মোহনবাগান জার্সিতে খেলা শুরু করেছি সেই ’৯৯-তে। দেখতে গেলে পিছনে ফেলে এসেছি ২৫ বছর। খাতায়-কলমে মোটেই কম সময় নয়। ফলে নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ, সাল নিখুঁতভাবে আমার মনে নেই। তাই কিছু স্মৃতি যেমন মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে, কিছু আবার ফিকে হয়ে এসেছে। মনের অতলে ডুব দিয়ে ডুবুরির মতো তা তুলে আনার চেষ্টা করছি অহরহ।
৪.
আচ্ছা, ধারাবাহিকভাবে আমার জীবনের অজানা কথা জানতে কেমন লাগছে আপনাদের?
ভারতীয় ফুটবলে আপনারাই আমাকে ব্যারেটো করেছেন। তাই আপনাদের মতামত পাওয়াটা ভীষণই জরুরি। প্রতি সপ্তাহে রোববার ডিজিটালে প্রকাশিত হচ্ছে ‘তোতাকাহিনি’। তাই মনে হল, আমারও একটু জানা দরকার, কেমন লাগছে আপনাদের? আরেকটা কথা পরিষ্কার করে দিতে চাই। অবশ্য প্রথম দিনই বলেছিলাম। আরেকবার বলা দরকার। ‘তোতাকাহিনি’ আমার আত্মজীবনী নয়। ভারতীয় ফুটবলে আমার কিছু মুহূর্ত, যা দাগ কেটে আছে মনে, তার কথা বলছি। এতদিন যা শুনেছেন, জেনেছেন সবাই সংবাদমাধ্যমের মারফত। এবার আপনাদের সরাসরি জানাচ্ছি আমার কথা। আর এই জায়গাটিতেই হয়েছে সমস্যা!
মোহনবাগান জার্সিতে খেলা শুরু করেছি সেই ’৯৯-তে। দেখতে গেলে পিছনে ফেলে এসেছি ২৫ বছর। খাতায়-কলমে মোটেই কম সময় নয়। ফলে নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ, সাল নিখুঁতভাবে আমার মনে নেই। তাই কিছু স্মৃতি যেমন মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে, কিছু আবার ফিকে হয়ে এসেছে। মনের অতলে ডুব দিয়ে ডুবুরির মতো তা তুলে আনার চেষ্টা করছি অহরহ। তবু ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। হলে ক্ষমা করে দেবেন নিজগুণে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এতদিন ধরে এই অপেক্ষাতেই ছিলাম। তখন আমি পুরো ফিট। প্রথম দলে সুযোগ পেতে আত্মবিশ্বাস একধাক্কায় কয়েকগুণ বেড়ে গেল। প্র্যাকটিসে কেউ আমাকে আটকাতে পারছিল না। বল পায়ে ছেলেখেলা করছিলাম। এরপর আর মোহনবাগানে সুযোগ পেতে এক মুহূর্ত দেরি হয়নি। প্র্যাকটিস শেষে আমার চুক্তি নিয়ে ক্লাবের ভিতরে সিলভেইরোর সঙ্গে আলোচনায় বসে দেবাশিস। তারপর থেকে যতবার মোহনবাগানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, পুরো ব্যাপারটা দেবাশিসই দেখত।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমার মোহনবাগান ট্রায়ালে নামার ঘটনা বলছিলাম। তখন বয়সও কম, আর চেহারাও ছিল ভীষণই ছিপছিপে। সেই সময়টায় ভারতীয় ফুটবলে আক্রমণভাগের ফুটবলার মানেই শক্তিশালী, বিশাল চেহারার হবে। মানে একটা বুলডোজিং ব্যাপার। আমি ছিলাম একদমই উল্টো। আমি জোর দিতাম স্কিলের ওপরে। যে কারণে, কোচ সুব্রত শুরুতে আমার ওপর খুব একটা ভরসা করতে পারছিলেন না, সেটা বুঝতেও পারছিলাম। শুরুতে গোড়ালির চোটটা ছিল বলে এই ব্যাপারটাকে নিয়ে তেমনমাথা ঘামাইনি। মনেপ্রাণে চাইছিলাম, সেকেন্ড টিমে খেলতে খেলতেই চোটটা সেরে যাক। আর দ্বিতীয় সপ্তাহের পর সেটাই ঘটল। চোটমুক্ত হওয়ার পর ভীষণভাবে চাইছিলাম, প্র্যাকটিসে প্রথম দলে খেলতে। কিন্তু সেই সুযোগটাই আসছিল না। আসল কারণটাও বুঝতে পারছিলাম। কোচ ভাবছিলেন, যেকোনও দিন নাইজেরিয়ান ফুটবলার জনের সঙ্গে চুক্তিসংক্রান্ত সমস্যা মিটে যাবে। আর আমিও তখন চলে যাব বাদের তালিকায়। জনের ব্যাপারটা চূড়ান্ত হচ্ছিল না বলেই আমাকে ট্রায়ালে রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় অপশন হিসেবে। এদিকে, আমার এজেন্টের মারফত জানতে পারছিলাম, জন যে টাকাটা পারিশ্রমিক হিসেবে চেয়েছে, সেটা ক্লাব দিতে নারাজ। যেহেতু আর্থিক ব্যাপারে চুক্তিটা আটকে, তাই আমার মন বলছিল, কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো সমস্যা মিটে যাবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রায় একমাস ধরে মোহনবাগানে ট্রায়াল দিচ্ছি। তখন প্রায় প্রতিদিনই সাংবাদিকরা সকালে মাঠে আসতেন আমাদের প্র্যাকটিস কভার করতে। তাই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মোহনবাগান ট্রায়ালে আমার পারফরম্যান্স নিয়ে লেখালেখি হচ্ছিল। সেদিন রাতে যখন নিউমার্কেটে পায়চারি করে হোটেলে ফিরলাম, রিসেপশনে বলল, কেউ একজন এসে আমার খোঁজ করছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গিয়েছে। কিন্তু নাম বলেনি। আমি আর সিলভেইরো দু’জনেই বেশ অবাক হলাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ড্রেসিংরুমে অন্য ফুটবলাররা জনের সই আর আমায় নিয়ে আলোচনা করছে, তা বেশ বুঝতে পারতাম। ইংরেজি বুঝতাম না, ফলে ঠিক কী বলছে সেটা বোধগম্য হত না। কিন্তু সতীর্থদের শরীরী ভাষা আমার চোখে ধরা পড়ে যেত।। প্র্যাকটিস শেষে হোটেলে ফেরার সময় সিলভেইরোর থেকে একদিন শুনলাম, জনের আর্থিক চুক্তির ব্যাপারটা মিটে গিয়েছে। এখন নতুন সমস্যা হল ভিসা নিয়ে। সেই সময়টায় ভীষণভাবে চাইছিলাম, কোচ শুধু একটা দিন আমাকে প্রথম দলে খেলার সুযোগ দিক। কারণ, প্র্যাকটিস ম্যাচে দ্বিতীয় দলে যে ফুটবলাররা খেলছিল, তাদের মধ্যে জেতার সেই তাগিদটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বল পাস করে ঠিক জায়গায় ফিরতি বল পাচ্ছিলাম না। রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। মোহনবাগানে আমার ট্রায়াল তখন মাসখানেক হয়ে গিয়েছে। একদিন হোটেলে বসে সিলভেইরোর সঙ্গে গল্প করতে করতে হতাশ হয়েই বললাম, ‘কোচ যদি একদিন আমাকে প্রথম দলে খেলার সুযোগ দিতেন…!’ ঠিক হল, আর একদিন দেখব। সকালে প্র্যাকটিসে গিয়ে যদি দেখি, কোচ আমাকে প্রথম দলে খেলাচ্ছেন না, তাহলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ব্রাজিল ফিরে যাব। আর অপেক্ষা করব না। হয় এসপার না হয় ওসপার!
মুডটা ঠিক ছিল না বলে, ডিনার সেরে রাতেরবেলায় সিলভেইরোর সঙ্গে নিউমার্কেটে একটু পায়চারি করতে বেরোলাম। মনে মনে ঠিক করেই ফেলেছি, আর একটা দিন মোহনবাগানের প্র্যাকটিসে যাব। এই সময়েই একটা ঘটনা ঘটল, যা পরে ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের থেকেও শুনেছি। প্রায় একমাস ধরে মোহনবাগানে ট্রায়াল দিচ্ছি। তখন প্রায় প্রতিদিনই সাংবাদিকরা সকালে মাঠে আসতেন আমাদের প্র্যাকটিস কভার করতে। তাই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মোহনবাগান ট্রায়ালে আমার পারফরম্যান্স নিয়ে লেখালেখি হচ্ছিল। সেদিন রাতে যখন নিউমার্কেটে পায়চারি করে হোটেলে ফিরলাম, রিসেপশনে বলল, কেউ একজন এসে আমার খোঁজ করছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গিয়েছে। কিন্তু নাম বলেনি। আমি আর সিলভেইরো দু’জনেই বেশ অবাক হলাম।
পরের দিন সকালে ফের গেলাম মোহনবাগান প্র্যাকটিসে। মাঠের সাইড লাইনের ধারে দেবাশিস দত্ত বসেছিল। মাঠের ভিতর সেই সময় দল ভাগ করা হচ্ছিল, প্র্যাকটিস ম্যাচের জন্য। সেই সময় মাঠের বাইরে সিলভেইরো কিছুটা উত্তেজিত হয়েই দেবাশিসের কাছে অভিযোগের সুরে জানতে চায়, কোচ কেন আমাকে প্রথম দলে একদিনও সুযোগ দিচ্ছেন না। তারপর অনুরোধ করে বলে, অন্তত একটা দিন তো আমাকে প্রথম দলে সুযোগ দিয়ে দেখুক। এরপরেই দেবাশিস উঠে গিয়ে সুব্রত’র সঙ্গে কথা বলে। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে প্রথম দলে সুযোগ দেওয়া হল।
এতদিন ধরে এই অপেক্ষাতেই ছিলাম। তখন আমি পুরো ফিট। প্রথম দলে সুযোগ পেতে আত্মবিশ্বাস একধাক্কায় কয়েকগুণ বেড়ে গেল। প্র্যাকটিসে কেউ আমাকে আটকাতে পারছিল না। বল পায়ে ছেলেখেলা করছিলাম। এরপর আর মোহনবাগানে সুযোগ পেতে এক মুহূর্ত দেরি হয়নি। প্র্যাকটিস শেষে আমার চুক্তি নিয়ে ক্লাবের ভিতরে সিলভেইরোর সঙ্গে আলোচনায় বসে দেবাশিস। তারপর থেকে যতবার মোহনবাগানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, পুরো ব্যাপারটা দেবাশিসই দেখত।
ও হ্যাঁ, কথায় কথায় আসল কথাটা বলতেই তো ভুলে গেলাম। সেদিন রাতে আমাকে তুলে নিয়ে নিজেদের ডেরায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিল ইস্টবেঙ্গল কর্তা বাবু চক্রবর্তী! মানে, সেদিন যদি আমাকে হোটেলে পেয়ে যেত, তাহলে হয়তো ওর সঙ্গে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব সই করে দিতাম। স্রেফ একটা দিন আগে এলেন তিনি।
ভাবুন তো, সময়ের একটু এদিক-ওদিক হলেই মোহনবাগান নয়, ইস্টবেঙ্গল জার্সি পরে ফেলতাম। কিন্তু প্রভু যিশু হয়তো চাইছিলেন, মোহনবাগান জার্সিতেই ভারতের বুকে আমার নবজন্ম হোক। তবে সেই শেষ নয়, পরেও ইস্টবেঙ্গলে খেলার প্রস্তাব পেয়েছি। আজ থাক, পরের কোনও কিস্তিতে সেই গল্পও আপনাদের নিশ্চয় বলব।
অনুলিখন: দুলাল দে
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩। মোহনবাগানের ট্রায়ালে সুব্রত আমায় রাখত দ্বিতীয় দলে
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর খুব সঠিকভাবেই ভারতের বিদেশনীতির ব্যাখ্যা করে আগাম বলে রেখেছিলেন, ‘হোয়াইট হাউস ডেমোক্র্যাট প্রার্থী না রিপাবলিকান প্রার্থীর দখলে গেল তা নিয়ে নয়াদিল্লি মোটেও চিন্তিত নয়। কারণ, ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের এতে কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। গত পাঁচটি প্রেসিডেন্টের আমলেই ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে।’