ব্রাজিলের দক্ষিণের শহর, পোর্তো আলেগ্রে। আমার বাড়ি থেকে যেমন রোনাল্ডিনহো আর দুঙ্গার বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, সেরকম গ্রেমিও ক্লাবেরও দূরত্ব বেশি ছিল না। বিশ্বফুটবলে যে ক’টি বিখ্যাত অ্যাকাডেমি রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গ্রেমিও অ্যাকাডেমি। এই গ্রেমিও থেকে উঠে আসা একজন ফুটবলারের নাম বললেই সারা বিশ্বের ফুটবল সমর্থকরা নতজানু হবেন, তিনি আর কেউ নন– রোনাল্ডিনহো গোউচো। সেই গ্রেমিও-র অ্যাকাডেমিতে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম। শুরু হল জোস ব্যারেটোর নতুন কলাম ‘তোতাকাহিনি’। আজ ‘প্রথম পর্ব’।
এই লেখা আমার ‘আত্মকথা’ নয়। যদি তা হত, তাহলে সেই আত্মকাহিনিতে এসে পড়ত আমার পরিবার, পরিজন। তা আসবে না। কিন্তু আসবে না– এই-ই বা বলি কী করে? আমার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে মোহনবাগান ক্লাব। সে তো আমারই পরিবারেরই অঙ্গ। ফলে যেভাবে আত্মকথা চলে, সেরকম না হলেও, এ আরেক দৃষ্টিতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন আত্মকথাই। আমার ভারতীয় ফুটবলকে দেখা মোহনবাগানকে কেন্দ্র করেই। তারই কিছু মুহূর্ত আমার কাছে নানা সময় ফিরে আসে। সে স্মৃতি আমাকে কখনও হাসায়, কখনও কাঁদায়। আনন্দ দেয়, একইরকমভাবে দুঃখও।
ভারতীয় ফুটবলে মোহনবাগান ছাড়া ছোট্ট সময়ের জন্য মাহিন্দ্রার জার্সি গায়ে চাপালেও আমি জানি, আপামর ভারতীয় ফুটবল সমর্থকরা আমাকে ‘মোহনবাগানী’ বলেই জানে। কিন্তু কেন আমাকে ওই ছোট্ট সময়ের জন্য মোহনবাগান ছেড়ে মাহিন্দ্রায় যোগ দিতে হয়েছিল, সেই গল্পও ‘রোববার.ইন’-এ আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। তিথি-নক্ষত্র, তথ্য ধরে ধরে কথা বলব না এই লেখায়। জানাব কিছু ঘটনার কোলাজ– যা ফুটবল মাঠের দৃশ্য, মাঠের বাইরের দৃশ্য। সেইসঙ্গে আমার ভিতরে চলা কিছু অনুভূতি, টুকরো টুকরো স্মৃতি– যা পায়ে পায়ে এসে পড়বে স্বাভাবিকভাবেই।
জীবনে সব কিছু ঠিকঠাক চললে আমার তো ভারতীয় ফুটবলে আসার কথাই ছিল না! তবু কী করে যেন এসে পড়লাম।
ব্রাজিলের জাতীয় দল যখন বিশ্বকাপে খেলে, দেখি, আর মাঝে মাঝে সত্যিই আফসোস হয় খুব। হলুদ জার্সি পরে আমারও তো বিশ্ব-ফুটবলে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা ছিল। কম বয়সে কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল! জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, সংযম, শৃঙ্খলা– এগুলো না থাকলে দূরতর অভিযানে পাড়ি দেওয়া সত্যিই অসম্ভব! শৃঙ্খলাপরায়ণ জীবন না কাটালে ভবিষ্যৎ কীভাবে নষ্ট হতে পারে, তা হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি আমি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ব্রাজিলের দক্ষিণের শহর, পোর্তো আলেগ্রে। আমার বাড়ি থেকে যেমন রোনাল্ডিনহো আর দুঙ্গার বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, সেরকম গ্রেমিও ক্লাবেরও দূরত্ব বেশি ছিল না। বিশ্বফুটবলে যে ক’টি বিখ্যাত অ্যাকাডেমি রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গ্রেমিও অ্যাকাডেমি। এই গ্রেমিও থেকে উঠে আসা একজন ফুটবলারের নাম বললেই সারা বিশ্বের ফুটবল সমর্থকরা নতজানু হবেন, সে আর কেউ নয়– রোনাল্ডিনহো গোউচো। সেই গ্রেমিও-র অ্যাকাডেমিতে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এইটুকু পড়ে হয়তো অনেকেই ভাবতে বসেছেন, আপনাদের ব্যারেটো আবার এসব কী বলছে! আসলে ভারতীয় ফুটবল যে ব্যারেটোকে ভদ্র, সংযমী, শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ হিসেবে দেখেছে, একসময় তার থেকে সহস্র যোজন দূরে ছিলাম আমি। ভারতে আসা ব্যারেটো আর ব্রাজিলে বেড়ে ওঠা ব্যারেটোর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত।
একটু ফ্ল্যাশব্যাক থেকে শুরু করি। তাহলেই একমাত্র বোধহয় আসল ব্যারেটোকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।
ব্রাজিলের দক্ষিণের শহর, পোর্তো আলেগ্রে। আমার বাড়ি থেকে যেমন রোনাল্ডিনহো আর দুঙ্গার বাড়ি খুব একটা দূরে নয়, সেরকম গ্রেমিও ক্লাবেরও দূরত্ব বেশি ছিল না। বিশ্ব-ফুটবলে যে ক’টি বিখ্যাত অ্যাকাডেমি রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম গ্রেমিও অ্যাকাডেমি। এই গ্রেমিও থেকে উঠে আসা একজন ফুটবলারের নাম বললেই সারা বিশ্বের ফুটবল সমর্থক নতজানু হবেন, তিনি আর কেউ নন– রোনাল্ডিনহো গোউচো। সেই গ্রেমিও-র অ্যাকাডেমিতে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম। ক্রমে হয়ে উঠেছিলাম গ্রেমিও-র অনূর্ধ্ব-১৬ টিমেও অটোমেটিক চয়েস। পর পর দু’বছর রইলাম।
গ্রেমিও-র সিনিয়র টিমের কোচ তখন স্কোলারি। একদিন আমাদের খেলা দেখতে এলেন। দেখেই পছন্দ করে নিলেন। গ্রেমিও কর্তৃপক্ষ দেরি না করে আমার সঙ্গে চুক্তি করে সিনিয়র দলে সই করিয়ে নিল। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ক’জন ব্রাজিলিয়ান যুবক গ্রেমিও-র মতো ঐতিহ্যশালী ক্লাবের সিনিয়র দলে সুযোগ পেয়েছে, সত্যিই সন্দেহ আছে। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে কেউ ১৮ বছর বয়সে গ্রেমিও-র সিনিয়র দলে খেলছে মানে, সে একদম ঠিকঠাক পথেই এগোচ্ছে। অর্থাৎ, এর ঠিক পরের ধাপটাই ব্রাজিলের জাতীয় দল।
আর ঠিক এই জায়গা থেকেই আমি হারিয়ে গেলাম! মানে সেই বয়সে নাইট ক্লাব, মদ্যপান– সব করতাম। দারুণ খেলছি। আর অন্যান্য ব্রাজিলিয়ানদের মতো জীবনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছি। যতভাবে জীবনকে উপভোগ করা যায় আর কী। গ্রেমিও ঠিক করল, আমাকে বিক্রি করে দেবে অন্য ক্লাবে। জাপানের কাওয়াসাকি ফ্রন্তালে ক্লাবের সঙ্গে ফুটবলার দেওয়া নেওয়া নিয়ে একটা চুক্তি ছিল গ্রেমিও-র। বছর শেষে সেই জাপানের ক্লাবে আমাকে বিক্রি করে দেওয়া হল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কাওয়াসাকি ফ্রন্তালে দিনগুলো ভালোই কাটছিল আমার। কিন্তু মরশুমের মাঝপথেই গোড়ালিতে বড়সড় চোট লাগল। এতটাই বাজেভাবে যে, বাকি মরশুমটা গোড়ালির চোটেই ভুগতে হল। ফলে সেই মরশুমে মাঠের বাইরে কাটাতে হল। বছর শেষে জাপান ছেড়ে ফের ফিরলাম ব্রাজিলে। এবার সাও পাওলোর ক্লাব– সাও জোয়াও এসপোর্তে-তে আমাকে লোনে দিল গ্রেমিও। ব্রাজিলে ফিরে আসতেই ফিরে গেলাম সেই পুরনো জীবনে। সেই আগের মতোই আবার খেলার পাশাপাশি উদ্দাম জীবন, নাইটপার্টিতে মেতে থাকতাম। তবে খেলছিলামও দারুণ। মোহনবাগান সমর্থকরা আমাকে ভালোবাসে স্ট্রাইকার হিসেবে। কিন্তু আমি আসলে উইঙ্গার। আর সেই পজিশনেই তখন দারুণ ফর্মে। মাঠ এবং মাঠের বাইরে সব জায়গাতেই তখন উড়ে চলেছি।
মরশুম প্রায় শেষের দিকে। ঠিক এই সময়ে আমার ক্লাবে এসে যোগ দিল ডগলাস। মানে, কলকাতায় খেলে যাওয়া ডগলাস। আমাদের দু’জনেরই লাইফ-স্টাইল তখন ছিল একইরকম। ম্যাচের দিন ম্যাচ। তারপর নাইটপার্টি। লিগে একদিন খুব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ পড়ল আমাদের। সবাই খুব সিরিয়াস। ব্যতিক্রম শুধু আমরা দু’জন। ডগলাস আর আমার তখন ওসব মাথায় নেই। ম্যাচের আগের রাতে পার্টি করতে চলে গেলাম। সারা রাত হোটেলেই ফিরলাম না। সারা রাত পার্টি করে ম্যাচের দিন ভোরে যখন টিম হোটেলে ঢুকছি, ম্যানেজমেন্ট হাতেনাতে ধরে ফেলল!
রাতে ম্যাচ খেলা দূর অস্ত। ম্যাচের আগেই আমাকে আর ডগলাসকে ক্লাব থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল…।
অনুলিখন: দুলাল দে