এই সময়ে একজন শিল্পীর অসম্ভব দায়। সেই দায় আমি অস্বীকার করে যেতে পারি না। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের ছবি এঁকেছিলেন ইউজিন দেলাক্রোয়া, ১৮৩০ সালে এসে। সেই ছবিতে দেখা যায়, উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত এক নারী হাজার হাজার লাশের পাশ দিয়ে পতাকা হাতে দৌড়চ্ছে। ছবির নাম: লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল। এখানে একটা তথ্য যোগ করা জরুরি, তা হল সেটিও ছিল এক শরৎকালে আঁকা ছবি। যদিও দেলাক্রোয়ার শরৎ আর আমাদের শরৎ এক নয়। কিন্তু এই ছবি কি এই সময়েরই ভাষা নয়? প্রায় ২০০ বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা এই ছবি থেকে।
২৩.
ক’দিন পাঁচমাথার মোড়ে ছবি আঁকতে গিয়ে তুমুল ভিজে গেলাম। কত মানুষ। চিৎকার। স্লোগান। এড়াব কী করে নিজেকে? কিন্তু ভেজার ফল পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে জ্বর। মাথাব্যথা। সুগারও ফল করে গিয়েছিল। গাড়িতে এক টুকরো চকোলেট ছিল, তা খেতে ঠিক হলাম। ক’দিন ধরে রুটিন বলে কিছু নেই। এবারে দেরি করে প্রতিমার কাজ শুরু করেছি। আমার প্রতিবারই আগে থেকে লে-আউট করা থাকে। ‘লে-আউট’ মানে কীরকম হবে ঠাকুরের অবয়ব তার একটা প্রাথমিক খসড়া। সেই অনুযায়ীই কাজ শুরু করি। কিন্তু এবারে তিলোত্তমার ঘটনায় ভেস্তে গিয়েছে সেই খসড়ার প্ল্যান। বদলাতে হচ্ছে এখন। আমার সঙ্গে কাজ করে বিকাশ পাল ও নিশিপ্রভাত পাল– দু’জনেই আমার ধাত চেনে। বোধহয় প্রথম ওরা দেখল যে, ঠাকুর বদলে যাচ্ছে যা ভাবা হয়েছিল তার থেকে। ভাঙা হচ্ছে না, আসলে গড়াই হচ্ছে। রূপটা বদলে যাচ্ছে। আমার দুর্গা তো এতকাল ঘরের, চেনা-পরিচিত– সেই দুর্গার হাতে অস্ত্র মানাত না। তাই বদলে যে রূপে আনছি, সেখানে তো শুধু হাতের অস্ত্র ধরালে হবে না, তার চোখ-মুখ বদলে যাবে, শরীরের পেশি বদলে যাবে– সেসব কাজই চলছে। কিন্তু হঠাৎ আবার মেঘ, বৃষ্টি। ঠাকুর শুকোচ্ছে না।
সমাজ পরিবর্তনের এই আন্দোলনে আমি একপ্রকার জড়িয়ে গিয়েছি। আমি ঠাকুর গড়ার কাজ করছি সারাদিন– প্রায় রাত ১১ অবধি। কিন্তু তার পর, আমাকে কোনও না কোনও মিছিল যেন ডাকছে। গতকাল যেমন গিয়েছিলাম সল্টলেকে, স্বাস্থ্যভবনের সামনে যে। আমার কোনও ভূমিকা নেই পাশে দাঁড়ানো ছাড়া। আমি মিডিয়ার থেকেও দূরে থাকতে চাইছি। চাই মিডিয়া তাদের দেখাক, যারা এই চিৎকার করছেন, স্লোগান তৈরি করছেন, পথনাটক করছেন, গ্রাফিত্তি করছেন। আমার সামান্য যেটুকু পরিচিতি আছে, একজন নগণ্য ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে– এই-ই যথেষ্ট।
যদিও এই সময়ে একজন শিল্পীর অসম্ভব দায়। সেই দায় আমি অস্বীকার করে যেতে পারি না। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের ছবি এঁকেছিলেন ইউজিন দেলাক্রোয়া, ১৮৩০ সালে এসে। সেই ছবিতে দেখা যায়, উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত এক নারী হাজার হাজার লাশের পাশ দিয়ে পতাকা হাতে দৌড়চ্ছে। এখানে একটা তথ্য যোগ করা জরুরি, তা হল সেটিও ছিল এক শরৎকালে আঁকা ছবি। যদিও দেলাক্রোয়ার শরৎ আর আমাদের শরৎ এক নয়। কিন্তু এই ছবি কি এই সময়েরই ভাষা নয়? প্রায় ২০০ বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা এই ছবি থেকে।
এই আন্দোলনকে নিছকই বাংলাদেশ থেকে আসা, একটা সাময়িক আন্দোলনের ঢেউ বয়ে গেল, ভাবলে ভুলই হবে। প্রতিবাদ করার জন্য একটা মঞ্চ মানুষের মনে তৈরি হয়ে গিয়েছে। সে মঞ্চ হল রাজপথে নেমে যাওয়া। মানুষ আরও বেশি একজোট হবে এরপর থেকে। এখনকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা, এভাবেই তৈরি হচ্ছে। আমি তো আমার মেয়েকেও পাঠাচ্ছি মিছিলে। আমি নিজেও স্লোগান লিখেছি। কুমারটুলিতে স্লোগান লিখেছি, প্রচার করিয়েছি: ‘কুমারটুলি দিচ্ছে হাঁক/ আমার দুর্গা বিচার পাক।’ এটা তো কোনও সশস্ত্র বিপ্লব না। কেউ ছবি আঁকছেন, কেউ গান গাইছেন, কেউ কবিতা বলছেন। তাঁরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে। এটা অন্যায়কে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক! শিল্পী আনিস কাপুর যখন রাস্তায় নেমেছিলেন, তিনি তো ছবি নিয়ে নামেননি। ছবি এঁকেই যে প্রতিবাদ করতে হবে, তার কোনও মানে নেই।
ক’দিন পরেও শুরু হবে দেবীর পুজো। কিন্তু কোন রূপে? কী মন নিয়ে আসছেন এবার দেবী? এই বঙ্গে? আমি দীর্ঘকাল অসুরবিনাশীনী রূপের দেবীপ্রতিমা তৈরি করিনি। পুরাণ বলছে দুর্গা সশস্ত্র। যে অস্ত্র সামাজিকভাবে ধরা যাচ্ছে না, পুরাণের মধ্য দিয়ে ধরুক এই মেয়েটি। তাঁর হাতে ১০টা অস্ত্র রয়েছে। আমি শিল্পী হিসেবে আমার দুর্গাকে ১০টা কেন ১০০টা ত্রিশূল ধরাতে পারি, কোনও মনুবাদীই কিছু বলতে পারবে না। এ আমার শিল্পিত অধিকার।
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ২০: মহালয়ার ভোরের আগেই মানুষ জেগেছে, এটাই সত্যিকারের বোধন
পর্ব ১৯: আমার দুর্গার মধ্যে এ বছর বিষণ্ণতার সুর থাকবে
পর্ব ১৮: এখনও ভয় হয়, আমার তৈরি দুর্গাপ্রতিমা মানুষ ভালোবাসবেন তো?
পর্ব ১৭: পুজোসংখ্যার প্রচ্ছদে দুর্গা থাকতেই হবে, এটাও একধরনের ফ্যাসিজম
পর্ব ১৬: সাধারণ মানুষের কাছেই শিল্পের পরশপাথর রয়েছে
পর্ব ১৫: রাষ্ট্র যদি রামের কথা বলে, শিল্পীর দায় সীতার কথাও বলা
পর্ব ১৪: মানচিত্র মোছার ইরেজার শিল্পীর কাছে আছে
পর্ব ১৩: তৃতীয় নয়নকে গুরুত্ব দিই, তৃতীয় লিঙ্গকেও
পর্ব ১২: লাখ লাখ টাকা কামানোর জন্য দুর্গাপুজো করিনি, করব না
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved