‘ম্যায় হুঁ না’-র পাশাপাশিই তো আশুতোষ গোয়ারিকরের ‘স্বদেশ’ এসেছিল। ‘দিল সে’ বা ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’-র দেশপ্রেমিক শাহরুখ মোহন ভার্গব হয়ে এলেন। গ্রামভারতে প্রবাসী উন্নয়নভাবনা আনার যে আভাস এই ছবি দিল, তা দেশকে অন্যভাবে পড়তে শেখাচ্ছে তো বটেই, একইসঙ্গে উন্নয়ন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন, বিশ্বায়িত, সংস্কারপন্থী মিশ্র অর্থনীতি ছুঁয়ে থাকা ভাবনার প্রতিফলনও ঘটল। ‘স্বদেশ’-এর গান আমাদের ছোটবেলাকে ছুঁয়ে ছিল, ‘ইউ হি চলা চল রাহি’ বেজে উঠলে আমরা দুলেও উঠতাম ঈষৎ। কিন্তু ‘স্বদেশ’ আমাদের দেশভাবনায় ততটা ডুবিয়ে দিল না, যতটা দিল ‘রং দে বাসন্তী’।
৩৯.
নব্বইয়ের ‘ফিল্মফেয়ার’-সহ একাধিক ফিল্ম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে, বাংলা সংবাদপত্রর ভাষায় যাকে বলে ‘সাহসী’, তেমন বিভঙ্গে ধরা দিচ্ছিলেন বলিউডের তারকারা। কখনও অক্ষয়কুমার-রেখা, তো কখনও সুস্মিতা সেন একাই একশো, কখনও বা সুনীল শেট্টি-টুইঙ্কল খান্না। কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, সুরেশ ওয়াদেকররা ছিলেন, নব্বইয়ের মেলডি ছিল, বিজ্ঞাপনের পেলবতা ছিল, রং আর শব্দের মধ্যেও তার ছোঁয়াচ ছিল; যা দেখে আমরা এখনও চমকে উঠি– এমনও সময় ছিল বুঝি! অ্যাকশনের জুতো থেকে সার্ফ আলট্রা, নির্মা থেকে পন্ডস– ভাবনায় ছিল আদতে মধ্যবিত্ত আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ, ভিস্যুয়ালেও। চমকে উঠি দেখে, জগজিৎ সিংয়ের লাইভ অনুষ্ঠানে ‘হোশওয়ালো কো খবর কেয়া’ শুনছেন নীরব, মোহিত দর্শক– একমনে! সেই একইসঙ্গে বন্য, একইসঙ্গে উতলা নব্বই, একইসঙ্গে রোমান্সে ভরপুর, গম্ভীর অথচ বিষণ্ণ নব্বই নস্টালজিয়া হয়ে উঠল একুশ শতকের শুরুতেই। আর ‘দিল চাহতা হ্যায়’-এর মতো ছবি দেখাচ্ছে, কেরিয়ারমুখী তরুণদের কাছে বন্ধুত্ব আদতে হাসিকান্নায় মোড়া অতীত মাত্র। হঠাৎ রাস্তায় আপিস অঞ্চলে দেখা হলে ‘বন্ধু কী খবর বল’, বললেই খুলে যাবে অতীতের সিন্দুক।
কিন্তু মনে মনে সকলেই জানে, ‘সময় চলে গেছে, এবং চলেছে/ চলতি জীবনের গল্প বলছে।’ তাই সময় এগিয়ে যায়, রিইউনিয়নে গোয়া যাওয়ার স্বপ্ন ধুলো খায় কৈশোরের হাঁটাচলার কুমোরটুলি থেকে আহিরীটোলা, লেক রোড থেকে পূর্ণদাস রোডের আশপাশে, ফাঁকা সল্টলেক আরও একা হয়ে যায়, চেনা বাড়ি চেনা মাঠ ছেড়ে চলে যায় বন্ধুরা। কেউ বম্বে, কেউ ব্যাঙ্গালোর। কেউ এই কলকাতা শহরেই মেতে ওঠে কলেজজীবনে। নতুন পত্রিকা, নতুন নাটকের দল, নতুন লেখা, নতুন ছবি করার স্বপ্ন।
এসবের মধ্যেই নতুন শতাব্দী নানাবিধ ইঙ্গিত দেয়। যে শ্রেয়া ঘোষালের গলায় ‘প্রজাপতি মন মেলে পাখনা’ শিশু উৎসবের উপজীব্য ছিল, তাঁর গলায় ‘চলো তুমকো লেকার চলে হাম উন ফিজায়োঁ মে’ শুনে আমরা চমকে চমকে উঠছি। কারণ যত না গানটা, তার চেয়ে বেশি জন আব্রাহাম-বিপাশা বসু। অমন রসায়নে তখন আমরা উদ্বেল। ‘জাদু হ্যায় নাশা হ্যায়’ শুনলেই জন-বিপাশার সমুদ্রধারের সেইসব শিরশিরানি আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। অতটা সরাসরি যৌনতার সঙ্গে বোঝাপড়া একটু তো চমকাবেই। কিন্তু জন-বিপাশার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটো নাম ধূমকেতুর মতো ভাসতে শুরু করল সদ্য সেকেন্ডারি স্কুলগুলোর বেঞ্চে। ইমরান হাশমি আর মল্লিকা শেরাওয়াত। ‘মার্ডার’-এর দৃশ্য তখন খুনে হয়ে উঠেছে রীতিমতো। ‘চকোলেট’ রিলিজ করল কয়েকদিনের মধ্যেই, বাতাসে গুনগুন শুরু হল ইমরান হাশমিকে নিয়ে, ‘চকোলেট বয়’ শব্দটা সেঁধিয়ে গেল। ‘আশিক বনায়া আপনে’-র সুর বিড়বিড় করলেও পাড়ার জেঠু, স্কুলের স্যর-ম্যাডাম-দিদিমণিরা আড়চোখে তাকায়।
বোঝা গেল, নায়কের চেহারা বদলাচ্ছে। রোমান্টিক নায়ক, অ্যাংরি ইয়ংম্যান, এমনকী, বোহেমিয়ান নায়ক বা প্রবাসী ভারতীয় নায়কের থেকেও এই মাচো এবং সপাট যৌন আবেদনের নায়ক আলাদা। নায়িকাদের এই কল্পে বারবার ভাবা হয়েছে, কিন্তু নায়কের এই ধারণা কোথাও তার পরিপূরক হয়ে উঠল। ‘ধুম টু’-তে যখন সরাসরি গানে ‘সেক্সি লেডি অন দ্য ফ্লোর’-এর মতো লিরিক পাওয়া গেল, তখন বোঝা গেল, এই ‘মাচো’, ‘চকোলেট’ নায়কের ধারণা সম্পূর্ণ হবে ‘সেক্সি’ নায়িকার হাত ধরেই। সোমা এ. চ্যাটার্জি তাঁর ‘দ্য ফিমেল গেজ: এসেজ অন জেন্ডার, সোসাইটি অ্যান্ড মিডিয়া’-তে গৃহশৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে যাওয়া মেয়েদের প্রতি যে ‘ইনভিজিবল ভায়োলেন্স’-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন, তার থেকে বেরিয়ে এসে মহিলাদের করে তোলা হচ্ছে ‘সাহসী’, আবার ‘আধুনিকতা’ নামে একটি একবিংশ শতাব্দীর নিজস্ব বায়বীয় ধারণা গড়ে তুলে সেই খাপে এঁটে দেওয়া হল নায়িকাদের, অন্যদিকে ওই ঘরোয়া অদৃশ্য হিংসা আসতে শুরু করল ‘কিঁউ কি সাঁস ভি কভি বহু থি’-র মতো ধারাবাহিকে।
অন্যদিকে, ফারহান আখতারের ‘দিল চাহতা হ্যায়’-এর যুববেলার গল্প, যার বিস্তৃতি পাওয়া যাবে দীর্ঘদিন পর, ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’-তে এসে, তা রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা-র ‘রং দে বাসন্তী’-তে একেবারে ভিন্ন মার্গে ধরা দিল। ‘ম্যায় হুঁ না’-র মতো নরম ও পরোক্ষ জাতীয়তাবাদী চিন্তনের বাইরে বেরিয়ে এল ‘রং দে বাসন্তী’-র জাতীয়তাবাদী যুবসমাজ। ম্যায় হুঁ না-র রাম কলেজ ক্যাম্পাসের আবহাওয়ার ভেতর থেকেই যে বৃহৎ দেশাত্মবোধে পৌঁছেছিল, রং দে বাসন্তী-র দলজিৎ, করণ, সোনিয়া, সুখি, আসলামরা তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে অতীতচারী হল। ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’-র এ একেবারে অন্য এক ভাষ্য, যেখানে ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, রাজগুরুরা উঠে এল, একুশ শতকের বর্তমানে যে হিন্দুত্ববাদী লক্ষ্মণ পাণ্ডে, সে হয়ে উঠল রামপ্রসাদ বিসমিল। এই যে ডিজে, ‘মস্তি কা পাঠশালা’-র যৌবনের বাইরে বেরিয়ে নিজেদের, এমনকী ভারতীয় সেনার বুদবুদেও না মজিয়ে, ভগৎ সিং, আশফাকুল্লা, রাজগুরু, দুর্গাবতী দেবীদের কল্পলোকে নিয়ে যাওয়া– এ যেন একুশ শতকীয় স্বদেশচেতনাকে, রাষ্ট্রবোধকে এককথায় অস্বীকার করা, বেছে নেওয়া পরাধীনতার এমন এক সময়কে, এমন এক সংগ্রামী মননকে, যেখানে ‘রুবারু, রোশনি’ বেজে ওঠে সেই গৌরবজনক অতীতকে বরণ করেই।
মজার বিষয়, শ্যাম বেনেগাল যখন হঠাৎই ‘বোস: দ্য ফরগটেন হিরো’ বানাচ্ছেন, এনডিএ আমলের শেষ ও ইউপিএ আমলের শুরুর আবহে, তার আশপাশে ভগৎ সিংয়ের গোটা দুই বায়োপিক মুক্তি পেয়ে গেছে, একটিতে নায়ক অজয় দেবগণ, অন্যটিতে সানি দেওল। অজয় দেবগণ অভিনীত বায়োপিকটিই বেশি স্মর্তব্য হয়ে রইল, সানি দেওলের ‘ঢাই কিলো কা হাত’ এক্ষেত্রে অকেজো হয়ে গেল। সূর্য সেনকে নিয়ে বেদব্রত পাইনের ‘চিটাগং’ ও আশুতোষ গোয়ারিকরের ‘খেলে হাম জি জান সে’ আরও পরে ঘটল, কিন্তু প্রশ্ন এটাই, দু’হাজার পরবর্তী ওই সময়ে ভগৎ সিং হঠাৎ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে একটু গল্পগাছায় যাওয়া যাক।
‘ম্যায় হুঁ না’-র পাশাপাশিই তো আশুতোষ গোয়ারিকরের ‘স্বদেশ’ এসেছিল। ‘দিল সে’ বা ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’-র দেশপ্রেমিক শাহরুখ মোহন ভার্গব হয়ে এলেন। গ্রামভারতে প্রবাসী উন্নয়নভাবনা আনার যে আভাস এই ছবি দিল, তা দেশকে অন্যভাবে পড়তে শেখাচ্ছে তো বটেই, একইসঙ্গে উন্নয়ন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন, বিশ্বায়িত, সংস্কারপন্থী মিশ্র অর্থনীতি ছুঁয়ে থাকা ভাবনার প্রতিফলনও ঘটল। ‘স্বদেশ’-এর গান আমাদের ছোটবেলাকে ছুঁয়ে ছিল, ‘ইউ হি চলা চল রাহি’ বেজে উঠলে আমরা দুলেও উঠতাম ঈষৎ। কিন্তু ‘স্বদেশ’ আমাদের দেশভাবনায় ততটা ডুবিয়ে দিল না, যতটা দিল ‘রং দে বাসন্তী’। হলে গিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখতে চাওয়ার আবদার করার সাহস তখনও বাংলা মিডিয়ামে পড়া আমাদের ততটা হয়নি। তাই ইন্ডিয়ার ক্রিকেট ম্যাচের দিনই যখন রোববার রাত আটটায় স্টার গোল্ডে কোনও একটি সাম্প্রতিক হিন্দি সিনেমা দেখানো হত, তখন খানিক হইহই রইরই পড়ে যেত। খবরের কাগজের দ্বিতীয় পাতা থেকে বা টিভির বিজ্ঞাপন থেকে সন্দেশ পেলেই তাই ওইদিন টিভিতে ওই বিশেষ চ্যানেলটা ঘোরানোর অনুমতি নেওয়ার হিড়িক পড়ে যেত। আর সঙ্গে সিনেমা দেখার গার্জেন গোছের দাদা-দিদিরা জুটে গেলে তো কথাই নেই। তাদের তত্ত্বাবধানে ছবি দেখলে অন্তত, একা একা হিন্দি ছবি দেখার পাপ লাগত না। সেভাবেই ‘রং দে বাসন্তী’ দেখে ফেলা। ইতিহাসের টেক্সট বুক যে ভগৎ সিংকে চেনাচ্ছে, বায়োপিক তাকে আরও জীবন্ত করছিল ঠিকই, কিন্তু রং দে আমাদের মনে-মাথায় ভগৎ সিংয়ের যে চেহারা তৈরি করল, তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক। কেবলই ইতিহাস হিসেবে বা মণীষা হিসেবে তাকে আমরা চিনলাম না, চিনলাম ইনকিলাবের রাজনীতির নতুন আলোয়।
আর এখানেই আগের প্রশ্নে যদি ফেরত যাওয়া যায়, তাহলে কি এই প্রতর্ক তোলা সম্ভব, বামপন্থাকে দূরে ঠেলে রাখা পুঁজিবাদী সময়েও চরমপন্থী রাজনীতির এই ধারাটিকে যুবসমাজ সমীহ করতে চেয়েছে তখন? সাম্প্রদায়িক উসকানি এড়িয়ে, রাষ্ট্রীয় অবদমনের প্রতি প্রতিস্পর্ধী হয়ে?
পরবর্তী কয়েক বছরের বলিউড সেই ধারা থেকে বিচ্যুত হল না কি, সে গল্প আপাতত তোলা থাক।
তাঁর ছাত্রীবেলাতেই প্রদোষ দাশগুপ্ত তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন– প্রকৃতিকে শিক্ষার্থীর মতো নতজানু আবেগে চিনে নিতে। যে প্রকৃতি রং-রূপের আধার, রূপভেদের আবাদভূমি। সেই শিক্ষা আত্মস্থ করে, ধাতুর শরীরে প্রকৃতির নৈঃশব্দ্যের ছন্দটি অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছিলেন উমাদি।