নতুন এক পৃথিবী রচনা করছেন নারী লেখকেরা। যেখানে নানাভাবে রচিত হচ্ছে পৃথক ভাষাবিশ্ব, পৃথক ভাবনার বলয়। এবং পাঠককে আনন্দ দান করা ছাড়াও সম্ভাব্যতার আড়াল ধরে চলে আসছে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রটি। ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত কল্পগল্প লেখেন, ভবিষ্য উপাদানে সাজিয়ে তোলেন তাঁর গল্পের ঝুলি। পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন এক মানবীর কথা, যে বৈজ্ঞানিকের সহায়তায় নিজের নষ্ট করা ভ্রূণকে ফিরে পায়।
২৩.
এই ধারাবাহিকে আমি মোটের ওপর মেয়েদের কলমে কল্পবিজ্ঞান বিষয়ে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা অনেকেই আগের চেয়ে ঢের বেশি লিখছি কল্পবিজ্ঞান। হাই ফ্যান্টাসি নয় হয়তো, তবে বিজ্ঞান, ধাঁধা, স্বপ্ন মিলিয়ে-মিশিয়ে আর বিজ্ঞানের সূত্র নিষ্কাশন করে, নানাভাবে উল্টেপাল্টে লেখা হতেই থাকছে কল্পগল্প। আমার নিজের লেখায়, রোবট ব্রাহ্মণ, ন্যায়শাস্ত্রে সুপণ্ডিত যন্ত্রমানব থেকে মধ্যবিত্ত ভবিষ্যতের মায়েদের সন্তানের সুখশান্তির ওপর নজর রাখতে যন্ত্রণা নিরোধক যন্ত্র কিনে ফেলা– নানা ধরনের চিন্তার সূত্র থেকে গল্প তৈরি হয়ে উঠছে। নতুন এক পৃথিবী রচনা করছেন নারী লেখকেরা। যেখানে নানাভাবে রচিত হচ্ছে পৃথক ভাষাবিশ্ব, পৃথক ভাবনার বলয়। এবং পাঠককে আনন্দ দান করা ছাড়াও সম্ভাব্যতার আড়াল ধরে চলে আসছে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রটি।
কল্পবিজ্ঞান নিয়ে কথাবার্তা হালের হলেও, ‘কল্পবিজ্ঞান’ নামটি সাত বা আটের দশকে অদ্রীশ বর্ধনের দেওয়া হলেও (আজ্ঞে হ্যাঁ, এই নামটি কিন্তু ১৯৬৩-তে প্রকাশিত প্রথম বাংলা কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’-র সমসাময়িক নয়, পরবর্তী উদ্ভাবন। আগে বলা হত ‘বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প’ বা ‘কল্পগল্প’ ইত্যাদি) কল্পবিজ্ঞান বলতে বাংলায় বুঝি ইংরেজিতে যাকে ‘সাইফাই’ বা ‘সাই-ফি’ বলে ডাকা হয়। সায়েন্স ফিকশন বিষয়টিই আসলে স্পেকুলেটিভ ফিকশন জঁরের একটি শাখামাত্র।
ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত কল্পগল্প লেখেন, ভবিষ্য উপাদানে সাজিয়ে তোলেন তাঁর গল্পের ঝুলি। ‘প্রথমদিন দেখেই খুব ইম্প্রেসড হয়েছিল লীনা। ঘরময় সর্ষেদানা ছড়িয়েছিল সে। পরখ করেছিল রুবুর কাজ। রুবু চুপচাপ কোণা কোণা থেকে সব সর্ষেদানা একে একে ঘুরে ঘুরে শুষে নিয়েছিল নিজের শরীরে। তারপর সিগন্যাল দিয়ে জানিয়েছিল সেগুলি বের করে নিতে। লীনা মোহিত হয়ে গেছিল। তারপর রুবুর দেহের নীচে স্পিনিং বুরুশ দিয়ে পরিষ্কার করে দেখিয়েছিল লীনার কার্পেট, কম্পিউটারের টেবিলের তলা। রুবুর দেহে অনেকগুলি সেন্সর আছে। সে বুঝতে পারে। মেঝে পরিষ্কারের সময় সে দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়ার আগেই ঘুরে যায় স্মার্টভাবে। ঘরের আনাচকানাচ মাড়িয়ে ঝাড়া পোছা করে। মুখে রা’টি কাড়ে না। তবে ধুলো শুষতে শুষতে তার ডাস্টবিন ভর্তি হলেই জানান দেয়। তখন রুবুর মালকিনকে দরকার। রুবুর শরীরময় ইমোজি। সেন্সর জানান দিয়েও যখন মালকিন স্টেপ নেয় না রুবু ইমোজিতে আলো ফেলে জানায় তার অবস্থা।’ ‘যন্ত্রিণী’ নামের গল্পে বাস্তব রুম্বার চেয়ে একধাপ এগিয়ে যাওয়া যন্ত্রমানবীর কথা লিখেছেন, যাদের মন আছে, মন খারাপ হয়। রোবোসাইকোলজিস্ট দিয়ে মন ঠিক করতে হয়।
……………………………………………………………………………………
ঋ গ্রহপ্রধানকে একটি বার্তা পাঠাল। ‘হে নিক্স গ্রহপ্রধান, এখনও সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ হয়নি। তার আগেই শূন্যলঙ্ঘন সেতু সক্রিয় করা উচিত নয়। এখানকার বস্তুসামগ্রীও আমাদের গ্রহে প্রেরণ করা উচিত নয়।
……………………………………………………………………………………
পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন এক মানবীর কথা, যে বৈজ্ঞানিকের সহায়তায় নিজের নষ্ট করা ভ্রূণকে ফিরে পায়। ‘‘‘ওদিকে স্বপ্না তখন বলে চলেছেন, ‘আমার ছোট্ট ক্ষমতা। বেশি লোকবল নেই, অর্থবল নেই। তাই সব নষ্ট ভ্রূণকে পুনর্নির্মাণ করতে পারি না। নার্সিং হোমগুলোর কাছাকাছি গারবেজ থেকে কিছু সংগ্রহ করি। কিছু সংগ্রহ করি স্টাফদের হাত করে। তাদেরই বাঁচিয়ে তুলেছি। এখানে যত বাচ্চা দেখবেন, তারা কেউ জন্মাতই না। আমি এদের যত্ন করে জন্ম দিয়েছি। এবারে আপনাদের স্তরের সঙ্গে এই স্তরের একটা স্থায়ী প্যাসেজ তৈরি করতে হবে। আস্তে আস্তে সেইসব বৈজ্ঞানিককে এখানে নিয়ে আসব, যারা আমাকে কর্মক্ষেত্র থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল পাগল বলে। ভাগ্যিস ততদিনে অন্য অনেক পুরস্কার বাবদ আর কিছু আবিষ্কারের পেটেন্ট বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা করে নিতে পেরেছিলাম। কিছু ধনী শিল্পপতিকেও আনতে হবে। ফান্ড চাই। সত্যিকারের জনবসতি গড়ে তুলতে হবে, অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। এই শিশুগুলোর ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হবে। আমার নিরুদ্দিষ্ট ছাত্রছাত্রীদের এগিয়ে দিতে হবে তাদের সম্মানিত ভবিষ্যতের দিকে। আমি আর ক-দিন থাকব? আপনাকে এখানে আনার কারণ কী জানেন? আপনার না-জন্মানো বাচ্চার জন্য আপনি খুব কেঁদেছিলেন। এখনও কাঁদেন। আমাদের রাডারে সব ধরা পড়ে। কাল আপনাকে আপনার বাচ্চা দেখাব।’’’
‘‘না না। আজ আজ এখনই, এক্ষুনি দেখতে চাই তাকে।’ চিৎকার করে ওঠে মোহর। তৎক্ষণাৎ স্ক্রিনে ফুটে ওঠে এক বছর পাঁচেকের বাচ্চার মুখ। মিষ্টি একটা মেয়ে বাচ্চা। ‘দিন দিন। ওকে দিন। আমি নিয়ে যাব ওকে। ওরে, আমি তোর মা রে।’ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে মোহর। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিন থেকে বাচ্চার মুখ চলে যায়। ফিরে আসে ড. স্বপ্নার মুখ। ‘শান্ত হোন, আপনি শান্ত হোন। ওকে আপনার কাছে এখন নিয়ে যাব না। আপনি দুর্বল হয়ে পড়বেন। আগে বিশ্বের কাছে দেখাই আমার সৃষ্টি। ওরা ভালো আছে। মনে করুন, ওরা এক শিশু হস্টেলে আছে। আরও যেসব মা তাদের বাচ্চাদের বাঁচাতে চেয়েছিল, তাদেরও এক-এক করে এখানে এনে দেখিয়ে দেব তাদের সন্তানদের। আপনি এখন স্থির হোন। আপনাকেই আমরা প্রথম এনেছি। কারণ আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড বলছে আপনিই এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, পরিণত মনের মানবী। আপনার কাছে ঠিক সময়ে দিয়ে আসব আপনার মেয়েকে। এতদিন কত কষ্ট পেতেন ওকে জন্ম দিতে পারেননি বলে। এখন তো মন শান্ত হল। ও ভালো আছে।’ ধীরে ধীরে স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল আর সোফাজেলিতে বসে কাঁদতে কাঁদতে মোহর ঘুমিয়ে পড়ল।’’
অঙ্কিতা ফ্যান্টাসি ও কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি লিখছেন নয় নয় করেও দশ বছর। এক লাল মৃত গ্রহের প্রাচীন কথা ঋক্থ কাহিনির বয়ান এইভাবে এগোয়–
‘‘‘ঋ গ্রহপ্রধানকে একটি বার্তা পাঠাল। ‘হে নিক্স গ্রহপ্রধান, এখনও সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা শেষ হয়নি। তার আগেই শূন্যলঙ্ঘন সেতু সক্রিয় করা উচিত নয়। এখানকার বস্তুসামগ্রীও আমাদের গ্রহে প্রেরণ করা উচিত নয়।’
মুহূর্তমধ্যে বার্তা এল গ্রহপ্রধানের কাছ থেকে, ‘হে ঋ গোলকপ্রধান, আপনাদের বিগত সমস্ত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলস্বরূপ প্রধান যন্ত্র-মস্তিষ্ক গত মাসেই জানিয়েছে যে ওই গ্রহটি শূন্য। ওখান থেকে কোনওরূপ চিন্তাশীল প্রাণীর আক্রমণের কোনওরূপ সম্ভাবনা নেই। চিন্তাশীল প্রাণী তো দূরের কথা, ওই গ্রহে কোনওরূপ প্রাণের সঞ্চারই ঘটেনি এখনও পর্যন্ত। আপনি অহেতুক দুশ্চিন্তা করছেন। এত গুরুদায়িত্ব হয়তো আপনার প্রাচীন মস্তিষ্ক বহন করতে পারছে না। সেক্ষেত্রে আমি আপনাকে অনুরোধ করব, দায়িত্ব পরবর্তী গোলকপ্রধানের হাতে অর্পণ করুন।’
ঋ ভয়ংকর গম্ভীর হয়ে উঠল। নিক্স তাকে ভদ্র ভাষায় ভয় দেখাচ্ছে। সেতু না খুললে তারা জোর করে তাকে সরিয়ে এই কাজ করবে। কিন্তু ঋ যে এখনও বেশ কিছু সম্ভাবনা খুঁটিয়ে না দেখে কিছুতেই সেতু চালু করার নির্দেশ দিতে পারবে না।
যেন পৃথিবীর জন্মের ব্রাহ্মমুহূর্ত ঘোষণা করেন অঙ্কিতা এই কাহিনির শেষে, যেখানে এককোষী প্রাণী থেকে ধীরে ধীরে একটা গ্রহে জেগে ওঠে বুদ্ধিমান মানুষ, লক্ষ বছরের পরিশ্রমে ও অভিযোজনে। ‘আমাদের এককোষ থেকে উন্নত মস্তিষ্কে বিবর্তিত হতে সময় লেগেছিল দেড়শো কোটি বছর। এদেরও হয়তো তা-ই লাগবে। দেড়শো-দুশো কোটি বছর বাদে এই রুক্ষ গ্রহটা কত পরিবর্তিত হয়ে যাবে, ভাবো তো! এই রুক্ষ আগ্নেয়শিলা ঢেকে যাবে উর্বর মাটি আর উদ্ভিদে। ঘুরে বেড়াবে উন্নত প্রাণীরা। তবে তখন আমরা আর থাকব না। কিন্তু আমাদের গ্রহ থেকে যাবে তখনও। প্রাণহীন এক লাল গ্রহ হিসাবে। শুধুমাত্র সৌরজগতে চতুর্থ গ্রহ হয়ে।”’
ইদানীং অঙ্কিতা মন দিয়েছেন ফ্যান্টাসিতে। আবার সেই সমান্তরাল বিশ্ব রচনা। প্রথমে ‘কালসন্দর্ভা’, তারপর ‘কুহককাল’– দুই সিরিজ উপন্যাসে মেলে ধরেছেন তাঁর আজীবনের পড়াশুনো, ভাবনাকে। লেখালেখির মাঝনদীতে আছেন অঙ্কিতা, পরিপূর্ণভাবে নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সেই যত্ননির্মিত ভাববিশ্বে।
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২১। সারা শহর যখন এক মহানিষ্ক্রমণের দরজায়, তথ্য রাখার দায়িত্ব কে নেবে?
পর্ব ২০। বাড়িকেই জামার মতো পরেছে মানুষ
পর্ব ১৯। আলো-অন্ধকারে হেঁটে যে কল্পবিজ্ঞান বলতে চেয়েছে দলিত কাহিনি
পর্ব ১৮। পৃথিবীর শেষ লড়াই পানীয় জলের দখলের জন্য
পর্ব ১৭। একটি সন্তান অজৈবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীতে
পর্ব ১৬। অজানা জগৎ ঘিরে যে মুগ্ধতা, বন্দনা সিংয়ের কল্পবিজ্ঞানের সেটাই চালিকাশক্তি
পর্ব ১৫। মানুষ খুন না করেও যুদ্ধে জেতা সম্ভব, দেখিয়েছে এলিজাবেথ বেয়ারের কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই