কে…।’ ভক্তেরা বলল, ‘উঃ! চাবুক! পুরো সাবঅলটার্নের ভাষা!’ ক্ষমাসুন্দর রাষ্ট্র খ্যা-খ্যা করে হাসল।
অন্য কোনও কবি। বেদেডাঙা গ্রামে সত্যিকারের কোনও সাবঅলটার্নের ঘরে কুপির আলোয় অস্থির চারপাশকে, নিজের অস্থিরতাকে কলমে সংহত করে মহাকালের মতো উচ্চারণ করলেন–
‘আমাদের জন্মে শুধু অবিরাম শোষণের গ্লানি:
এখন সময় নেই চপল ছায়ায় বসে গল্পের আসর
এখন সময় নেই পান করি অসহায় চরিত্রের মদ;
তীক্ষ্ণ বুলেটের মুখে বস্তুত এখন প্রয়োজন
শ্রেণীশত্রু নিধনের কঠিন কঠোর এক দৃঢ় সংগঠন।’
ক্ষমাহীন রাষ্ট্র তাঁকে মেরে ফেলল।
কবিতা লেখার জন্য, শুধুই কবিতা লেখার জন্য, আজ অবধি কোনও কবিকে মেরে ফেলা হয়নি। পৃথিবীর যে কোনও দেশেই কবিকে রাষ্ট্র তখনই ভয় পায়, যখন তাঁর একটা সক্রিয় প্রতিরোধের রাজনীতি থাকে। এবং সেই রাজনৈতিক দায়বোধ স্বৈরাচারের মাপা-বাঁধা নিয়মতন্ত্রের চোখে চোখ রাখে। পরিষ্কার, খোলা চোখ। নুহ্ ইব্রাহিম থেকে দ্রোণাচার্য ঘোষ– কেউই এর ব্যতিক্রম নন। আগ্নেয় সত্তরের দিন তখন। সেরকম একটা সকালে থানার এক কনস্টেবল তাঁর প্রতিবেশীকে বলেছিলেন– ‘গতকাল দেখলাম বটে একটা বাঘের বাচ্চাকে! একবারের জন্যও মাথাটা নোওয়াল না!’ এই ‘বাঘের বাচ্চা’ দ্রোণ আরও দু’জন কমরেডের সঙ্গে মিলে হাঁসগড়ায় অ্যাকশন করার পর পাশের ডেমরা গ্রামে ধরা পড়েছিলেন। থানায় অকথ্য অত্যাচার করে তাঁর হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, গায়ে ঢেলে দেওয়া হয়েছিল রাস্তা সারাইয়ের গরম আলকাতরা। পেটাতে পেটাতে পুলিশ অফিসার তাঁকে বলেছিল ‘বল শালা মাও সে তুঙ শুয়োরের বাচ্চা! বল চারু মজুমদার শুয়োরের বাচ্চা! বল…।’ রক্তাক্ত, ভাঙা শরীরে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে দ্রোণাচার্য কোনওরকমে উচ্চারণ করেছিলেন ‘মাও ৎসে তুঙ…’, আর বিকৃত জয়ের হাসি ফুটে উঠছিল অফিসারের মুখে। সে হাসি অবশ্য মুখেই মিলিয়ে গিয়েছিল, যখন অতি কষ্টে টেনে টেনে দ্রোণাচার্য শেষ করেছিলেন, ‘…জিন্দাবাদ! কমরেড চারু মজুমদার লাল সেলাম!’ শাসকের ক্রোধ তীব্রতর হয়ে তখন আবার আছড়ে পড়ছে তাঁর ভাঙা হাড়ের ওপর, তিনি জ্ঞান হারিয়েছিলেন।
দারিদ্রপীড়িত পরিবারের সন্তান দ্রোণের (জন্ম ১৯৪৮) রক্তে ছিল দ্রোহ ও কবিতা। বাংলা কবিতার অনেক একনিষ্ঠ পাঠকই মনে করেছেন, তিনি বেঁচে থাকলে আমরা বাংলাভাষায় একজন পাবলো নেরুদা বা নাজ়িম হিকমতকে পেতাম। আর প্রেম! সত্যি কথা বলতে, প্রবল প্রেমিক দ্রোণের লক্ষণীয় মিল ছিল নিরবচ্ছিন্ন প্রেমিক ভ্লাদিমির মায়াকোভ্স্কির সঙ্গে। ফারাকটা এখানে, লেনিনকে নিয়ে কবিতা লেখা মায়াকোভ্স্কি আর কখনও প্রত্যখ্যাত, অথবা উন্মাদপ্রায় প্রেমিক মায়াকোভ্স্কি ছিলেন দুটো সম্পূর্ণ আলাদা সেলফ। দ্রোণের কবিতায় কিন্তু বিপ্লব আর প্রেম একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে! ১৯৬৮-র ১১ সেপ্টেম্বরের ডায়েরিতে দ্রোণ লিখছেন– রাজনীতি তাঁর মজ্জায় ঢুকে গেছে, সেই আলোতে তাঁকে বদলাতে হবে তাঁর কবিতা। পেরেওছিলেন বদলাতে, নিজেকে এবং নিজের কবিতাকে। একদা যে তরুণ লিখেছিলেন, ‘…যুদ্ধ, প্রতিযুদ্ধ– সমস্তই রক্তপাতে লীন– তার স্মৃতি/ অন্ধকার গল্পের ভেতর অক্ষম শরীর রাখে–’, বিপ্লবের হাত ধরে ক্ষয়িষ্ণু একাকিত্বকে অতিক্রম করে তিনিই প্রেমিকা কৃষ্ণাকে (বন্দ্যোপাধ্যায়) লিখলেন–
‘তবে তাই হোক, ধূসর বয়স ছুঁড়ে ফেলে অবহেলে
আমার নিবিড় জীবন ক্রমশ বুকে দিও ধীরে মেলে
আলো আসে– নাই যে সময় তার, নেই আর বেশী দেরী,
এখন ঋজু সে সংগ্রাম জ্বলে তোমার স্বপ্নে প্রিয়।
তবে তাই হোক, তোমার গভীরে যাবার কালেই প্রিয়
কৃষিবিপ্লবে লড়ার জন্য মোহহীন দোলা দিও।’
১৯৬৭-তে নকশালবাড়ির কৃষক-অভ্যুত্থান আমূল বাঁকবদল ঘটিয়ে দিয়েছিল দ্রোণাচার্য ঘোষের চেতনায়। বিপ্লবের জন্য নিজের ভবঘুরে জীবন এবং ঘর– ছেড়েছিলেন তিনি, জীবনের শেষ মুহূর্তটি অবধি রয়ে গিয়েছিলেন সিপিআই(এমএল)-এর দ্বিধাহীন, অগ্রণী সৈনিক। শেষবার ধরা পড়ে দ্রোণ জেলে কোনওরকম আইনি সাহায্য নিতে অস্বীকার করেছিলেন। ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারির সাতে, সহযোদ্ধাদের সঙ্গে হুগলি জেল ব্রেক করে বেরতে গিয়ে দ্রোণ শহিদ হন। গুলি করে মারা হয়নি তাঁকে। গুপ্তি দিয়ে গেঁথে পুলিশ তাঁর শরীর এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছিল, মুখের হাড় চূর্ণ করে দিয়েছিল। অর্ধমৃত তাঁর নাভির ওপর বুট চেপে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুলিশ যখন তাঁকে পুরো মেরে ফেলছে, তখন প্রশান্ত (পান্ত)– এলাকার পরিচিত ডাকাত ও গুন্ডা, তখন ওই জেলেই যাবজ্জীবন কয়েদি ছিলেন– ছুটে এসে মরতে চলা প্রিয় বন্ধুর মাথাটা কোলে তুলে নেন। মারা যাওয়ার আগে অস্ফূটে দ্রোণাচার্য না কি তাঁকে বলেছিলেন– ‘ওই গানটা আমাকে একবার শোনাতে পারিস পান্ত? ওই যে– ভাগীরথী তুমি মেকং নদীর সীমানা ভাঙো… খবর আনো, খবর আনো…।’ পান্ত-র থেকেই কৃষ্ণা (তিনিও একই জেলে বন্দি হয়ে আসার পরে) এই ঘটনার পুরোটা জেনেছিলেন। একসময়ের এলাকার ত্রাস পান্ত তখন পুরো বদলে যাওয়া এক নতুন মানুষ– কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন। এর বেশ কিছুদিন পর ভোররাতে ব্যান্ডেল চার্চের সামনে জেল-পুলিশ গুলি করে পান্ত-কে মেরে ফেলেছিল, এবং রটিয়েছিল, জেল-সংঘর্ষে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। হিমালয়ের মতো ভারি মৃত্যু দিয়ে দ্রোণ একজন ‘মানুষের মতো মানুষ’-কে পুনর্জাত করে গেলেন।
দ্রোণাচার্য শেষদিন অবধি দু’হাতের পাতায় আগলে ধরে রেখেছিলেন তাঁর কাছে সমার্থক তিনটি শব্দ– বিপ্লব, প্রেম ও কবিতা। ফেলে দিয়েছিলেন শুধু ঘষা কাচের পুরনো আয়নাটিকে।
‘আমার মুক্তির ডাক আকাশে বাতাসে
শ্রমিকের কৃষকের মাঝে শুধু ভাসে,
আমার স্বপ্নের রং লাল–
বয়সের শব্দে শুধু শোষণ ছেঁড়ার দিনকাল।
আমার জীবন এই পথে-ঘাটে মাঠের ভিতর
চিরদিন জ্বলে থাকে
বয়সে উজ্জ্বল অভিপ্রায়–
ক্রমান্বয়ে হৃদয়ের ঘর।
ফেলে দিই অচল বয়স,
ফেলে দিই পুরোনো দর্পণ
প্রথম মুক্তির দিন ভাসে
মোহহীন আকাশে-বাতাসে।।’
কবিতাটিতে শিরোনাম ও তারিখ উল্লেখিত ছিল না।