মোহনবাগানে আসার আগে, ব্রাজিল থাকাকালীন ডান পায়ের গোড়ালিতে একটা চোট লেগেছিল। চোটটা মারাত্মক কিছু ছিল, তা নয়। কিন্তু দ্রুত দৌড়তে একটু সমস্যা হচ্ছিল। আমার ধারণা ছিল, ভারতীয় ফুটবল এমনিতেই মন্থর, অন্তত ব্রাজিল কিংবা জাপানের ক্লাব ফুটবলের তুলনায়। তাই এই চোটটা কোনও ফ্যাক্টর হবে না। আর সেরে গেলে তো সমস্যা মিটেই গেল। ফলে প্রথমদিন সেই গোড়ালির চোট লুকিয়েই আমি মোহনবাগানের প্র্যাকটিসে ট্রায়ালে নেমেছিলাম।
৩.
জায়গাটার নাম নিউ মার্কেট।
এখন জানি বটে। কিন্তু কলকাতায় যখন প্রথম পা রেখেছিলাম, তখন নিউ মার্কেট কেন, শহরের নাড়িনক্ষত্র কিছুই জানতাম না। কলকাতা শহরটা ছিল আমার কাছে গোলকধাঁধার মতো। নিউ মার্কেট ক্লাবতাঁবু বা ময়দান থেকে খুব দূরে নয়। এখন জায়গাটা যতই চেনা হোক, তখন ছিল আমার কাছে একদম অচেনা, অজানা। ভাগ্যিস, সঙ্গে আমার এজেন্ট সিলভেইরো ছিল!
নিউ মার্কেট বলে নয়, ব্রাজিল ছাড়ার সময় ভারত সম্পর্কে সত্যিই তেমন কোনও ধারণা ছিল না আমার। মোহনবাগান ক্লাব ছাড়া যেটুকু বুঝেছিলাম, তা হল ভারতে বহু ধর্মের মানুষের বসবাস। কলকাতাতেও তাই। ভারতের খেলাধুলো, সংস্কৃতি, মানুষজনের ব্যবহার– এসব আমার ধারণার বাইরে ছিল। যেটুকু জেনেছিলাম, সবটাই ওই ধর্ম দিয়ে। জেনে নিশ্চিত হয়েছিলাম, কলকাতায় অনেকগুলো নাকি চার্চ রয়েছে। ফলে প্রভু যিশুর প্রার্থনায় আমার বিশেষ কোনও সমস্যা হবে না।
নিউ মার্কেটের ঠিক সামনে আমাকে আর সিলভেইরোকে যে হোটেলে মোহনবাগান কর্তারা রেখেছিলেন, সেটা ছিল ‘লিন্ডসে হোটেল’। আমি পর্তুগিজ ছাড়া কিছুই বলতে পারতাম না। বুঝতামও না। সিলভেইরো ছিল বলে, না হলে নিউ মার্কেটের ভিড়ে কোথায় যে হারিয়ে যেতাম! নিউ মার্কেটে প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। বিকেলে যখন সিলভেইরোর সঙ্গে হাঁটতে বের হয়েছিলাম, দেখলাম চারিদিকে গিজগিজ করছে মানুষের মাথা।
ঠিক পরের দিন সকালেই ছিল মোহনবাগানে প্র্যাকটিস। প্রথমদিন। তাই বেশি ঘোরাঘুরি না করে তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে শুয়ে পড়লাম। যতদূর মনে পড়ছে, ’৯৯-এর নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে মোহনবাগান ক্লাবে আমার প্রথম পা রাখা। মোহনবাগান ক্লাবে কোচ বাবলুদা-র (সুব্রত ভট্টাচার্য) একটা নির্দিষ্ট ঘর ছিল। উনি সেই ঘরেই বসে ছিলেন। আমি ক্লাবে পা রেখে প্রথমেই গেলাম ড্রেসিংরুমে। আর মোহনবাগান কর্তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ড্রেসিংরুমের বাইরে অপেক্ষায় থাকল সিলভেইরো।
অনেকের কৌতূহল থাকতে পারে যে, আমি যেহেতু গ্রেমিও-র পাশাপাশি জাপানের ক্লাবেও খেলে এসেছি, সেই সব ক্লাবে খেলে আসার পর সেই সময়ের মোহনবাগানের ড্রেসিংরুম, ক্লাব, মাঠ, গ্যালারি দেখে আমার মনের অবস্থা কীরকম হয়েছিল? হতাশ হয়ে পড়েছিলাম কি না? সত্যি বলতে, আমি একটুও আশ্চর্য হইনি। কিংবা বলতে পারেন, আমার কোনও অসুবিধাও হয়নি। আমি যেমন উন্নত পরিকাঠামোয় খেলেছি, সেরকম ব্রাজিলের বেশ কিছু ছোট ক্লাবেও খেলেছি। সেখানকার পরিকাঠামো মোহনবাগানের থেকেও খারাপ ছিল। তার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই খেলেছি। খেলাটাকে উপভোগ করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। তাই আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। তাছাড়া ব্রাজিল ছাড়ার আগে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলাম যে, ভারতে খেলতে যাচ্ছি, ফলে ইউরোপিয়ান ফুটবলের পরিকাঠামো পাব না। স্বাভাবিকভাবেই মোহনবাগানে প্রথম দিন থেকে আমার মানিয়ে নিতে কোনও অসুবিধাই হয়নি। অসুবিধাটা ছিল অন্য জায়গায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গ্রেমিও-র পাশাপাশি জাপানের ক্লাবেও খেলে এসেছি, সেই সব ক্লাবে খেলে আসার পর সেই সময়ের মোহনবাগানের ড্রেসিংরুম, ক্লাব, মাঠ, গ্যালারি দেখে আমার মনের অবস্থা কীরকম হয়েছিল? সত্যি বলতে, আমি একটুও আশ্চর্য হইনি। কিংবা আমার কোনও অসুবিধা হয়নি। আমি যেমন উন্নত পরিকাঠামোয় খেলেছি, সেরকম ব্রাজিলের বেশ কিছু ছোট ক্লাবেও খেলেছি। সেখানকার পরিকাঠামো মোহনবাগানের থেকেও খারাপ ছিল। তার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই খেলেছি। খেলাটাকে উপভোগ করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এতদিন কোথাও বলিনি। আজ আপনাদের কাছে স্বীকার করছি।
মোহনবাগানে আসার আগে, ব্রাজিল থাকাকালীন ডান পায়ের গোড়ালিতে একটা চোট লেগেছিল। চোটটা মারাত্মক কিছু ছিল, তা নয়। কিন্তু দ্রুত দৌড়তে একটু সমস্যা হচ্ছিল। আমার ধারণা ছিল, ভারতীয় ফুটবল এমনিতেই মন্থর, অন্তত ব্রাজিল কিংবা জাপানের ক্লাব ফুটবলের তুলনায়। তাই এই চোটটা কোনও ফ্যাক্টর হবে না। আর সেরে গেলে তো সমস্যা মিটেই গেল। ফলে প্রথমদিন সেই গোড়ালির চোট লুকিয়েই আমি মোহনবাগানের প্র্যাকটিসে ট্রায়ালে নেমেছিলাম।
ক্লাবের কোন পরিস্থিতিতে আমার ট্রায়াল দিতে নামা, সেটাও একটু বলে নেওয়া দরকার। ট্রায়ালে নেমে জানতে পারলাম, জাতীয় দলের ম্যাচ থাকায় মাসখানেকের জন্য জাতীয় লিগ বন্ধ থাকবে। আমার ট্রায়ালের আগে মোহনবাগান জাতীয় লিগে বেশ কয়েকটা ম্যাচ খেলেও ফেলেছে। পারফরম্যান্স খুব আহামরি নয়। লিগ টেবিলের পঞ্চম স্থানে রয়েছে মোহনবাগান। কোচ চাইছেন একজন শক্তপোক্ত বুলডোজিং স্ট্রাইকার। যে মাঠে নামবে, আর গোল করবে।
প্রথম দিনেই প্র্যাকটিসে আমার ঠাঁই হল দ্বিতীয় দলে! দলের মধ্যে প্র্যাকটিস ম্যাচও খেললাম, ওই ‘সেকেন্ড টিম’-এর হয়ে।
’৯৯-এর যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় আমি একদম ছিপছিপে। রোগাই বলতে পারেন। প্রথম দর্শনে কোচ সুব্রত-র যে আমাকে খুব একটা পছন্দ হয়নি, বুঝে গেলাম। আসলে কোচ চাইছিলেন, আফ্রিকা থেকে দীর্ঘদেহী কোনও স্ট্রাইকার নিতে, যে সহজে বিপক্ষ রক্ষণকে ছারখার করবে, বিপক্ষ ডিফেন্ডারকে ভয় পাবে না। সেখানে আমার মতো রোগা চেহারার ফরোয়ার্ড এসেছে জুটেছে! এককথায় কোচের নাপসন্দ। তার ওপর আমি স্ট্রাইকার পজিশনেও খেলি না। ফলে যা হওয়ার তাই হল। টিমের প্র্যাকটিস ম্যাচগুলোয় আমার জায়গা হল দ্বিতীয় দলে।
২৫ বছর আগের কথা তো। তাই সবকিছু স্পষ্ট মনে নেই। যতটুকু মনে পড়ছে, সে-সময় নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার জন ছিলেন সবুজ-মেরুন কর্তাদের ভাবনায়। তাঁকে দলে নেওয়ার জন্য মোহনবাগান কর্তারা কথাবার্তা বলছেন, সে খবরও কানে এসেছিল। খবরটা এসেছিল আমার এজেন্টের মারফত। শুনলাম, জন ইতিমধ্যে ভারতে খেলেছেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর সঙ্গে মোহনবাগান কর্তাদের পাকা কথা হচ্ছিল না। কারণ, চুক্তির জন্য তাঁর আর্থিক দাবি ছিল আকাশছোঁয়া। তিনি ট্রায়ালে নামেনি। ছিলেন নাইজেরিয়ায়। আর জনের এজেন্ট রোজ সুব্রতর সঙ্গে কথা বলছেন সইয়ের ব্য়াপারে। কিন্তু জন রাজি না হওয়ায় হয়তো তখনও আমাকে ট্রায়ালে রাখা হয়েছিল। যদি জন শেষমেশ চূড়ান্ত না হয়, তাহলে আমাকে নেওয়া হলেও হতে পারে। তবে আমার যে মোহনবাগানে সই করার সুযোগ ক্রমশ কমছে, বুঝতে পারছিলাম।
যাই হোক, খারাপের মধ্যে ভালোর দিক ছিল একটাই। মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে দিতেই দু’সপ্তাহের মধ্যে গোড়ালির চোটটা সেরে গেল। আর পুরো ফিট হতেই তখন আমার পায়ে সেই পুরনো ঝলক। প্র্যাকটিসে আমায় আটকানো অসাধ্য হয়ে উঠছিল টিমমেটদের পক্ষে। কিন্তু বিধিবাম! প্রথম দলে সুযোগই পাচ্ছিলাম না যে! সেই সময় মোহনবাগানের সেরা ফুটবলারদের রাখা হত প্রথম দলে। আর যাদের খেলার সুযোগ কম, তাদের রাখা হত দ্বিতীয় দলে। আর প্রতিদিন ম্যাচ প্র্যাকটিসে আবিষ্কার করতাম, আমার জায়গা হয়েছে, ওই দ্বিতীয় দলে…।
অনুলিখন: দুলাল দে
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব